।। হুমায়ুন আজাদ ।।
“তিনটি রুপকপ্রতীক পেয়েছিলাম আমরা একাত্তরের মার্চে। একটি জাতীয় সঙ্গীত-‘আমার সোনার বাঙলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’, যেটি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কাব্যসৌন্দর্যমণ্ডিত জাতীয় সঙ্গীত, যাতে কোনো উগ্রতা নেই, আছে শুধু প্রকৃতিপ্রেম; দ্বিতীয়টি এক অপূর্ব জাতীয় পতাকা, যাতে ছিলো সবুজের মাঝে সূর্যের মধ্যে বাঙলাদেশের মানচিত্র, তৃতীয়টি হৃদয় কাঁপানো স্বদেশ জাগানো শ্লোগানঃ ‘জয় বাঙলা’। এ-তিনটি রূপকপ্রতীক দিয়ে মার্চ ও তার পরের মাসগুলো আলোড়িত ও মুখরিত ছিলো; এগুলো ছিলো পুরোপুরি পাকিস্তানি চেতনার বিপরীত, এবং আবেগ ও শৈল্পিকভাবে অনেক উৎকৃষ্ট।
‘পাকসারজমিন সাদবাদ’-এর পাশে ‘আমার সোনার বাঙলা’, আমি তোমায় ভালোবাসি’, চানতারার পাশে সূর্যের ভেতরে বাঙলাদেশের মানচিত্র ছিলো চেতনাগত ভাবে ভিন্ন ও শৈল্পিক; আর ‘জয় বাঙলা’ শ্লোগানটি ছিলো বাঙালির হৃদয়ের উল্লাসের মতো।
জনগণ সাধারণত, প্রাত্যহিক জীবনে, খড়কুটো বা নিস্তরঙ্গ জলরাশি বা ঘুমিয়ে থাকা অগ্নিগিরির মতো; জীবনের অধিকাংশ সময়ই তাদের মনে হয় তুচ্ছ ও বিবর্ণ ও অসহায়, তারা তাদের জীবন নিয়ে থাকে বিপর্যস্ত বা ছোটোখাটো সুখে সুখী। আমাদের মতো দরিদ্র দেশে তারা অত্যন্ত মলিন, আপাতদৃষ্টিতে ভাঙাচোরা, তাদের মধ্যে কোনো প্রচণ্ড শক্তি লুকিয়ে আছে, তা টেরই পাওয়া যায় না। কখনো কখনো কোনো নেতা আসেন, যিনি ওই খড়কুটোকে করে তোলেন দাবানল, জলরাশিকে তীব্র প্লাবন, এবং ঘুমন্ত অগ্নিগিরিকে জাগিয়ে তোলেন, চারিদিকে লাভাস্রোত বইতে থাকে। এ-কাজটি করেছিলেন মুজিব।
জনগণকে ভুল পথেও নিয়ে যাওয়া যায়; হিটলার-মুসোলিনির মতো একনায়কেরাও জনগণকে দাবানলে, প্লাবনে, অগ্নিগিরিতে পরিণত করেছিলো, তা ছিলো অশুভ দাবানল, প্লাবন, অগ্নিগিরি, যার পরিণতি হয়েছিলো ভয়াবহ। জনতাজাগানো নেতারা জনগণকে সৃষ্টি করতে পারে, আবার নষ্ট করতে পারে। তারা জনগণকে উন্মাদ মগজহীন প্রাণীতে পরিণত করেছিলো। ১৯৭১-এর মার্চে শেখ মুজিব সৃষ্টি করেছিলেন শুভ দাবানল, শুভ প্লাবন, শুভ অগ্নিগিরি, নতুনভাবে সৃষ্টি করেছিলেন বাঙালি মুসলমানকে, যার ফলে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম।”
লেখক: কবি, বহুমাত্রিক লেখক।