বিশ্বজিৎ ঘোষ
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে, ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, বাংলা একাডেমি চত্বরে মুক্তধারার স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা চাটাই বিছিয়ে যে বইমেলার সূত্রপাত করেছিলেন, অর্ধশতাব্দীরও অধিককালের ব্যবধানে আজ তা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির অনিবার্য এক উপাদানে পরিণত। বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশের বইমেলা শুধু বই বেচাকেনার মেলা নয়; এই মেলা বাঙালির আবেগ আর সংরাগ, দ্রোহ আর প্রতিবাদ, সংঘচেতনা আর মাতৃভাষাপ্রীতিরও অনন্য এক মেলা। মানুষের সঙ্গে মানুষের সংঘবাসনায় মুখর থাকে একুশের বইমেলা। একুশের বইমেলা আমাদের সংস্কৃতির উজ্জ্বল এক উত্তরাধিকার, বাঙালি জাতিসত্তার আত্মপরিচয়ের উল্লেখযোগ্য এক অনুষঙ্গ।
এই সূত্রেই ফ্রাংকফুর্ট-লন্ডন-কলকাতা বইমেলার সঙ্গে একুশের বইমেলার সাদৃশ্যের চেয়ে অনন্যতাই বেশি। একুশের বইমেলার অন্তরে আছে দ্রোহের আগুন, আছে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার আবেগ, আছে বিচ্ছিন্নতা আর খণ্ডতার সীমানা পেরিয়ে অখণ্ড সংঘসত্তায় জেগে ওঠার আহবান। একুশের বইমেলার প্রত্ন আবেদনে আছে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনা।
পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় বিচ্ছিন্নতা-বিযুক্তি আর নিঃসঙ্গতা-নির্বেদ ক্রমে প্রবল হয়ে উঠছে।
মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, আন্তর্মানবিক বন্ধন একালে হয়ে গেছে ছিন্ন। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বা সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সটাই হয়ে উঠেছে একালের প্রধান কুললক্ষণ। একালে সমাজের সঙ্গে ব্যক্তিমানুষের কোনো সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক নেই প্রেম-প্রকৃতি-পরিবারের সঙ্গেও—এমনকি নিজের সঙ্গেও। সর্বগ্রাসী এক বিচ্ছিন্নতার গ্রাসে ক্রমবিপন্ন সমকালীন মানবসমাজ।
বাংলা একাডেমির বইমেলা সামাজিক এই প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রবল এক প্রতিবাদ। শুধু বই কেনার জন্য একুশের বইমেলায় মানুষ আসে না; মানুষ আসে অন্য মানুষের সান্নিধ্য পেতে, আড্ডা জমাতে, চা খেতে, গল্প করতে—কখনো বা দল বেঁধে এক দোকান থেকে অন্য দোকানে ঘুরতে। লেখকের সঙ্গে পাঠকের এখানে দেখা হয়, দেখা হয় প্রকাশকের সঙ্গেও। একুশের বইমেলার সঙ্গে লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের একটা উন্মাদনা জড়িত থাকে—এ কথা অস্বীকার করি কিভাবে? অপশক্তির আঘাত এসেছে বইমেলায়, আক্রান্ত হয়েছেন লেখক কিংবা প্রকাশক, কখনো রুদ্ররূপে ধেয়ে এসেছে প্রকৃতি, লণ্ডভণ্ড হয়েছে সব আয়োজন, তবু বইমেলা দিনে দিনে সমৃদ্ধ হয়েছে, বেড়েছে তার পরিসর, লাভ করেছে জাতীয় পরিচয়। দেশের ভূগোল ছাড়িয়ে একুশের বইমেলার কথা এখন বিশ্বসংস্কৃতিতেই জানান দিচ্ছে তার স্বকীয় অস্তিত্ব।
