।। সাইফুর রহমান।।
দুই দিন যাবত একটি পোস্ট চোখে পড়ছে। মহাজন নাকি সাত মাসে বিরাট অসাধ্য সাধন করে ফেলেছে। মহাজনের পিআর টিম সেটা বেশ প্রচার করছে। সেখানে অনেকগুলো তথ্য সংযুক্ত করা হয়েছে। যদিও একটি তথ্যেরও কোন সূত্র উল্লেখ করা হয়নি। অবশ্য, কে খোঁজে রেফারেন্স। গড়পড়তা বাঙ্গালীরা যাদের কাছে রেফারেন্স বলতে ইউটিউবারদের বানানো ভিডিয়ো ও তার চেয়ে একটু কম্পিউটার ভালো চালাতে পারাদের কাছে উইকিপিডিয়া হলো জগতের সকল সত্যের অকাট্য সূত্র।
দাবি করা হয়েছে গত ৬ মাসে বর্তমান সরকার বিদেশী ঋণ পরিশোধ করেছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। আসলেই? মানে ৫১০ কোটি ডলার? না মানে টাকায় বললে পরিমাণটা শুনতে বেশ বড় মনে হয়। আদানীর কাছে বকেয়া ছিল ৮৫ কোটি ডলার। আদানী জানিয়ে দিয়েছিল, সেই অর্থ পরিশোধ না করলে তারা বিদ্যুৎ দিবে না। এদিকে ভারতের সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলা সরকার কিন্তু সেই চুক্তি বাতিল করার সাহস করেনি। উল্টো পুরো বিদ্যুৎ চেয়েছে। সেটা বাদ দিলাম। একটু খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি সরকার আসলেই ৬২ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে, তবে সেটা মূল ঋণ নয়, সুদ। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো এই অর্থের পুরোটা বিদেশি ঋনের সুদ নয়। বরং এর একটি ছোট অংশ বিদেশী ঋনের সুদ।সমকালের সংবাদ বলছে, “এর মধ্যে দেশি ঋণের সুদ পরিশোধে ৫৩ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে ৯ হাজার ২২ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।” (১) এর মানে দাঁড়ালো দেশী ঋণের সুদ শোধ করেছে, এতে রিজার্ভের কোন কৃতিত্ব নেই। শুধুমাত্র নভেম্বরের এক সংবাদেই জানা গেছে ২২৫০০ কোটি টাকা ছাপিয়ে ৬ ব্যাংককে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। (২)
একই পোস্টে বলা হচ্ছে, দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে ১৮.৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। যা গতবছরের এই সময়ের তুলনায় ৪ বিলিয়ন বেশি। একটু ঘেঁটে জানা গেল, এই সংখ্যাটাও সঠিক নয়। ডেইলি স্টারের মাধ্যমে জানা গেল, “ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।” মূলত প্রতি বছর রমজানের আগে, ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে রেমিটেন্স তার পূর্ববর্তী মাসের চেয়ে বেশীই আসে। প্রবাসীরা এই সময় ব্যাপক টাকা পাঠান দেশে। এই কথাটিও আমি বলছি না, ডেইলি স্টার বলছে। “এর উল্লেখযোগ্য কারণ, প্রবাসী বাংলাদেশিরা রমজান ও ঈদকে সামনে রেখে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন।” (৩)
সরকারের প্রচারিত তথ্য মতে শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের বিভিন্ন ব্যাংক একাউন্ট থেকে ৬৩৫ কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে। বক্তব্যটি অসত্য। পত্রিকা বলছে, “শেখ হাসিনা, তার পরিবার ও তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ফ্রিজিং করা ১২৪ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৬৩৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা পেয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।” (৪) একাউন্ট ফ্রিজ হওয়া এবং সেই টাকা চাইলে সরকারের ব্যবহার করতে পারা এক কথা নয়। সরকারকে তার আগে প্রমাণ করতে হবে এই অর্থের উৎস অবৈধ। নতুবা চাইলেই সরকার কারোই অর্থ “উদ্ধার” করতে পারে না, যে যত বড় অপধারীই হোক না কেন।
