।। মহিউদ্দিন মোহাম্মদ ।।
“পাকিস্তান মানে কী? আপনি বলবেন দেশের নাম। নো, নেভার। বাংলা ভাষায় ‘পাকিস্তান’ কোনো দেশের নাম নয়। বাংলাদেশ যে যে কারণে স্বাধীন হয়েছিলো, বাঙালির জাতিমূল ও সংস্কৃতির যে-মৃত্যুচিত্র ভুট্টোবাহিনী অঙ্কন করেছিলো, তার সামষ্টিক প্রতীকের নাম ‘পাকিস্তান’। কালেক্টিভ সিম্বল অভ হোয়াট উই ফট অ্যাগেইন্সট। ‘পাকিস্থানপন্থী’-র অর্থ এটা নয় যে আপনি পাকিস্তান নামক দেশকে ভালোবাসেন, তার ক্রিকেট খেলা ও কাওয়ালী পছন্দ করেন। বরং শব্দটির গভীর রাজনীতিক তাৎপর্য আছে। আব্দুল আলী পাকিস্থানপন্থী, এটি দিয়ে বোঝায়, যে-কারণগুলো বাংলাদেশকে স্বাধীন হতে বাধ্য করেছিলো, আব্দুল আলী সে-কারণগুলোর পুনর্জীবন চাচ্ছে। বাঙালির জাতিমূল, কালচার-কৃষ্টি, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা, বাকস্বাধীনতা, এগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাচ্ছে।
সুতরাং ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ একপ্রকার গাট্টি-বোঁচকা। এর ভেতর লুকিয়ে আছে অনেক কিছু। মৌলবাদ, উগ্রবাদ, আস্কারাবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবাদ, একধর্মবাদ, নারীদমনবাদ, ইসলামবাদ, সবই ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’-এর অংশ। ‘পাকিস্তান’ শব্দের অংশ।
আমি কেন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’-কে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’-এর সমতুল্য বললাম? হাবাগোবা সরল অর্থের আড়ালে গোপন আসল অর্থ আবিষ্কার করলাম? কারণটি স্পষ্ট। যারা এ শ্লোগান বাজারে ছেড়েছে, তাদের কার্যক্রম দেখলেই এটি বোঝার কথা।
দেশে কী কী ঘটছে? কী কী ঘটতে দেওয়া হচ্ছে? সাধারণ অপরাধ এক জিনিস, ধর্মসন্ত্রাস অন্য জিনিস। মাজার ভাঙা, বাউলমেলায় বাধা, নারী ফুটবলে বাধা, বইমেলায় হামলা, গানের অনুষ্ঠানে বাধা, রোজায় হোটেলবন্ধবাহিনীর আবির্ভাব, এগুলো পরিষ্কারভাবে ধর্মসন্ত্রাস। ইনকিলাব জিন্দাবাদবাহিনী কি এগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে? সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে? নেয় নি। উল্টো আস্কারা দিয়েছে। ঘাইঘুই করে মৌন সম্মতি দিয়েছে। নিরব থেকেছে।
আপনার শ্লোগান কী অর্থ বহন করে, এটা শ্লোগানের শব্দ দ্বারা নির্ধারিত হয় না। শ্লোগানদাতার আচরণই বড় অর্থ। গোপন সুপ্ত উদ্দেশ্যই প্রধান অর্থ। শ্লোগানটি ভগৎ সিং দিয়েছিলো নাকি চগৎ সিং দিয়েছিলো, তা বিবেচ্য বিষয় নয়। ইনকিলাবীরা ইনকিলাব শব্দের স্পিরিট ধারণ করলে দেশের এই লেজেগোবরে অবস্থা হতো না। পাকিস্তানবাদ মাথাচাড়া দিতো না। যারা ডিকশোনারি মিনিং ও হিস্ট্রিক্যাল বিলংগিং দেখে শব্দের অর্থ নির্ণয় করতে চান, ভুজুংভাজুং বোঝাতে চান, তারা ধুরন্ধর লোক। অথবা মগজশূন্য বল্টুবাহিনীর সদস্য।
মনে পাকিস্তানবাদের গাট্টি-বোঁচকা, মুখে ভগৎ সিংয়ের শ্লোগান, এ ধোঁকা আমরা ধরতে পারবো না, এটা ভাবাই তো অডাসিটি। যে-দেশে টাওয়াল দেখিয়ে গামছা গছিয়ে দেওয়া হয়, সে-দেশে ইনকিলাব জিন্দাবাদ দেখিয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদ গছানোর রাজনীতি চলবে, এ সন্দেহ জনগণ করবে না কেন? আমার ইন্টেরপ্রিটেশন এটাই। এখন কেউ যদি চায় যে, না, ইনকিলাব জিন্দাবাদ দিয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বোঝাবো না, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক বোঝাবো, ভগৎ সিং বোঝাবো, তাহলে আপনাকে সৎ মনে বাংলাদেশপন্থী কাজ করে দেখাতে হবে। প্রকাশ্যে পাকিস্তানবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। অন্যথায় ইনকিলাব জিন্দাবাদের গোপন অর্থ পাকিস্তান জিন্দাবাদ, এটাই সত্য। প্রকাশ্য ডিকশোনারি মিনিং আমরা বিশ্বাস করবো না। ভোটও দেবো না। কাউকে চোখ বুজে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।” ৩ মার্চ ২০২৫)