ঢাকা, ১৩ মার্চ : রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ গতকাল ১২ই মার্চ, বুধবার আব্দুল্লাহপুর এলাকা থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ২০ রাউন্ড ৭.৬২x৩৯ মি.মি ক্যালিবারের বুলেট উদ্ধার করেছে। গত বছরের জুলাই-আগস্টে সরকারবিরোধী আন্দোলনে একই ধরনের বুলেটে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর ঘটনার প্রেক্ষিত এবং গতকাল উদ্ধার হওয়া বুলেটের সাদৃশ্য নতুন করে জনমনে সংশয় ও উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে।
উত্তরা পশ্চিম থানা সূত্রে জানা গেছে, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বুধবার বিকেল ৩:৩০ টার দিকে আব্দুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন তুরাগ নদীর দক্ষিণপাড়ে মাটির স্তূপের ওপর থেকে খাকি রঙের বক্স প্যাকেটে এই বুলেটগুলো উদ্ধার করা হয়। প্রতিটি বুলেটের গায়ে “BOF18E 7.62X39 mm Ball Ammo” মুদ্রিত রয়েছে। BOF বা বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি হলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সমরাস্ত্র, গোলাবারুদসহ সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশে উৎপাদিত এই বল অ্যামিউনিশন টাইপ বুলেট স্নাইপার রাইফেলে ব্যবহৃত হয়। পুলিশ জানিয়েছে, এ ঘটনায় আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত বছরের জুলাইয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ৭.৬২ ক্যালিবারের বুলেট দিয়ে ছাত্র, সাধারণ মানুষ এবং এমনকি শিশুদের মৃত্যুর ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ধরনের বুলেট ব্যবহার করে না বলে জানিয়েছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন।
সেসময় তিনি বলেছিলেন, ‘নিহতের শরীরে যেই বুলেট পাওয়া গিয়েছে (৭.৬২ মি.মি.), সেগুলো বাংলাদেশ পুলিশ ব্যবহার করেন না। নিষিদ্ধ অস্ত্র সিভিলিয়ানদের হাতে আসলো কীভাবে?’
তার সেই বক্তব্যের পর এই বুলেটের উৎস ও ব্যবহার নিয়ে সন্দেহ ক্রমশ ঘনীভূত হয়েছে। গত সাত মাসে বিভিন্ন চেকিংয়ে তিনটি স্নাইপার রাইফেল উদ্ধারের ঘটনাও এই সন্দেহকে আরও জোরালো করছে।
গত বছরের ১১ই আগস্ট একটি নাম্বারপ্লেটহীন গাড়ি (শুধু চেসিস নাম্বার লেখা) থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা একটি যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত অত্যাধুনিক স্নাইপার রাইফেল উদ্ধার করেছিল। উদ্ধারকৃত অস্ত্রটি ছিল এম টুয়েন্টি ফোর (M24) স্নাইপার রাইফেল। এই M24 স্নাইপার ওয়েপন সিস্টেমের (SWS) রেমিংটন মডেল ৭০০ অস্ত্রটি সামরিক সংস্করণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত এই রাইফেলটি দূরবর্তী টার্গেট কিলিংয়ের জন্য একটি স্ট্যান্ডার্ড অস্ত্র। এই অস্ত্রে ৭.৬২ মি.মি. বুলেট ব্যবহৃত হয়। অস্ত্রটি ২০২১ সাল থেকেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ব্যবহার করছে। প্রশ্ন, সেনাবাহিনীর অস্ত্র বেসামরিক জনগণের হাতে কীভাবে গিয়েছিল?
বিশেষজ্ঞদের মতে, ৭.৬২ মি.মি. ক্যালিবারের বুলেট সাধারণত উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্রে ব্যবহৃত হয়, যা দূরপাল্লার নির্ভুল নিশানায় কার্যকর। জুলাই-আগস্টে এই বুলেটে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অনেকে মনে করছেন, পেশাদার হত্যাকারী বা স্নাইপার নিয়োগ করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর জনরোষ সৃষ্টিতে এবং পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে এই ধরনের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগও উঠেছে।
একই ঘটনার প্রেক্ষিত মিলে যায় ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্ষমতাসীন সরকার হঠাতে সৃষ্ট আন্দোলনের সাথে। ইউরোময়দান রেভ্যুলেশন বা রেভ্যুলেশন অব ডিগনিটি খ্যাত সেই আন্দোলনে স্নাইপার দ্বারা বিক্ষোভকারী এবং পুলিশ উভয়পক্ষের লোকজনকে হত্যার মাধ্যমে একটি False Flag Operation চালায় মার্কিনিরা। যার ফলে রুশপন্থী আখ্যায়িত সরকারের পতন ঘটে। মার্কিন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও নির্মাতা জন বেক হফম্যান তার ‘মায়দান ম্যাসাকার’ ডকুমেন্টারিতে স্নাইপারদের সাক্ষাৎকার নিয়ে এর প্রমাণ দিয়েছেন।
গত বছরের ৪ঠা আগষ্ট ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদ প্রতিবেদনে জানা যায়, আন্দোলনে তখন পর্যন্ত নিহত ১১৩ জনের মধ্যে হেড শটে ৩৯ জন, চেস্ট শটে ৩৫ জন মারা গেছেন। আন্দোলনের এক সমন্বয়ক আসিফের মৃত্যু হয় স্নাইপারের বুলেটে, যা সংবাদসূত্রে জানা যায়।