উক্ত পোস্টের ভাষ্যমতে “দেশের খাদ্যপণ্যে ভর্তুকি বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ।” এটা ঠিক কোন অর্থে সরকারের সাফল্য সেটা পোস্টদাতা বুঝে লিখেছেন কি না, আমার বোধগম্য নয়। ভর্তুকি তখনই দিতে হয় যখন খরচের চেয়ে আয় কম হয়। মূলত খাদ্যের আমদানি কিংবা উৎপাদন খরচের চেয়ে বিক্রয় মূল্য বেশি হলে তখন সরকারকে ভর্তুকি দিতে বাজার সামাল দিতে হয়। ভর্তুকি ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়া মানে হলো সরকার আগের চেয়ে বেশি দামে খাদ্য আমদানি করছে। আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি পাকিস্তান থেকে চাল ও চিনি বেশী দামেই আমদানি করা হচ্ছে সরকারিভাবে। (৫)
এই বছর রমজানে সবজির দাম কিছুটা হলেও সহনীয় ছিল। আগামী বছর আরও সহনীয় এবং মূল্য কম থাকবে। এর কারণ হলো শীতের সবজি। আগামী বছর রমজানে যদি অন্য কেউ ক্ষমতায় থাকে, তারাও নিশ্চয়ই তাদের ব্যাপক সফলতা হিসেবে এটাকে প্রচার করতে পারবেন, যেমনটি উক্ত পোস্টে মহাজনের সরকারের সফলতা হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। সবজির ছাড়া যেসব পণ্যের মূল্য তুলনামূলক কম আছে তার কারণ হলো আগের প্যারায় উল্লেখ করা ভর্তুকি বৃদ্ধির কারণেই।
উক্ত পোস্টে দাবি করা হয়েছে, গত ২২ মাসের তুলনায় সর্বনিম্ন মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে এই ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু বিশ্বখ্যাত ক্রেডিট রেটিং সংস্থা মুডিসের বক্তব্য তো ভিন্ন কথা বলছে। তারা বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়েছে। আগে ঋণমান ছিল ‘বি-ওয়ান’, এখন তা নেমে এসেছে ‘বি-টু’’ পর্যায়ে। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক পূর্বাভাস ‘স্থিতিশীল’ থেকে ‘নেতিবাচক’ হয়ে গেছে। (৬)
দাবি করা হয়েছে, ধর্ষণের তদন্ত ১৫ দিন এবং বিচার ৯০ দিনের মধ্যে করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। তবে এতে করে আইনের অপব্যবহার সহজতর হবে। প্রচুর মিথ্যা মামলা হবে। অনেকেই ভিন্ন উদ্দেশ্যে এই সময়সীমার সুযোগ নিয়ে ভিন্ন স্বার্থে মিথ্যা অভিযোগে মানুষকে ফাঁসানোর চেষ্টা করবে। তাতে সত্যিকারের ধর্ষণের মামলাগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধর্ষকের বিচার চাই, তবে স্বচ্ছতার সাথে।
বাফুফের উপর যেই আর্থিক নিষেধাজ্ঞা ছিল ফিফার, সেটি তুলে নেয়া হয়েছে। তাবিথ আউয়াল একজন ফুটবল প্রেমী হিসেবেই পরিচিত ব্যক্তিত্ব। তিনি ২০১২ ও ২০১৬ সালে বাফুফের সহসভাপতি ছিলেন। (৭) এক্ষেত্রে তাবিথ আউয়ালের প্রচেষ্টা অবশ্যই গুরত্বপূর্ণ এবং প্রশংসার দাবি রাখে।
উক্ত পোস্টের সবচেয়ে হাস্যকর হলো সর্বশেষ দাবিটি। দাবি করা হয়েছে জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশে “প্রথমবারের” মতো চারদিনের সফরে আসছেন, যা কিনা একমাত্র ইউনূসের কারণেই সম্ভব হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব এর আগে একাধিকবার বাংলাদেশে এসেছেন। জাতিসংঘের কোন মহাসচিব বাংলাদেশে প্রথম আসেন ১৯৭৩ সালে। (৮) সেসময় বাংলাদেশের সরকার প্রধান কে ছিলেন নিশ্চয়ই আলাদাভাবে উল্লেখ করার কিছু নেই। এরপরেও একাধিকবার জাতি সংঘের মহাসচিব পদে থাকা ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশ সফর করেছেন।
একজন নোবেল বিজয়ী সরকার প্রধানের এমন সস্তা ও মিথ্যা প্রচারণা খুব দৃষ্টিকটু লাগে।
সূত্রসমূহঃ
১) https://tinyurl.com/mrezu82k
২) https://tinyurl.com/muzt4ukz
৩) https://tinyurl.com/mrymrabp
৪) https://tinyurl.com/yhyrbxwp
৫) https://tinyurl.com/35nbrk74
৬) https://tinyurl.com/jfyc6hmu
৭) https://tinyurl.com/4yvh2u4e
৮) https://tinyurl.com/33auyjws
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও বিশ্লেষক