লেখক-পাঠক-প্রকাশকের আনন্দ-আবেগ-আকাঙ্ক্ষা আর সাংবৎসরিক উন্মাদনাই সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে একুশের বইমেলাকে নিয়ে গেছে সামনের দিকে। আমাদের সম্মিলিত জাতীয় চেতনাই এ ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে চলেছে। একুশের বইমেলা সদর্থক জীবনের কথা বলে, সম্প্রীতিঋদ্ধ মানবসম্পর্কের কথা বলে, প্রগতির কথা বলে। সব কিছুই আমাদের সম্মিলিত জাতীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশ। বইমেলায় সেইসব বইই পাঠকের জন্য আনা হয়, কোনো না কোনো সূত্রে তা ওই সম্মিলিত জাতীয় চেতনাকেই প্রতিনিধিত্ব করে। পৃথিবীর অন্য কোনো বইমেলায় এমন বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার পেছনে বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চেতনা ছিল ক্রিয়াশীল। বলা যেতে পারে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেরই প্রত্যক্ষ ফল একাডেমি। তাই বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশের বইমেলা মাতৃভাষা বাংলার প্রতি আমাদের ভালোবাসা জাগ্রত করে, জাগ্রত করে অন্যদের মাতৃভাষার প্রতিও আমাদের শ্রদ্ধাবোধ। আর লক্ষ করার বিষয় যে বইমেলার নাম ‘একুশের বইমেলা’। পৃথিবীর প্রধান প্রধান বইমেলা স্থানের নামেই পরিচিত, কিন্তু আমাদের বইমেলা একেবারে ভিন্ন। বইমেলার আগে ‘একুশের’ শব্দ আমাদের বইমেলার শরীরে ও সত্তায় জড়িয়ে দেয় অনন্য এক সাংস্কৃতিক সত্তা, জড়িয়ে দেয় জাতিগত এক প্রতিরোধের অগ্নিপতাকা।
বর্তমান যুগ পণ্যায়নের যুগ—এ যুগে সব কিছুই পণ্যে পর্যবসিত। বইমেলায় আসা বইও কি পণ্যায়নের বাইরে আছে? এ প্রশ্নেই একুশের বইমেলা ভিন্ন এক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে। পণ্যায়নের প্রভাব তো এড়ানো যাবে না, তবু লক্ষণীয়—একুশের বইমেলায় জ্ঞান কিংবা সৃজনশীল, যে ধারারই বই হোক না কেন, সেখানে প্রাধান্য পায় সদর্থক জীবনচেতনা, ঋদ্ধ মননশীলতা। এ প্রসঙ্গে আমাদের আরো কিছু কথা থেকে যায়। শুধু পণ্য নয়, একুশের বইমেলায় বই প্রকাশিত হোক মনন বিকাশের জন্য, বই প্রকাশিত হোক নতুন জ্ঞান সৃষ্টির জন্য, বই প্রকাশিত হোক পাঠকচিত্তে সৃষ্টিশীল ভাবনার খোরাক হয়ে। এ ক্ষেত্রে আমাদের লেখক ও প্রকাশকদের ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। এ কথা সবাই স্বীকার করবেন যে বাংলাদেশে এখন বেশির ভাগ বই প্রকাশিত হয় একুশের বইমেলাকে উপলক্ষ করে। মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশের কারণে অনেক সময়ই প্রকাশের শুদ্ধতা ও সৌকর্যের দিকে প্রত্যাশিত যত্ন নেওয়া যায় না। বইকে পণ্য বানানোর কারণে মেলায় বইয়ের সংখ্যাও কম হয় না। বেশির ভাগ বইয়েই সম্পাদনার কোনো নামগন্ধ থাকে না। এদিকে একাডেমি কর্তৃপক্ষকে যেমন নজর দেওয়া দরকার, তেমনি সতর্ক হওয়া দরকার লেখক ও প্রকাশককে। লেখাই বাহুল্য যে রুচিশীল ও মানসম্পন্ন বই আমাদের বইমেলাকে আরো বিকশিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
