সুব্রত বিশ্বাস
যুদ্ধাপরাধী খুনী জামায়াতে ইসলামী এখন ধূয়া তুলসীপাতা, মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় ফ্রি। অন্তর্বতী সরকার প্রধান ড. ইউনুস তাদের হাতের বন্ধন, পায়ের বেড়ি ও মুখের লাগাম খুলে দিয়েছে। তারা এখন সত্য মিথ্যা যাকিছু মনের মাধুরী মিশিয়ে ইচ্ছেমতো বলতে কোনও বাধা নেই। তাই সম্প্রতি জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান লাগামছাড়া বলার এক পর্যায়ে বলেছেন, দেশে দেশপ্রেমিক পরীক্ষিত দল নাকি দুইটা। একটি জামায়াতে ইসলামী এবং অপরটি সেনাবাহিনী। প্রশ্ন আসে ব্যক্তি, দল বা প্রতিষ্ঠান দেশপ্রেমিক কিনা কিভাবে কিসের নিরিখে বা ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। স্বভাবতই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দেশাত্ববোধক ভূমিকা ও কাজের মধ্য দিয়েই দেশপ্রেমিক অভিধায় নির্ধারিত হয়। শফিকুর রহমান দেশে এতগুলো দলের মধ্যে এই দুটি দল বা প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কোনও দেশপ্রেমিক দল খুঁজে পাননি। নিজের দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী দেশপ্রেমিক মনে করবেন করতে পারেন এটাই স্বাভাবিক। তবে দেশপ্রেমিক কিনা সে প্রশ্নে পরে আসছি। তর্কের খাতিরে তার কথায় আপাতত ধরে নিলাম নিজের দল জামায়াতে ইসলামই একমাত্র দেশপ্রেমিক দল। কিন্তু সেনাবাহিনীকে দেশপ্রেমিক কিসের নিরিখে মনে করলেন? একটি দেশের সেনাবাহিনীকে অবশ্যই দেশপ্রেমিক হিসেবেই গড়ে তোলা হয় কিংবা তোলার চেষ্টা করা হয়। আমাদের সেনাবাহিনী পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক সেটা তিনি কেমন করে জানলেন? তর্কের খাতিরে আমাদের সেনাবাহিনী দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে উঠলেও তারা কি তাদের দেশপ্রেমিক মর্যাদা রক্ষা করতে পেরেছে? দুই দুইবার অন্যায় ও অগণতান্ত্রিক পথে তারা দেশের ক্ষমতা জোর করে দখল করেনি? প্রথমবার জেনারেল জিয়া, দ্বিতীয়বার জেনালের এরশাদ ক্ষমতা দখল করেছেন। দু’জনেরই হাত হত্যা ও খুনের রক্তে রঞ্জিত একথা অস্বীকার করা যাবে? ফলে কলঙ্কের ট্যাগ লাগানো সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক হয় কিভাবে? জেনারেল এরশাদ জনগণের কাছে স্বৈরাচার হিসেবে চিহ্নিত এবং আখ্যায়িত। শুধু কি তাই, দুর্নীতির মহানায়ক এবং একজন চরম নারী লিপ্সু লম্পট হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। সুতরাং নিজের দল হিসেবে জামায়াত না হয় দেশপ্রেমিক, কিন্তু সেনাবাহিনীকে কোন যুক্তিতে দেশপ্রেমিক বললেন। আসলে পাছায় তো অনেক দুর্গন্ধ লেগে আছে, ভয় আছে, ভয় থাকলে মানুষ সেনাবাহিনীকে তেল দিয়ে চলে। শফিকুর রহমান তাই তেল দিয়েছেন। তবে অনেকে মনে করেন, সেনাবাহিনীতে জামাতের বিরাট একটি গ্রুপ রয়েছে। সম্প্রতি রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সুযোগে জামায়াত ক্ষমতার কাছাকাছি আসায় প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের সাথে সেনাবাহিনীতেও তারা নিজের অনুগামীদের বসিয়েছে। শক্তির এই অবস্থান থেকেও হয়তো বলতে পারেন।
এবার আসি জামাতের আমির ডা. শফিকুর রহমান ও তার দল দেশপ্রেমিক কিনা সে সম্পর্কে।শফিকুর রহমান সম্ভবত এসব বক্তব্য দেওয়ার দিন কয়েক পর, বিএনপি’র যুগ্ম সম্পাদক রিজভি আহমেদ কিছু প্রশ্ন রেখেছেন। তিনি অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন, জামায়াত ও শফিকুর রহমানকে নিয়ে। তিনি শফিকুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন রেখে বলেছেন, একাত্তরে আপনার এবং জামাতের ভূমিকা কি ছিল? দেশপ্রেমিকতো গাছের মোয়া নয়। দেশপ্রেমিক দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে গড়ে ওঠে। একাত্তরে পাকবাহিনী দেশের মানুষের উপর ধর্ষণ-নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে,মা-বোনদের ধরে নিয়ে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে। দিনের পর দিন তাদের আটকে রেখে ধর্ষণ করেছে, এর চেয়ে মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধ আর কি হয়? এই যে আপনার দল জামায়াত এতবড় অপরাধ করল, জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করল, যে অপরাধের কোন সীমা হয়না। এটাইতো ছিল আপনার পূর্বসুরী নেতাদের ও দলের সেদিনের ভূমিকা। এটাইতো আপনার দল জামাজতে ইসলামীর সেদিনের ইতিহাস। তাই বিএনপি নেতা রিজভির প্রশ্নের সাথে সুর মিলিয়ে বা একাত্ম হয়ে আমিও বলি সেদিন জামাতে ইসলামী জাতির সাথে হয়ে কোন সেক্টর ও সেক্টর কমান্ডারের সাথে যুদ্ধ করেছিল? রিজভি আহমেদ সে কথাই বলেছেন, বলেছেন আপনার দলের দেশপ্রেমিক অবস্থান ও ভূমিকা তো এটাই ছিল। আর সেটা নিশ্চয়ই জাতির বিরুদ্ধে, পাকবাহিনীর পক্ষে ছিল।
