।। আডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত ।।
মঙ্গলবার বগুড়া কারাগারে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়ের করা বিস্ফোরক ও ভাঙচুর মামলায় স্বেচ্ছাচারী গ্রেপ্তারকৃত এক আওয়ামী লীগ নেতা মৃত্যুবরণ করেন। মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে গত ছয় মাসে সারাদেশে কারাগারে ৫০-এর অধিক বন্দির মৃত্যু এবং শুধুমাত্র বগুড়া জেলা কারাগারে পাঁচজন আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যুর ঘটনা দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে।
এটি শুধু কোনো নির্দিষ্ট কারাগারের সমস্যা নয়; বরং বাংলাদেশের কারাগার ব্যবস্থার অনিয়ম, দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিচিত্র।
কারাগারে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও চরম অব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশের কারাগারগুলো দীর্ঘদিন ধরেই চরম অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির শিকার। শান্তিতে নোবেল জয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে এ অবস্থা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। যেখানে কারাগারের ধারণক্ষমতা ৪২,৮৭৭ জন, সেখানে বন্দি সংখ্যা ৭০,০৬৫। এই জনসংকুলান মানবাধিকার লঙ্ঘনেরই প্রতিচিত্র। অতিরিক্ত বন্দির কারণে ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টিকর খাবার, শৌচাগারের সুবিধা এবং মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা ব্যাহত হচ্ছে। অধিকাংশ বন্দি মেঝেতে ঘুমাতে বাধ্য হচ্ছেন, যা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করছে।
সরকারি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ ডিভিশনের সুবিধা থাকলেও সাধারণ বন্দিরা অমানবিক জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী পর্যায়ের কিছু ব্যক্তি ডিভিশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছেন, যা ইউনূস সরকারের পক্ষপাতমূলক নীতির প্রতিফলন। কারাগারে দুর্নীতির আরেকটি বড় দিক হলো অর্থের বিনিময়ে বিশেষ সুবিধা পাওয়া। সাধারণ বন্দিদের তুলনায় প্রভাবশালীরা ভালো খাবার, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ ও মোবাইল ফোনের সুবিধা পাচ্ছেন, যা নৈতিকতা ও মানবাধিকারের পরিপন্থী।
কারাগারে মৃত্যু: দায় কার?
ইউনূস সরকারের শাসনামলে কারাগারে বন্দি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। শুধুমাত্র বগুড়া কারাগারেই পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে, যা রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের প্রতিফলন। সাধারণত বন্দিদের জীবনরক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব কারা কর্তৃপক্ষের। বাস্তবতা হলো, কারাগারের চিকিৎসা ব্যবস্থা নাজুক, স্বাস্থ্যসেবা সীমিত এবং চিকিৎসার মান প্রশ্নবিদ্ধ। বগুড়ার ঘটনাগুলোতে মৃত্যুর কারণ হৃদরোগ ও অন্যান্য স্বাস্থ্য জটিলতা বলা হলেও, এসবের পেছনে অব্যবস্থাপনা, চিকিৎসা অবহেলা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বা অন্য কোন বিশেষ কারণ দায়ী কিনা, তা নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি রাখে।
কারা প্রশাসনের দুর্নীতি ও নিরাপত্তাহীনতা
কারাগারগুলোতে মাদক, মোবাইল ফোন ও নগদ অর্থের অবাধ প্রবাহ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কারা মহাপরিদর্শক স্বীকার করেছেন, গত তিন মাসে শুধু কেরানীগঞ্জ কারাগারেই ২৭৫টি অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সামগ্রী উদ্ধার করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এসব সামগ্রী কীভাবে প্রবেশ করছে? বন্দিরা তো বাইরের জগতের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত নয়। স্পষ্টতই, কারা প্রশাসনের ভেতরে থাকা অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মদদ ছাড়া এটি সম্ভব নয়। মাঝে মাঝে অভিযান চালিয়ে কিছু সামগ্রী উদ্ধার করা হলেও মূল সমস্যার কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হচ্ছে না; বরং দুর্নীতিবাজরা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
জঙ্গি ও দুর্ধর্ষ অপরাধীদের পলায়ন
