সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
বইমেলাটা সত্যিকার অর্থে যেন জনসমাগম হয়। সবাই যেন বই কেনে। শুধু ঘুরেফিরে চলে যায়। এটা কিন্তু বইমেলার প্রধান লক্ষণ নয়।
পৃথিবীর অনেক বইমেলায় গেছি। সেখানে প্রত্যেকটা মানুষ কোনো না কোনো বই কিনছে। অথবা তিনজনের মধ্যে একজন বই কিনছে। আমাদের তো দশজনের মধ্যে একজনের হাতেও বই দেখি না।
মানুষ যদি বই কেনে, পাঠক যদি বই কেনে, তাহলে প্রকাশনাশিল্পটা কিছুটা সমৃদ্ধ হবে। আর বইয়ের তো একটা সংস্কৃতি আছে। সেই সংস্কৃতিটা বিকশিত হতে পারবে। আমাদের বইমেলার ঐতিহ্য ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক হয়ে গেছে।
সেটা ভালো না মন্দ সেদিকে আমি যাচ্ছি না। কিন্তু যেহেতু ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক বইমেলার যে প্রকাশনা, সেখানে যদি বই বিক্রি হয় তাহলে প্রকাশকদের জন্য সুবিধা হয়। যদি ভালো ভালো বই প্রকাশ করা হয়, যদি ভালো কাটতি হয়, তাহলে সেটা আমাদের জন্যও চমৎকার হবে। তবে আমাদের বইমেলা বেশ দীর্ঘদিন ধরে চলে। কলকাতার দশ দিনের বইমেলায় যে পরিমাণ বই বিক্রি হয়, তার ধারেকাছেও আমাদের বই বিক্রি হয় না।
কারণ পাঠকবান্ধব একটি মেলা এবং পাঠকরা তার প্রধান পৃষ্ঠপোষকতা করে।
শ্রীলঙ্কায় দেখেছি, বইমেলা চার কি পাঁচ দিনের হয়। সেখানেও বই নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়। বইয়ের মধ্যে মানুষ ডুবে থাকে ওই কদিন। শ্রীলঙ্কায় যেমন ইংরেজি বই প্রকাশ করা হয়, তেমনি সিংহলি, তামিল বইও প্রকাশ করা হয়। সেগুলো মানুষ খুব কেনে। অথচ ওখানে মানুষের সংখ্যা কিন্তু আমাদের চেয়ে অনেক কম। তবে শিক্ষিত মানুষ অনেক বেশি। তাদের যে পরিমাণ ভালোবাসা বইয়ের প্রতি দেখেছি, সেটি বলার নয়। শ্রীলঙ্কায় গল নামের একটি শহর আছে। একদম দক্ষিণে। সেখানের ফেস্টিভালে আমি গিয়েছিলাম একজন বিচারক হিসেবে। আমি খুবই অবাক হয়েছি যে কী পরিমাণ ভালোবাসা মানুষের বইয়ের প্রতি! বই নিয়ে তাদের কত যে আলোচনা! জ্ঞানঋদ্ধ আলোচনা। তার মানে, তারা একটি শিক্ষিত সমাজ। এটিই আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। আমরাও পারি। আমাদের এখানেও কত দারুণ দারুণ প্রবন্ধ, ছোটগল্প লেখা হচ্ছে! তবে লেখক-পাঠকের একটা সংযুক্তির জায়গায় একটু ফাঁক রয়ে গেছে। যেখানে কুড়ি হাজার বই বিক্রি হওয়া উচিত, সেখানে হয়তো একজন লেখকের দু-তিন শ বই বিক্রি হয়। আমাদের এখানে তরুণ অনেক ভালো লেখক আছেন, যাঁদের আমি খুবই পছন্দ করি। তরুণ-প্রবীণ মিলে আমাদের সমৃদ্ধ কথাসাহিত্য, কবিতা, নাটকের বই। তবে বইয়ের সেই রকম কাটতি নেই। এই দিকটা নিয়ে আমাদের আরো ভাবতে হবে বলে আমি মনে করি। এ ছাড়া কিভাবে স্কুল-কলেজে বইমেলাকে নিয়ে যাওয়া যায়, সেটিও ভাবতে হবে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় মেলা করল, সেখানে প্রচুর সাড়া মিলেছে। তার মানে, সারা দেশেই প্রচুর পাঠক আছে। তাদেরকেও আমাদের টেনে আনতে হবে।
বই নিয়ে সত্যিকার অর্থে আলোচনা হওয়া উচিত। ঘটা করে, বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রকাশকরা প্রতিদিনই বই আলোচনার ব্যবস্থা করতে পারেন। কেননা পাঠকের সঙ্গে লেখকের যোগসূত্র তৈরি করাও একটা বড় কাজ। এখানে পুরস্কারের ব্যবস্থাও থাকতে পারে। যিনি সেরা প্রশ্ন করলেন, তাঁকে পুরস্কার হিসেবে বই দেওয়া যেতে পারে। বইয়ের ইতিহাস নিয়ে ছোট ছোট প্রর্দশনী হতে পারে। বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য, ছাপাখানা, কথাসাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে প্রদর্শনী হতে পারে। বইয়ের নানা সমস্যা নিয়ে ছোট করে সেমিনার হতে পারে। তারপর নামকরা সাহিত্যিকরা এসে তাঁদের রচনা পাঠ করতে পারেন। আমাদের জনপ্রিয় লেখকদের নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আগে থেকেই মানুষকে সচেতন করে যদি আয়োজনটা করা হয়, তাহলে লেখক-পাঠক সবার সঙ্গে একটা যোগসূত্র তৈরি হবে। মানে বই নিয়েই একটা হৈচৈ হতে পারে। বইয়ের প্রচারটা শুধু কয়েকজন নামকরা সাহিত্যিককে ঘিরে হওয়া উচিত নয়। তরুণদেরও সেসব জায়গায় রাখতে হবে। এ ছাড়া আমি মনে করি, কারো বই নিষিদ্ধ করাটা একেবারেই অপ্রয়োজনীয় একটি বিষয়। এটি পাঠকের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। পাঠক যদি তাঁর লেখা পড়তে চায় তো পড়বে। বই হলো জ্ঞানচর্চার বিষয়। যেকোনো বইই একটা নতুন পৃথিবীর সন্ধান দেয়। আমি সাহিত্যের ছাত্র, সাহিত্যের অধ্যাপক, সাহিত্য ভালোবাসি। আমি বই নিষিদ্ধ করার পক্ষে নই। বিভিন্ন মত নিয়েই তো একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা পায়। সেই মতগুলোর অধিকার থাকে প্রকাশ করার; যদি না কাউকে ছোট করার জন্য, বিদ্রুপ করার জন্য সেটি হয়ে থাকে। কোনো লেখক যদি দুর্বল কিছু লিখে থাকেন, সেটির বিচার পাঠক করবে। এর বিচার আর কেউ করতে পারে না।