চাচাতো ভাই বায়েজিদের সঙ্গে সোমবার রাতে রিকশায় করে কর্মস্থল পল্টনে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হন সাজু মোল্লা (২২)। পেশায় চালক সাজুকে পল্টন বিজয়নগর নামিয়ে চলে যান বায়েজিদ। সেখান থেকে সাজু পায়ে হেঁটে পাশের গলিতে ঢুকেন। বায়েজিদ চলে যাওয়ার সময় একটি চিৎকার শুনতে পান। কিছুক্ষণ পরে তিনি সেখানে গিয়ে কিছুই দেখতে না পেয়ে চলে আসেন। আরও কিছুক্ষণ পর খবর পান সাজুকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। পরে সেখান থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ভোর সাড়ে ৪টার দিকে মৃত ঘোষণা করেন। তার শরীরে অনেক ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল। পুলিশ জানিয়েছে, ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া গত ১৫ই ডিসেম্বর ইসলামপুরের একটি পোশাকের দোকানের কর্মচারী ১৮ বছর বয়সী মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহকে মগবাজারে ছিনতাইকারীরা ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। ভোর পৌনে ৬টার দিকে তার বাড়ি ময়মনসিংহ থেকে ফেরার পথে এই ঘটনা ঘটে। গত ১৮ই ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে সায়েদাবাদে কাপড় ব্যবসায়ী কামরুল হাসান (২৩)কে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।
রাজধানী ঢাকা যেন এখন ছিনতাইয়ের নগরী। দিনের বেলাও প্রকাশ্য ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। আর রাত হলে পুরো শহর জুড়ে আতঙ্ক থাকে। দূর-দূরান্ত থেকে সড়কপথ ও রেলপথে যারা ঢাকায় ফিরেন তারা অনেকটা আতঙ্ক নিয়েই গন্তব্যে পৌঁছান। কারণ শহরের বাস টার্মিনাল ও রেলওয়ে স্টেশনকে ঘিরে পেশাদার ছিনতাইকারীরা ওত পেতে থাকে। সুযোগ পেলেই তারা যাত্রী ও পথচারীদের টার্গেট করে ছিনতাই করে। অস্ত্রধারী এসব ছিনতাইকারীদের বাধা দিলেই ছুরিকাঘাত করে। শুধু বাস টার্মিনাল ও রেলওয়ে স্টেশন ঘিরে নয় সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় ছিনতাইকারী বেড়ে যাওয়াতে শহরের বিভিন্ন অলিগলিতেও এখন ছিনতাইকারীরা ওত পেতে থাকে। ঢাকার ৫০টি থানার সবক’টি এলাকাতে এখন ছিনতাই আতঙ্ক। প্রতিরাতেই অহরহ মানুষ ছিনতাইয়ের শিকার হন। বেশির ভাগ মানুষ ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও মূল্যবান জিনিসপত্র হারিয়েও পুলিশের সহযোগিতা নিতে চান না। ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে শুধুমাত্র থানায় হারানো জিডি করেন। তবে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনায় ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ দেন। যারা অভিযোগ দেন তাদের বিষয়টি থানায় রেকর্ডেড থাকে। তাই ভুক্তভোগীরা থানায় মামলা ও অভিযোগ না দেয়াতে প্রকৃতপক্ষে ঢাকায় কি পরিমাণ ছিনতাই হয় তার পরিসংখ্যান খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে ঢাকায় কি পরিমাণ ছিনতাই স্পট আছে তার হিসাব পাওয়া গেছে। র্যাব সদর দপ্তর জানিয়েছে, ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় তারা ২৭৯টি ছিনতাই স্পট শনাক্ত করেছে। এরমধ্যে র্যাব-১ এর আওতাধীন এলাকায় ৪১টি, র্যাব-২ এলাকায় ৭৯টি, র্যাব-৩ এলাকায় ২৪টি, র্যাব-৪ এলাকায় ৬২টি ও র্যাব-১০ এর আওতাধীন এলাকায় ৭৩টি স্পট রয়েছে।
যদিও ঢাকা মহানগর পুলিশের থানা, গোয়েন্দা পুলিশ ও র্যাব সদর দপ্তর বলছে, ছিনতাই প্রতিরোধে গুরুত্ব সহকারে কাজ করা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ছিনতাই স্পট শনাক্ত, পেট্রোলিং করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর মেরুল বাড্ডা ও গুলশানে তিনজনকে ছুরিকাঘাত করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এতে এক মোটরসাইকেল আরোহী ও দুই রিকশা আরোহী আহত হয়েছেন। তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, গুলশান-২ নম্বরে রাত ৯টার দিকে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আব্দুল কাদের শিকদার এবং আমির হামজা আহত হন। আহত কাদের