বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে ১১টি রপ্তানিমুখী বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতের
বেক্সিমকো শিল্প পার্কের লে-অফে থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হবে ১২টি; আর তালিকাভুক্ত বেক্সিমকো ফার্মা ও শাইনপুকুর সিরামিকের বন্ধকি শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত ‘বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের শ্রম ও ব্যবসায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সভায় নেওয়া পাঁচটি সিদ্ধান্তের মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলোর কর্মীদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হবে।
মঙ্গলবার সচিবালয়ে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সভার পর শ্রম মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ শাখা থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এসব সিদ্ধান্ত জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অপরদিকে আগামী রোববার বিএসইসিসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো বৈঠক করে তালিকাভুক্ত বেক্সিমকো ফার্মা ও শাইনপুকুরের বন্ধকি শেয়ার বিক্রির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এছাড়া কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করায় বর্তমানে দায়িত্বরত বেক্সিমকোর ‘রিসিভারকে’ বরখাস্থ করাসহ বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অবস্থিত বেক্সিমকো শিল্প পার্কের যে ১২টি কোম্পানি বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে ১১টি রপ্তানিমুখী বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতের।
এদিনের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ বিতরণে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না, তা দেখবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে বেক্সিমকো শিল্প পার্কের কোম্পানিগুলোর বিষয়ে গঠিত এ কমিটি ছয়টি সভা করল। এরমধ্যে সবশেষ সভায় পাঁচটি সিদ্ধান্ত নেয়। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব সিদ্ধান্ত তুলে ধরা হয়। সেগুলো হল-
>> বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের লেঅফকৃত কোম্পানিগুলো কর্তৃপক্ষ বন্ধ করবে। শ্রম আইনের অধীনে শ্রমিকদের আইনানুগ পাওনাদি ফেব্রুয়ারির মধ্যে কর্তৃপক্ষ পরিশোধ করবে মালিকপক্ষ। এই বিষয়ে সরকার প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেবে।
>> বেক্সিমকোর লেঅফ করা কোম্পানিগুলো বন্ধের প্রক্রিয়া নিয়ে উপদেষ্টা কমিটির সিদ্ধান্ত টিভি স্ক্রলে পাঠানোর ব্যবস্থা না নেওয়ায় অর্থাৎ কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করায় রিসিভারকে বরখাস্তসহ বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক।
>> রিসিভার পরিবর্তনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
>> বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের কোম্পানিগুলোকে কিসের ভিত্তিতে ঋণ দেওয়া হয়েছে এবং তাতে কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে ফরেনসিক অডিটসহ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তদন্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভাগীয় ও আইনি পদক্ষেপ নেবে।
>> পার্কের কোম্পানিগুলোর বিষয়ে আগামী রোববার বিএসইসি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট সব ব্যাংক সভা করে বেক্সিমকো ফার্মা ও শাইনপুকুর লিমিটেডের বন্ধক করা শেয়ার বিক্রির বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে অর্থ বিভাগ।
মঙ্গলবারের বৈঠকে শ্রম উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন, অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন, শিল্প ও পূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান, অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান খান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে জানানো হয়, বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে থাকা কোম্পানির শ্রমিক-কর্মচারীদের ৫ মাসের বেতন বাবদ ২২৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকার জোগান দেয় সরকার।
এর বাইরে অর্থ বিভাগ ৫০ কোটি টাকা এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে ১০ কোটি টাকা সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হয়। সরকারের সিদ্ধান্তে বেক্সিমকোর অনুকূলে অবশিষ্ট অর্থ ঋণ আকারে জোগান দেয় বিভিন্ন ব্যাংক।
২০২৪ সালে ক্ষমতার পালাবদলের পর অক্টোবর ও নভেম্বরে বকেয়া বেতনের দাবিতে কয়েক দফা বিক্ষোভ কর্মসূচিও পালন করেন বেক্সিমকোর শ্রমিক-কর্মচারীরা।
এরপর অন্তর্বর্তী সরকার ২৪ নভেম্বর বেক্সিমকো শিল্প পার্কের বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে ১১ সদস্যের একটি কমিটি করে দেয়।
‘বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রম ও ব্যবসায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি’র প্রধান করা হয় উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেনকে।
২৮ নভেম্বর প্রথম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জনতা ব্যাংক থেকে বেক্সিমকো পার্কের শ্রমিক-কর্মচারীদের তিন মাসের বকেয়া বেতনের ব্যবস্থা করা হয়।
গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত শ্রম মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত সভা শেষে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ২০২৫ সালের জানুয়ারির বেতন উপদেষ্টা পরিষদের পরবর্তী সিদ্ধান্তের আলোকে দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে।
বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস-চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা। তিনি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর থেকে গ্রুপটির দৈনন্দিন কাজ পরিচালনায় বিঘ্ন তৈরি হয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে গত ২৩ জানুয়ারি একদল শ্রমিক ও কর্মচারী নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন বেক্সিমকো গ্রুপের হেড অব এডমিন আব্দুল কাউয়ুম। তিনি বলেন, ‘‘বেক্সিমকোর রিসিভার নিয়োগ দেওয়ার পর থেকে সম্পদের একটি হিসাব করা হয়। কারখানা, মেশিন, জমিসহ বর্তমানে সব সম্পদ বিক্রি করলে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু শ্রমিক-কর্মচারিদের বিদায় দিতেই লাগবে ২২ হাজার কোটি টাকা।’’
তার ভাষ্য, সরকার সহযোগিতা করে কারখানা খুলে দেওয়ার পর পরিচালন খরচ বাদ দিলে প্রতিবছর সাড়ে ৪০০ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে।
অর্থের সংকটে কিছু কারখানা লে-অফ ঘোষণা করা হলেও সচল আছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, শাইনপুকুর সিরামিকস ও বেক্সিমকো লিমিটেড।
এছাড়া বেক্সিমকো পিপিই লিমিটেড এবং আর আর ওয়াশিং লিমিটেড চালু রয়েছে বলে মঙ্গলবারের সভায় তুলে ধরা হয়। বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে এক বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করা শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা ২৭ হাজার। এক বছরের নিচে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে তা ৪২ হাজারর মত।
আগামী ৩১ জানুয়ারি কারখানা লে-অফ রাখার সবশেষ শেষ দিন। এপর আইন অনুযায়ী আরো ১৫ দিন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। মঙ্গলবারের সভার পর শ্রম মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সভায় বেক্সিমকো গ্রুপের সার্বিক বিষয় ও আর্থিক তথ্য সারসংক্ষেপে তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, শিল্প পার্কে ৩২টি কারখানা বা কোম্পানি থাকার তথ্য রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ১৬টির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
অস্তিত্ব না থাকা ১৬টির নামে ঋণের পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকা। আর সব মিলিয়ে ৩২ কোম্পানির নামে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়া হয় ২৯ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা।
চালু থাকা আরেক তালিকাভুক্ত বেক্সিমকো (বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি ) লিমিটেডের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। এই কোম্পানি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। কোম্পানিটি গত পাঁচ বছরের আর্থিক প্রতিবেদনের ওপর বিশেষ নিরীক্ষা চালাতে বিএসইসি নিরীক্ষক চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে।
বেক্সিমকো গ্রুপের ৩৩ প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৬৯ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৩ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেক্সিমকো ফার্মার ঋণ রয়েছে ৬০২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। আর শাইনপুকুর সিরামিকসের ঋণ ৯৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।