উল্লেখ্য, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬৬% হত্যার ঘটনায় মিলিটারি গ্রেডের বুলেটে ব্যবহৃত হয়েছে। মানবাধিকার কমিশন প্রধান ভলকার টুর্ক নিজেই স্বীকার করেছেন বিবিসি-কে, ১৮ই জুলাই দেওয়া তার হুমকিতে সেনাবাহিনি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। আন্দোলনে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়িন্ত্রণে সরকারকে যেন সেনাবাহিনী সহয়তা না করে। সেনাবাহিনী যদি সক্রিয় হয়, তবে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে।
সেনাবাহিনীর এই নিষ্ক্রিয়তায় সংঘাত এবং হতাহতের মাত্র বহুগুণে বেড়ে যায়। সেনাবাহিনী যদি এই সামরিক গ্রেডের বুলেট ব্যবহার না করে, তবে কারা করল? প্রশ্ন রয়ে যায়। নিষিদ্ধ অস্ত্র সিভিলিয়ানদের হাতে এলো কীভাবে, এর সুষ্ঠু তদন্তের জন্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাবার কথা বলার পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেনকে আর ওই পদে রাখা হয়নি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এই বুলেট এবং অতীতে স্নাইপার রাইফেল উদ্ধারের ঘটনাগুলো গভীর তদন্তের দাবি রাখে। আমরা এর উৎস এবং ব্যবহারের উদ্দেশ্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।”
গত বছরের জুলাই-আগস্টের সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের পর থেকে সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের বুলেট এবং স্নাইপার রাইফেল, টেলিস্কোপিক রাইফেল, রাইফেলে ব্যবহৃত টেলিস্কোপিক সাইট- ইত্যাদি উদ্ধার হয়েছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল ছবিতে দেখা গেছে বরখাস্তকৃত কিছু সেনাসদস্যের ফেসবুক পোস্টে বিভিন্ন সমরাস্ত্রের প্রদর্শনী, এমনকি অত্যাধুনিক স্নাইপার রাইফেলসহ। সেই বরখাস্তকৃত সেনাসদস্যদের আবার আন্দোলনের সমন্বয়কদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলেও জানা গেছে, বিভিন্ন সভা-সমাবেশে এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তাদের নিয়মিত দেখা যায়।
এসব ঘটনার পারস্পরিক সম্পর্ক রহস্যকে আরও জটিল করে তুলেছে।
উত্তরায় সর্বশেষ এই বুলেট উদ্ধারের ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্কের পাশাপাশি সত্য উদঘাটনের দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে। তদন্তের অগ্রগতি এবং এই বুলেটের পেছনের গল্প জানতে জনগণ এখন পুলিশের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে আছে।
সম্প্রতি সাভারে নারী উত্যক্তকারী হিসেবে খালেদ মাহমুদ হৃদয় খান নামের যে টিকটকার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে, সে তার একটি ভিডিওতে সেনাবাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার কাছে আন্দোলনে তার ব্যবহৃত এই রাইফেল জমা দেয়ার কথাই বলেছিলেন। সেই আত্মস্বীকৃত হৃদয় খানকে গ্রেপ্তারের পরেই কি তবে জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারীরা বেঁচে যাওয়া বুলেট ফেলে দিচ্ছে- এমন প্রশ্ন ইতিমধ্যেই জনমনে দেখা দিয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আব্দুল্লাহপুরের যেখানে এই বুলেট উদ্ধার হয়েছে, তার খুব কাছেই ১৯শে জুলাই এমনই এক বুলেটে মুগ্ধ নিহত হয়েছিলেন। মুগ্ধের সাথে থাকা বন্ধুদের বর্ণনা মতে, দাঁড়িয়ে থাকা মুগ্ধের কপাল দিয়ে বুলেট ঢুকে কানের পেছন দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল বুলেট। বর্ণনা আর ট্রাজেক্টরি পয়েন্ট থেকে এটা খুব সহজেই বোঝা যায় যে, সুউচ্চ কোনো স্থান থেকে মুগ্ধকে এমনই এক বুলেট দিয়ে শ্যুট করা হয়েছিল।
উত্তরা এলাকায় কমপক্ষে জনা বিশেক ছাত্র-জনতা নিহত হন সেই আন্দোলনে। একই চালানের বুলেট এসব হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছিল কিনা, তা শুধুমাত্র নিশ্চিত হওয়া যাবে ব্যালিস্টিক পরীক্ষার মাধ্যমে। যদিও তা কবে হবে কিংবা আদৌ কি হবে কিনা, এ নিয়ে জনমনে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
জাতিসংঘের তদন্ত দল বারবার অনুরোধ করেও নিহতদের শরীর থেকে উদ্ধারকৃত বুলেটের নমুনা দেখার সুযোগ পায়নি। এটা আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা নিজেই বলেছেন তার সাক্ষাৎকারে। তাই এসব প্রশ্নের উত্তর কবে মিলবে, তা একমাত্র ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীলরাই বলতে পারেন।