জোবাইদা নাসরীন
গতকাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিকাল পাঁচটায় আমরা অনেকেই জড়ো হয়েছিলাম। সেই জড়ো হওয়া ছিল ক্ষোভের, প্রতিবাদের, আবার সহমর্মিতারও। আমাদের আদিবাসী বন্ধুরা ভয়াবহ হামলার শিকার হয়ে সেই হাসপাতালে কাতরাচ্ছিল। জুয়েল মারাক। পেশায় সাংবাদিক। শরীরের প্রতিটি পরতে তার জখম দেখেছিলাম। অনন্ত ধামাই, শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গার আক্রান্ত ছবি কাল সারা দিন দেখেছি। টনি, ডনই, সবার আমাদের কাছের, কাকে রেখে কার কথা বলবো, কম বেশি সবাই আক্রান্ত। সবাই আমরা সবার কাছের হবো, ঢাল হয়ে দাঁড়াবো একে অপরকে রক্ষা করতে, সেটিই কাঙ্ক্ষিত ছিল। কিন্তু সেটি আমরা পারিনি। কেউ কাউকে রক্ষা করতে পারিনি, পারছি না। আর গুরুত্বপূর্ণ হলো এই হামলার ঘটনাটি সেদিনই হলো, যেদিন সংবিধান সংস্কার কমিটি তাদের সংস্কার প্রস্তাবনা প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিলেন এবং সেখান বাংলাদেশের সংবিধানের প্রধান চার নীতির মধ্যে গণতন্ত্র রেখে সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং দরদের কথা যুক্ত করার কথা প্রস্তাব করেছেন।
কিন্তু একদিকে সাম্য, মর্যাদা আর দরদের প্রস্তাব, তাহলে কেন আদিবাসী শিক্ষার্থীদের বেধড়ক পেটানো হলো? এই ‘কেন’র সঙ্গে অনেক ‘কেন’ যুক্ত। জুলাইয়ের অভ্যুত্থান হয়েছিল সাম্য, মর্যাদা, প্রাপ্যতা, ন্যায্যতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ এবং রাষ্ট্রের অঙ্গীকার থেকে। তাহলে সেই অভ্যুত্থান থেকে তৈরি হওয়া অন্তর্বর্তী সরকার বারবার মবের কাছে নতি স্বীকার করছে কেন?
গণঅভ্যুত্থানের তেজ এবং অঙ্গীকারের জায়গা থেকেই যদি সমতা এবং মর্যাদার প্রতীক হিসেবে একটি গ্রাফিতি ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ পুস্তকে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত সরকার নেয় তাহলে সেটি কেন বজায় রাখতে পারলো না? যে গ্রাফিতির মূল উদ্দেশ্যে ছিল এ দেশে বসবাসকারী হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি আদিবাসীরাও রয়েছেন এবং সেগুলোকে একটি গাছের পাতা হিসেবেই দেখানো এবং সেই গ্রাফিতিতে বলা হয়েছে, ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’। কিন্তু এই গ্রাফিতি পাঠ্যপুস্তকে থেকে বাদ দেওয়ার জন্য প্রতিবাদ করে ‘স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি নামে একটি সংগঠন। তাদের একটি প্রতিবাদের কারণেই সরকার তাড়াহুড়া করে সেই পাঠ্যপুস্তক থেকে সেই গ্রাফিতি সরিয়ে নিয়ে অন্য গ্রাফিতি যুক্ত করে। কিন্তু কেন?
সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ১৫ জানুয়ারি এনসিটিবি ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দিয়েছিল আদিবাসী শিক্ষার্থীরা। ঠিক একই স্থানে সেদিন ‘স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি’ সংগঠনটি তাদেরও পাল্টা দাবি-দাওয়া নিয়ে যায় এবং আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে। এবং সেই ঘটনার বিভিন্ন ফুটেজে দেখা যাচ্ছে ‘স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি’র কর্মীদের হাতে থাকা লাঠির মাথায় জাতীয় পতাকা। পতাকা বাঁধা সেই লাঠি দিয়ে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের পেটানো হচ্ছে। তাদের হাতে ক্রিকেট স্ট্যাম্পও ছিল। সূত্রমতে, সেখানে পুলিশও উপস্থিত ছিল। কিন্তু আদিবাসী শিক্ষার্থীদের রক্ষায় তাদের কোনও ভূমিকা ছিল না বলেই জানিয়েছেন আক্রান্ত শিক্ষার্থীরা।
এখন এ বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্ন হাজির করা খুব জরুরি। এই অন্তর্বর্তী সরকার প্রথমে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করলেও এখন কেন সেখান থেকে সরে আসছে? এগুলো তো ক্ষমতাচ্যুত সরকার আওয়ামী লীগ করেছে। এখন এই সরকারকে কেন এগুলো করতে হচ্ছে। যেকোনও ভুঁইফোড় সংগঠন একটি ছোটখাটো ব্যানার নিয়ে দাঁড়ালেই সরকার তার অবস্থান বা সিদ্ধান্ত থেকে সরে যাচ্ছে। কিন্তু কেন? তাহলে এদের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক আছে? সরকার কি মবের দিকনির্দেশনায় চলছে, নাকি এই মবের রাজনীতিকেই জারি রাখতে চাচ্ছে? কেননা আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সরকার মবের কারণে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে বলেই এই সংগঠনটি আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করতে পেরেছে। কারণ তারা জেনে গেছে সরকারের কাছে তাদের কদর আছে। সঙ্গত কারণেই খুব জরুরি হিসেবে হাজির হয় সরকার আসলে পরিচালনা করছে কে?
অনেকেই এই ঘটনায় জড়িত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার এবং বিচারের দাবি করছেন। গণমাধ্যম সূত্র আমরা জানতে পেরেছি, ইতোমধ্যে দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু যখন সরকার জানলো দুটো গ্রুপই একই জায়গায় কর্মসূচি দিয়েছে (যদিও আদিবাসী শিক্ষার্থীরা আগে দিয়েছিল) সেখানে তাহলে সবার নিরাপত্তার জন্য কী ব্যবস্থা রেখেছিল? পুলিশ থাকলেও কেন নীরব ছিল? তার আগের প্রশ্ন এই সংগঠন কাদের? যে কেউই দাঁড়ালেই সরকার তার অবস্থান থেকে সরে যাবে? তাহলে আসলে সরকারের কাজ কী? সরকার মবকে প্রাধান্য দিয়ে যখন একের পর এক অভ্যুত্থানের অঙ্গীকার থেকে সরে আসছেন তাহলে আমাদের বলতেই হবে, এই হামলাগুলোর পেছনে সরকারের আশকারা আছে। এই আশকারার ভিত্তি কী? উদ্দেশ্য কী? সেসব তো সরকারকেই খোলাসা করতে হবে।
শিক্ষার্থীরা সব পাঠ্যবই আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যেই হাতে পাবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ (দৈনিক প্রথম আলো ১৪ জানুয়ারি ২০২৫)। তা মানে ধরে নেওয়া হচ্ছে বিলম্ব হচ্ছে। তাহলে সেই বই কীভাবে নীলক্ষেতে পাওয়া যাচ্ছে? এবং বিভিন্ন সংগঠনের নামে মব তৈরি করে বই পরিবর্তনও করা হচ্ছে।
এই সরকারের দায়িত্ব যেমন শুধু নির্বাচন উপহার দেওয়া নয়, তেমনই এই সরকারকেও মনে রাখতে হবে তারা এসেছেন একটি অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে, যে অভ্যুত্থানের মূল জায়গাই ছিল বাংলাদেশ কোনও দল বা কোনও গোষ্ঠীর নয়, বাংলাদেশ সবার হবে। কিন্তু কই সেই বোধ? কারা সেই বোধ থেকে সরকারকে সরিয়ে রাখছে? নাকি এটিই সত্যিকার অর্থেই অন্তর্বর্তী সরকারের বোধ।
তাহলে তিন মূলনীতির বাইরে এসে যে প্রস্তাবগুলো করছেন সেখান থেকেই প্রশ্ন করছি- সত্যিকারের দরদ আসলে কার প্রতি কার হবে? মানবিক মর্যাদা এবং সাম্যবোধ কে কার প্রতি অনুভব করবে? সরকারের সঙ্গে মবের?
লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল: ZOBAIDANASREEN@GMAIL.COM