শিকদার নড়াইলের নড়াগাতী থানার খাসিয়াল গ্রামের মোস্তফা শিকদারের ছেলে। তিনি মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী। আর আহত আমির হামজা যশোরের কেশবপুর থানার সাগরদাঁড়ি গ্রামের এরশাদ সরদারের ছেলে। স্বজনরা জানিয়েছেন, রাত নয়টার দিকে মোটরসাইকেলে গুলশান-২ নম্বরে মার্কেটের সামনে আসার পর কয়েকজন তাদের গতিরোধ করে। পরে লোহার রড ও ছুরি মেরে তাদের রাস্তায় ফেলে চলে যায়। আশপাশের লোকজন তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। আহত কাদের শিকদারের ছোট ভাই মিন্টু শিকদার জানান, অজ্ঞাত ওই লোকেরা তার ভাইয়ের কাছে থাকা নগদ ২৫ হাজার ডলার, ২০ হাজার ইউরো এবং ৮০ লাখ নগদ টাকা নিয়ে যায়। এ ছাড়া মঙ্গলবার রাতে মেরুল বাড্ডার আনন্দনগরে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে টিপু মিয়া নামের এক যুবক গুরুতর আহত হয়েছেন। পরে রাত আড়াইটার দিকে তাকে ঢামেকে’র জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়। টিপু মেরুল বাড্ডা এলাকায় এক ব্যক্তির প্রাইভেটকারের চালক। রাত সাড়ে ১২টার দিকে মেরুল বাড্ডার আনন্দনগর এলাকা দিয়ে রিকশায় বাসায় ফিরছিলেন। এ সময় পথে ওত পেতে থাকা ছিনতাইকারী তার পথরোধ করে। একপর্যায়ে তার বুক ও পিঠে ছুরিকাঘাত করে কাছে থাকা নগদ ২৮ হাজার টাকা এবং একটি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে রাজধানী এবং এর উপকণ্ঠে ৪৩২টি ছিনতাইয়ের স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। এই স্পটগুলোতে কমপক্ষে ৯৭৯ জন ছিনতাইকারী সক্রিয় এবং তাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন থানায় দায়ের করা ফৌজদারি মামলার আসামি। ২০২৪ সালের শেষ চার মাসে রাজধানীতে বিশেষ অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অভিযানে ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত ৮৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরে ২৩ জন, অক্টোবরে ৯১ জন, নভেম্বরে ১৪৮ জন এবং ডিসেম্বরে এই সংখ্যা ছিল ৫৬৪ জন। প্রতিবেদন অনুসারে, ডিএমপি’র মতিঝিল বিভাগের অধীনে খিলগাঁও, ওয়ারি ডিভিশনে কমপক্ষে ২১২ জন ছিনতাইকারী সক্রিয়। মিরপুর ও তেজগাঁও বিভাগে প্রায় ৩৮৬ জন, রমনা ও লালবাগ বিভাগে ২১৭ জন এবং উত্তরা ও গুলশানে ১৫৪ জন ছিনতাইকারী সক্রিয়। তালিকায় উঠে এসেছে মোহাম্মদপুর এলাকায় সবচেয়ে বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনার কথা। তালিকা অনুসারে, মোহাম্মদপুর থানার আওতাধীন এলাকায় ২০৫ জন ছিনতাইয়ের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। এ ছাড়া মোহাম্মদপুরে সবচেয়ে বেশি ১০৮টি ছিনতাইয়ের স্পট রয়েছে। যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ এবং মীরহাজিরবাগকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ছিনতাই এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে মাদকাসক্ত ছিনতাইকারীরা প্রায়শই মোবাইল ফোনের জন্য মানুষজনকে টার্গেট করে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মুনীম ফেরদৌস মানবজমিনকে বলেন, ঢাকায় যেসব এলাকায় বেশি ছিনতাই হয় সে সমস্ত স্পটগুলো আমরা শনাক্ত করেছি। যে সময় ছিনতাই হয় ওই সময় আমাদের টহল ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আমরা গত কয়েকদিনে ঢাকা থেকে ১১৭ জন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছি। এ ছাড়া পুরনো ছিনতাইকারীদের পাশাপাশি নতুন ছিনতাইকারীদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ, নজরদারি রাখছি। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম ও অপারেশন) এস এন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা ছিনতাই রোধে সব ধরনের কাজ করছি। নিয়মিত পেট্রোলিং করছি। পেট্রোল ঠিকমতো কাজ করে কিনা সেটাও দেখছি। ছিনতাই কমে গিয়েছিল কিন্তু মঙ্গলবার রাতে কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেছে। আশা করি, ঢাকায় ছিনতাই কমে যাবে। আমরা কাজ করছি। মানবজমিন ডেস্ক।