আবার মেতে উঠেছেন গানে গানে
লন্ডন। ভারতীয় ও বাংলা ধ্রুপদী সঙ্গীতের উজ্জ্বল পাখি চন্দ্রা চক্রবর্তীর ক্যানসার জয় করে আবার মেতে উঠেছেন গান ও ভক্তদের নানা আসরে। তিনি সম্প্রতি কলকাতায় গান গেয়ে মাতিয়ে এলেন। থাকেন তিনি লন্ডনে।তাঁর ভেরিফাইড ফেইসবুক পেইজে লিখেছেন–
’আজ ঠিক দু’মাস হলো, আমার ব্রেস্ট ক্যান্সার ( Lobular Breast Cancer) সার্জারি হয়েছে। ঢাকঢোল পিটিয়ে বার বার সবাইকে এই কথাটা বলার একটাই উদ্দেশ্য – ক্যান্সার হলে জীবন থেমে যাবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। গত ১১ নভেম্বরের পর থেকে আজ পর্যন্ত এই দুমাসে আমি বাড়িতে একটা Classical Music এর বৈঠক আয়োজন করেছি, বাড়ি থেকে অফিস করেছি, গানের ক্লাস করেছি নিয়ম মতো, কলকাতায় গিয়ে বাবার বাৎসরিক কাজে যোগ দিয়ে পরের দিনই হায়দ্রাবাদ গেছি, ওখান থেকে শিরডি সাইবাবার দর্শন করে আবার কলকাতায় ফিরে কবি Kalikrishna Guha কাকুর বাড়িতে গান করেছি, পরের দিনই লন্ডনে ফিরে এসে রোজ অফিসে যাচ্ছি, গান শেখাচ্ছি, নিজে রিয়াজ করছি। এখন সরস্বতী পুজো আর Tale Of Tawaif concert এর প্রস্তুতি জোর কদমে চলছে। এই সঙ্গে আমার treatment চলছে, shopping ও চলছে, জামা কাপড় কেনা বা অফিস যাবার সময় এক ঘন্টা ধরে make up করাও চলছে ….।
শরীর থাকলে অসুখ বিসুখ আসবে-না হলে ওরাই বা যায় কোথায়! আমার ক্যান্সারের খবর জেনে অনেক চেনা আর অচেনা মানুষ আমাকে মেসেজ করে লিখেছেন তারাও হয় এই অসুখ থেকে বেরিয়ে এসেছেন আর না হয় এখনো এর মধ্যেই আছেন। কিন্তু কোনো দিন কাউকে বলতে ভয় পেয়েছেন। কয়েকজন শিল্পী খুব দুঃখ করে লিখেছেন ক্যান্সার হয়েছে জানলে কাজ কমে যেতে পারে সেই ভয়ে কাউকে জানাইনি! কি আশ্চর্য! কাজ কমে যাবে কি, আরো বেশি বেশি কাজ হবে – নিজের ওপর এই ভরসাটা তো রাখতেই হবে, না হলে এতো এতো বছর রিয়াজ করে কি লাভ হলো যদি সামান্য একটা ক্যান্সার এসে কাজ কমিয়ে দেয়? ভয় কিসের? আমরা যারা এই অসুখটাকে “থোড়াই কেয়ার” বলে দিব্বি নিজের কাজ কম্মো করে যাচ্ছি, তারাই যদি এগিয়ে এসে অন্যদের ভয় না ভাঙাই তাহলে কে ভাঙাবে? তার চেয়েও বড়ো কথা, এক একটা Cancer এক এক রকমের। এটাও তো সবাইকে জানানো দরকার! যেমন অনেকের lump হয়, কিন্তু আমার যে ধরণের Cancer, তাতে না হয় lump, না হয় অন্য কোনো উপসর্গ। এমন কি ম্যামোগ্রামেও ঠিক মতো ধরা পড়েনা অনেক সময়, তার ফলে এই Cancer শরীরের অন্য জায়গাতেও ছড়িয়ে যেতে পারে।
আমি নিজেও কোনো দিন সেইভাবে নিজের খেয়াল রাখিনি, তবু ঈশ্বরের আশীর্বাদ আর সবার শুভ কামনায় একদিন হটাৎ ধরতে পেরেছিলাম আমার বুকের ভেতরে শক্ত মতো কিছু একটা ডেলা পাকিয়ে আছে, সারা দিন এতো ব্যস্ত থাকি, তক্ষুনি যে ডাক্তারের কাছে যাবো, বা ওটা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করবো সেটাও হয়নি! পরে যখন আবার খেয়াল করেছি, ডাক্তারের কাছে গেছি, Biopsy হয়েছে, অন্য বেশ কিছু tests হয়েছে, তখনি বোঝা গেছে যে tumour টা প্রায় একটা কমলা লেবুর মতো বড়ো। এই জন্য বার বার সবাইকে বলছি কবে আমার বুকে একটা lump হবে, সেই আশায় বসে না থেকে যে কোনো কিছু নজর করলেই তক্ষুনি দেখিয়ে নিতে ভুলবেন না। আপনি কবে তার হদিশ পাবেন, তার জন্য এই ধরণের Cancer বসে থাকবেনা, সে কিন্তু নিজের কাজ ঠিক মতোই করে যাবে আর ধীরে ধীরে আপনার সুন্দর শরীরের অন্য জায়গাগুলোও দখল করে নেবে। এ তো আর ভদ্র ভাড়াটে নয় যে উঠে যাও বললেই উঠে যাবে- এ একবার শরীরের কোথাও ঢুকলে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয় বাছা! যাই হোক, শুধু designer blouse পরলেই হবে না, আমাদের মেয়েদের নিজের শরীরের দিকে আর একটু বেশি খেয়াল রাখতেই হবে- এই টুকুই বলার!