ইউনূস সরকারের শাসনামলে ভয়াবহ নিরাপত্তা ব্যর্থতার কারণে ৫ই আগস্টের পর দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে ৭০০ জন বন্দি পালিয়েছে, যাদের মধ্যে ৬৯ জন এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই পলাতকদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত, যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত এবং কুখ্যাত জঙ্গি সদস্যও রয়েছে, যা দেশের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে।
বিশেষভাবে লক্ষণীয়, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীর প্রকাশ্যে বিক্ষোভ করেছে, যেখানে পলাতক জঙ্গি বন্দিদের উপস্থিতি দেখা গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের দমনে ব্যর্থ হয়েছে, যা সরকারের দুর্বলতা ও অদক্ষতারই প্রতিফলন। এসব ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে যে, পলাতক বন্দিরা শুধু আত্মগোপনে নেই, বরং সক্রিয়ভাবে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে।
এছাড়া, কাশিমপুর কারাগারে ইসলামি মৌলবাদী গোষ্ঠী প্রকাশ্যে জঙ্গি নেতাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য জেলার ও জেল সুপারকে হুমকি দিয়েছে। এটি কারা প্রশাসনের দুর্বলতা এবং সরকারের নিরাপত্তা ব্যবস্থার চরম অবনতির প্রতিফলন।
সরকারের ভূমিকায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য?
প্রশ্ন হচ্ছে, ইউনূস সরকার কেন কারাগারের অব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তাহীনতা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না? তাদের ব্যর্থতা কি নিছক প্রশাসনিক অদক্ষতা, নাকি এর পেছনে সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে?
৫ই আগস্টের পর একের পর এক কারাগার ভেঙে জঙ্গিদের পালানোর সুযোগ করে দেওয়া এবং আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বন্দিদের মৃত্যুর ঘটনা দেখে সন্দেহ জাগে—এটি কি শুধুই অবহেলা, নাকি সচেতন চক্রান্ত? ইউনূস সরকারের নির্লিপ্ততায় মনে হচ্ছে, তারা এই ঘটনাগুলো নিয়ন্ত্রণে অপারগ নয়, ইচ্ছাকৃতভাবেই এ পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে দিচ্ছে।
সমাধানের উপায়
• কারাগারের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি: নতুন কারাগার নির্মাণ ও বিকল্প শাস্তির (সমাজসেবা বা জামিন) ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
• কারা প্রশাসনে দুর্নীতির লাগাম টানা: দোষী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং কারাগার ব্যবস্থাপনাকে স্বচ্ছ করতে হবে।
• বন্দিদের মানবাধিকার নিশ্চিত করা: ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা, পর্যাপ্ত খাবার ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
• কারাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার: উন্নত প্রযুক্তির বডি স্ক্যানার ও নজরদারি ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে মোবাইল ফোন ও মাদক প্রবেশ বন্ধ হয়।
• পলাতক আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তার: আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে এবং জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশের কারাগার শুধুমাত্র শাস্তির স্থান নয়; এটি বন্দিদের সংশোধন ও পুনর্বাসনের কেন্দ্র হওয়া উচিত। তবে দুর্নীতি, নিরাপত্তাহীনতা ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে কারাগার অপরাধের আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে। তাই বন্দিদের জীবন ও মানবাধিকার নিশ্চিত করাই হবে একটি উন্নত ও গণতান্ত্রিক সমাজের পরিচায়ক।
ইউনূস সরকারের ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কারা ব্যবস্থাপনা দ্রুত উন্নয়ন করা না হলে, দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি; অন্যথায়, এই সরকারকে একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য হবে।
লেখক: বাংলাদেশি মানবাধিকার আইনজীবী, ফ্রান্স সরকারের ম্যারিয়ান ইনিশিয়েটিভ ফর হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার্স লরিয়েট, ২০২৩ এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, জাস্টিসমেকার্স বাংলাদেশ ইন ফ্রান্স (জেএমবিএফ), ওয়েবসাইট: www.jmbf.org, ইমেইল: shahanur.islam@jmbf.org