দ্বিতীয়তঃ ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে মুক্তিযুদ্ধ যখন একেবারে তুঙ্গে, তখন আপনার নেতা গোলাম আযম ঠিক এই কথাটিই বলেছিলেন। আর তা বলেছিলেন, একাত্তরে জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত পাকবাহিনীকে উদ্দেশ্য করে। আপনি সেই কথাটিরই পুনপ্রতিধ্বনি করেছেন। জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত পাকবাহিনীর উদ্দেশ্যে বলা সেই কলঙ্কিত কথাটি আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর গায়ে ট্যাগ লাগিয়ে আপনি জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান চরম অন্যায় অপরাধ করেছেন। কিন্তু পাক সেনাবাহিনীকে উদ্দেশ্য করে বলা ট্যাগ আমাদের পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর গায়ে খুনী দলের আমির শফিকুর রহমান লাগিয়ে দিলেন, অথচ আমাদের সেনা প্রধান কিংবা সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কোনও প্রতিবাদ পরিলক্ষতি হয়নি। উচিত ছিল সেনাপ্রধান কিংবা সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিবাদ জানানোর। তাদের এই নীরব ভূমিকা অবশ্যই নানা প্রশ্ন ও সন্দেহের জন্ম দিয়েছে এবং দেবে বলার অপেক্ষা রাখেনা।
তর্কের খাতিরে বলা যেতে পারে কিংবা জামাতের আমিরও হয়তো বলতে পারেন, আমরাতো তখন ছিলাম না, আমরাতো যুদ্ধ করিনি। কিন্তু আপনার দলতো ছিল, আপনার দল জামাততো জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। আপনার দল যদি সেদিন ভুল করে থাকে তারা কি সেজন্য ক্ষমা চেয়েছে? না, আজও ক্ষমা চায়নি, চাওয়া হয়নি। বরং আপনার পূর্বসুরীরা বলেছে, তারা কোনও ভুল করেনি। আপনিও সেই কথাটিই জোর গলায় বলে বেড়াচ্ছেন, আপনার দল কোনও ভুল করেনি। যুদ্ধ হয়েছে পাকিস্তানের সাথে ভারতের। ভারতের আধিপত্য স্থাপিত হতে পারে তাই পাকিস্তানের হয়ে আপনারা ও আপনার দল যুদ্ধ করেছে। এসব কৌশলী কথা দিয়ে আপনি যতই এড়িয়ে যাবার চেষ্টা বা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করুন এটাও আপনার অপরাধের পর্যায়েই পড়ে। সম্প্রতি জামাতের আমির শফিকুর রহমান নাটোরে দলের কর্মীসভায় আরও একটি কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, যারা ক্ষমতায় থেকে জাতির বিরুদ্ধে খুন-হত্যার তান্ডব করেছে তাদের আবার কিসের নির্বাচন? তিনি বস্তুত আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলেছেন। প্রশ্ন হলো-আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতে পারবে কি পারবে না শফিকুর রহমান বলার কে? গণতান্ত্রিক নিয়মে সেটা দেশের জনগণই নির্ধারণ করবে। জামায়াত কিংবা আপনি জামায়াতের আমির নয়। আপনি একটি দলের আমির মাত্র। তিনি আরও বলেছেন, যারা ক্ষমতায় থেকে তান্ডব করেছে তাদের আবার কিসের নির্বাচন। শফিকুর রাহমান সাহেব নিশ্চয় ভুলে গেছেন জোট সরকারের আমলের কথা? ২০০১ সালে জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় থেকে কি কম তান্ডব করেছে? সেজন্য কি জোটের নির্বাচন অবৈধ হয়ে গিয়েছিল? শফিকুর রহমান আরও বলেছেন, যারা দেশপ্রেমিক, দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করে, মানুষ দেশপ্রেমিক হিসেবে বিবেচনা করে তারাই ভোট বা নির্বাচনের দাবি করতে পারে, অন্য কেউ নয়। আপনার নামের পেছনে জনাব লাগাতে আমার ঘেন্না হয়, তাই মিঃ আমির এই যে এতক্ষণ আপনি ও আপনার দলকে নিয়ে যতসব ইতিহাসের কথা বললাম, তুলে ধরলাম, তাতে কি আপনার দল কিংবা আপনার দেশপ্রেম আদৌ প্রমাণ করে? না আপনি ও আপনারা এবং আপনাদের দল জামায়াতকে একটি খুনি-মানবতাবিরোধী অপরাধী দল হিসেবেই প্রমাণ করে।দেশপ্রেমিক নয়। দুর্ভাগ্যবশত দেশের অবস্থা পরিবর্তনের কারণে আজ আপনার মুখে দেশপ্রেমের বিকৃত কথা শোভা পায় বটে, কিন্তু আদতে আপনি ও আপনারা জাতির শত্রু এবং দেশবিরোধী,মানবতাবিরোধী–দেশপ্রেমিক নয়।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।