ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
পোশাকশিল্পে বিরাজমান সমস্যাগুলো সম্পর্কে দেশবাসী কমবেশি অবগত আছেন। ঢাকার গাজীপুর, আশুলিয়াসহ নানা অঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে শতাধিক কারখানা অচল হয়ে পড়েছে। শ্রমিকদের বেতন কাঠামো ও ন্যায্য মজুরিপ্রাপ্তির প্রত্যাশায় তাদের এ ধরনের আন্দোলন-সংগ্রাম দীর্ঘকালই চলে আসছে। কতিপয় মালিকপক্ষ বিভিন্ন অজুহাতে নিয়মিত বেতন ও অতিরিক্ত শ্রমের মূল্য পরিশোধে প্রায়ই গড়িমসি করে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ব্যাংক খাতের সীমাহীন দুর্বলতা সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করেছে। পর্যাপ্ত সুবিধা পেতে মালিকপক্ষ হিমশিম খাচ্ছে বলেও খবর রয়েছে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, শ্রমিক অসন্তোষের কারণে অস্থির শিল্পাঞ্চলে বিদেশি ক্রেতারা ক্রয়াদেশ স্থগিত করছেন। অনেক ক্ষেত্রে আস্থাহীনতায় তারা নতুন করে ক্রয়াদেশও দিচ্ছেন না। ইতোমধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সরকার পতন এবং শ্রমিক অসন্তোষের জেরে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশের একটা অংশ প্রতিবেশী ভারতসহ বিভিন্ন দেশের বাজারে চলে যাওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে কারখানাগুলো এক ধরনের সচলতা-অচলতার দোদুল্যমানতায় সিদ্ধান্তহীন অবস্থায় রয়েছে। সেনবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় অস্থিরতা বা বিরোধ-সংঘাত কিছুটা প্রশমিত হলেও কোনো না কোনোভাবে তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। অতিসম্প্রতি গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির দাবিতে বিক্ষোভ করেছে। আশপাশের কয়েকটি কারখানায় এর আঁচ অনুভূত হলে কারখানাগুলোয় ছুটি ঘোষণা করা হয়।
শ্রমিক অসন্তোষের পাশাপাশি বিভিন্ন কারণে দেশের পোশাক খাত কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন। খাতসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ-জ্বালানি সংকট, শ্রমিক অসন্তোষ ও ব্যাংকের অস্থিতিশীলতা, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, গ্যাস-বিদ্যুতের ঘাটতি, বিশ্বব্যাপী উচ্চমূল্যস্ফীতিসহ বেশ কয়েকটি কারণে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ঝুঁকি বাড়ছে। আর্থিক সংকটে পড়েছে বেশির ভাগ গার্মেন্ট কারখানা এবং কিছু কারখানা এরই মধ্যে বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে অতীতে ভালো অবস্থানে থাকা কারখানাগুলোও এখন সমস্যায় নিপতিত। অনেক উদ্যোক্তার মতে, চলমান অস্থিতিশীলতায় অন্তত ১০ শতাংশ রপ্তানি আদেশ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বায়াররা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারত, পাকিস্তানসহ অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ জানায়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে সেপ্টেম্বরে ভারতের তৈরি পোশাক (আরএমজি) রপ্তানি বার্ষিক ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, ৬ মাসে পোশাক খাতে ১০০ কারখানা বন্ধ হয়েছে। বেকার হয়েছে ৫০ থেকে ৬০ হাজার শ্রমিক। শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করতে পারছে না ১৫৮টি প্রতিষ্ঠান।
তাছাড়া বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশি পোশাকের দাম কমিয়ে দিচ্ছে। ইউরোপীয় পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের প্রতিবেদন অনুসারে, বিদায়ি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর ১০ মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের দাম কমিয়েছে ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলসের (ওটেক্স) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের দাম বর্তমানে ৩ দশমিক ৮ থেকে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে। বিশেষ করে ছেলেদের কটন ওভেন ট্রাউজার ৪ দশমিক ৪, কটন ওভেন শার্ট ৩ দশমিক ৮ এবং কটন নিট টি-শার্টের দাম কমেছে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। এক বছর আগে এসব পণ্যের যে দাম ছিল, এখন সেসব পণ্য তার থেকে প্রায় ৭ দশমিক ৭ শতাংশ কম দামে আমদানি করছে দেশটি।
প্রসঙ্গত, বিজিএমইএ-এর সাবেক পরিচালক গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা কমে গেছে। বেশির ভাগ কারখানার মালিক লোকসান দিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন। বড় লোকসান থেকে বাঁচতে বেশির ভাগ কারখানার মালিক কম দামে পোশাক বিক্রি করছেন। আগে যে পোশাক বিক্রি করে আমরা ১০০ টাকা পেতাম, এখন সেই একই পোশাক বিক্রি করে পাচ্ছি ৯৫ টাকা। অথচ আগে যে পোশাক তৈরি করতে আমাদের খরচ ১০০ টাকা হতো, এখন সেই পোশাক তৈরি করতে খরচ হচ্ছে ১৫০ টাকা। ৫০ শতাংশের মতো উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এ খাতের বেশির ভাগ উদ্যোক্তার মুনাফা হচ্ছে না। হয়তো হাতেগোনা কেউ কেউ ১ থেকে ২ শতাংশ প্রোফিট করছেন। এ পরিস্থিতিতে পোশাকের দাম বাড়ানো জরুরি ছিল, কিন্তু ক্রেতারা উলটো দাম কমিয়েছে। এতে অনেক কারখানা, বিশেষ করে ছোট এবং মাঝারি সাইজের প্রতিষ্ঠানগুলো এখন লোকসানে চলছে।’