আরেকটা উৎপাতের কথা এখানে না বললেই নয়। একুশের বইমেলা উপলক্ষে কিছুসংখ্যক মৌসুমি লেখকের দেখা পাওয়া যায়। তাঁরা থাকেন প্রবাসে, অর্থ উপার্জন করেন দুহাতে। তাই একটা কিছু লিখে যাচ্ছেতাইভাবে প্রকাশ করার জন্য পাণ্ডুলিপি আর টাকার প্যাকেট দেন কোনো কোনো প্রকাশককে। ব্যস, বেরিয়ে গেল বই। কোথায় ভাষিক শুদ্ধতা, কোথায় সম্পাদনা, কোথায় গ্রন্থনকশা? বলতে গেলে কিছুই নেই, শুধু আছে নতুন একখানা বই। এসব বই আমাদের মেলার উত্তরাধিকারকে বিনষ্ট করে। প্রবাসী লেখকরা যত্ন করে বই লিখবেন, প্রকাশের মানের সঙ্গে আপস করবেন না—এমনটা তো আমরা আশা করতেই পারি।
একুশের বইমেলা উপলক্ষে প্রতিবছর অনেক নতুন লেখকের সৃষ্টির সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। তরুণ ও নবীন লেখকরা আমাদের সংস্কৃতির আগামী দিনের সৈনিক। বইমেলা যে তাঁদের সামনে নিয়ে এলো—এও বইমেলার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। দেখা গেছে, অনেক নতুন লেখকই এভাবে জাতীয়ভাবে মূলধারায় আসন পেয়েছেন। বইমেলা উপলক্ষে নতুন লেখকের আবেগ-উচ্ছ্বাস-উন্মাদনা বিশেষভাবে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। এই লক্ষণ একটি সৃষ্টিশীল ও মননঋদ্ধ জাতি গঠনে ইতিবাচক ও দূরসঞ্চারী ভূমিকা পালন করতে পারে বলে আমি মনে করি। সৃজনশীল সংস্কৃতি বিকাশের অন্যতম এক শক্তি উৎস। তাদের হাত ধরেই ক্রমিক বছরে আমরা প্রত্যক্ষ করি নতুন নতুন লেখকের আবির্ভাব।
পাঠক সৃষ্টিতে একুশের বইমেলা অর্ধশতাব্দীরও অধিককাল ধরে পালন করে চলছে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা। তরুণসমাজকে গ্রন্থমুখী করতে এই মেলার অবদান অপরিসীম। জ্ঞান ও সংস্কৃতিঋদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠায় এভাবেও একুশের বইমেলার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। শুধু লেখক-পাঠক-প্রকাশকই নন, প্রকাশনাশিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পী। দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদও তো একটা দেশের সাংস্কৃতিক মানের পরিচায়ক। সেই সূত্রেও মেলার রয়েছে স্বতন্ত্র এক চারিত্র্য। কেননা প্রতিবছর মেলা উপলক্ষে হাজার হাজার বই প্রকাশিত হয়, প্রকাশিত হয় হাজার হাজার প্রচ্ছদ। এইসব প্রচ্ছদ আমাদের চিত্রশিল্পেও সংস্কৃতির ভিন্ন এক মাত্রা। বই প্রকাশ, বই বাঁধাই, বই বিপণন—সব মিলে একুশের বইমেলা বিরাট এক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। অর্থের সচলতাও এই মেলার সংস্কৃতিগত উত্তরাধিকারের স্বতন্ত্র এক মাত্রা।
একুশের বইমেলা বাংলাদেশের অহংকার—বাঙালির অহংকার। এই অহংকার আরো ব্যাপকতা লাভ করে মেলা উপলক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। সেমিনার হয়, লেখকরা কথা বলেন, পাঠক বিতর্কে মেতে ওঠেন—সব কিছু মিলে গোটা একটা মাস কী ঘোরে যে কেটে যায়! একুশের বইমেলা দিনে দিনে বিস্তৃত হোক, হোক আমাদের জাতিসত্তার গৌরবদীপ্ত উত্তরাধিকার—এই আমাদের আন্তরিক কামনা।