আপাতত সব্বাইকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি কলাকারের সরস্বতী পুজোতে আসার জন্য- ভালো খাবার তো থাকছেই, সেই সঙ্গে নাচ গান কবিতা আর দারুন সাজ গোজের সুযোগ ! মিস করলে আপনাদেরই লস …..।’ এর আগে এক পোস্টে লিখেন– অপারেশনের প্রায় এক মাস পর, দুদিন আগে খুব সাজগোজ করে ডাক্তারের কাছে চেক আপের জন্য গেলাম। কথায় কথায় জিগ্গাসা করলাম “আমি তো এক্কেবারে recover করে গেছি, এখন কি কলকাতায় যেতে পারি”? মহিলা খানিক্ষণ চোখ কপালে তুলে মুখ হাঁ করে বসে থাকার পর কি মনে করে রাজি হলেন! আর আমাকে পায় কে! বলতে গেলে ডাক্তারের চেম্বার থেকে সোজা air port! গতকাল ভোর চারটের সময় কলকাতায় পৌঁছেছি!
তাঁর কলকাতার এক ভক্ত লিখেছেন-’লন্ডননিবাসী উচ্চাঙ্গসঙ্গীতশিল্পী চন্দ্রা চক্রবর্তী গতকালের প্রাকবর্ষশেষ সন্ধ্যায় আমাদের আস্তানায় গান গাইল।সে আমাদের পুত্র দীপাঞ্জনের বন্ধু।তার বিশেষ ইচ্ছায় দীপাঞ্জনও সেতার বাজিয়ে শোনাল।
চন্দ্রা এস আর এ-র স্কলার হিসেবে এ কানন ও মালবিকা কাননের কাছে দীর্ঘদিন তালিম পায়। এখন বেশ কিছুকাল সে যুক্তরাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা ও ব্রিটিশ নাগরিক।
গান শেষ করার পর সে জানাল যে সে ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কারণে মাত্র দুই মাস আগে তার অস্ত্রোপচার হয় যার জন্য সময় লেগেছিল নয় ঘন্টা! কিন্তু নিদারুণ এই কষ্টভোগ সে সহজেই পার হয়ে এসেছে।তার সঙ্গীতপরিবেশনে সেই কষ্টভোগের কোনো ছাপ ছিল না।তার কথা শুনে উপস্থিত সবাই স্তম্ভিত হয়ে রইল। আজ সকালেই সে লন্ডন ফিরে গেল।
আরেকটি কথা প্রসঙ্গত বলা যায় যে তার “ছয়তারের তানপুরা” নামের একটি আত্মজীবনীমূলক বই প্রকাশিত হয়েছে গত বছর যা পড়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বুঝেছিলাম, শুধু লিখে গেলেই কেউ লেখক হয় না; মূল জায়গাটা অনুভবের,দৃষ্টির, বেদনাবোধের’
কলকাতার সংস্কৃতিবোদ্ধা তন্ময় বাসুসহ অসংখ্যজনের সাথে আড্ডা আর গানে সময় পার করে আবার লন্ডনে গানে মেতে ওঠার ঘোষণাতে মনে হয়, ক্যানসারকেও জয় করা যায়।