মূলত উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে কম বলেই এখানে ক্রেতাদের আগ্রহ সবসময় বেশি। জন-অধ্যুষিত বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের প্রচণ্ড অভাবে কম পারিশ্রমিকেও শ্রমিকরা কাজ পেতে ইচ্ছুক। জীবনযাত্রার কঠিন বাস্তবতায় দুর্মূল্যের দুর্ভোগে বিকল্প কোনো পথ তাদের সামনে খোলা নেই। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিদেশি ক্রেতারা দরকষাকষির মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে পোশাক উৎপাদনে বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছে। একদিকে তাদের লভ্যাংশের পরিমাণ বেশি, অন্যদিকে মালিকপক্ষের লাভ-লোকসানের ভারসাম্যে শ্রমিকরা নিয়মিত নিষ্পেষিত হচ্ছে। তবুও কর্মসংস্থানের আকাল, বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের প্রাধান্য পোশাকশিল্পকে এ পর্যন্ত এগিয়ে নিয়েছে। দেশব্যাপী কর্মক্ষম নারীদের কর্মযোগী করার অপার সম্ভাবনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসাবে এ শিল্প সর্বত্রই সমাদৃত। কম শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত নারীরা স্বল্পসময়ের মধ্যে কারিগরি দক্ষতা অর্জন করে নিজেদের যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে এ শিল্পকে করেছেন অধিকতর সমৃদ্ধ। দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের পোশাক কারখানাগুলোয় নারী শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। বিজিএমইএ-এর গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৮০ সালে এ শিল্পে নারী শ্রমিকের হার ছিল ৮০ শতাংশ, ২০২১ সালে যা ৫৩ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে আসে।
দেশের রপ্তানি খাতের প্রধান শিল্প হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এ খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ২০২৩-২৪ সালের তথ্যমতে, তৈরি পোশাকের রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানে আছে। ওই অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি করেছে, যা জাতীয় জিডিপিতে ১০ দশমিক ৩৫ শতাংশ অবদান রেখেছে। ৩ জানুয়ারি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত উল্লিখিত সংস্থার অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে হওয়া প্রায় ১৩ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে বিশেষ অবদান রেখেছে তৈরি পোশাক। এ সময়ে ২ হাজার ৪৫৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৯৮৯ কোটি ডলারের।
আর্থসামাজিক বিবেচনায় এ খাতের অবদান এখনো সর্বাধিক। ইতোমধ্যে শ্রমবাজারে বাংলাদেশের অবস্থানও অনেকটা সুদৃঢ় হয়েছে। ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহের ঊর্ধ্বগতি আশানুরূপ পর্যায়ে পৌঁছেছে। গণমাধ্যম সূত্রমতে, বিদায়ি বছরের ডিসেম্বরে প্রবাসীরা রেকর্ড ২৬৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। আগে দেশে এক মাসে সর্বোচ্চ পরিমাণ রেমিট্যান্স ২৫৯ কোটি ডলার এসেছিল ২০২০ সালের জুলাইয়ে। তাছাড়া চলতি মাসের প্রথম চারদিনে রেমিট্যান্স এসেছে ২২ কোটি ৬৭ লাখ মার্কিন ডলার। এ সময়ে গড়ে প্রতিদিন রেমিট্যান্স এসেছে ৫ কোটি ৬৬ লাখ ডলার। রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের দেশে পাঠানো অর্থের জোগান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তৈরি পোশাক রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিগত যে কোনো সময়ের তুলনায় আশাজাগানিয়া অবস্থানে রয়েছে। ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ২৬ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুসারে এর পরিমাণ ২ হাজার ১৩৩ কোটি বা ২১ বিলিয়ন ডলার।
বিজ্ঞজনদের দাবি, সৌহার্দ-সম্প্রীতি-পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে এ শিল্পের প্রসার কর্মসংস্থানের জন্য অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করেছে। দেশের পোশাকশিল্পের বর্তমান সংকট মোকাবিলায় সরকার এবং শিল্প মালিকদের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। রপ্তানিমুখী এ শিল্পকে বাঁচাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মালিকদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতা, শ্রমিক নেতা, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে এ শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। দেশের অর্থনীতিও পঙ্গু হবে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি লিড সার্টিফায়েড সবুজ কারখানার দেশ। পরিবেশবান্ধব এ উৎপাদন পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে পরিবেশ সচেতন আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা বৃদ্ধি ও আকৃষ্ট করতে হবে। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায়, কর্মসংস্থানের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরিতে ব্যর্থ হলে তরুণ প্রজন্মের কর্মক্ষেত্রে বেকারত্ব ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি করবে। শ্রমের বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিদেশি দূতাবাসগুলোসহ সবরকম সুযোগ কাজে লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য। এক্ষেত্রে দূতাবাসগুলোর অধিকতর সক্রিয় হওয়া জরুরি। প্রায় লন্ডভন্ড বিশ্বের সর্বত্রই একই অবস্থা পরিলক্ষিত হলেও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের পাশাপাশি কম জনসংখ্যার দেশগুলোয় শ্রমবাজার বিস্তারের বিষয়টি অবশ্যই বিবেচ্য।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী