।। মহিউদ্দিন মোহাম্মদ ।।
‘বুরকা’ ও ‘হিজাব’— এ দুটি বিষয়কে মুসলিমরা প্রায়ই গুলিয়ে ফেলে। ভাবে, হিজাব মানেই বুরকা। আসলে তা নয়। বুরকা হলো কোনো বিশেষ কারণে মাথা ও মুখ ঢেকে চলাফেরার পোশাক। বুরকার সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। পৃথিবীতে ইসলাম আসার বহু আগে থেকেই বুরকা ছিলো। আরব পৌত্তলিকদের একটি অংশ বুরকা পরতো। বাইজেন্টিন নারীরাও বুরকা পরতো। সেদিক থেকে বুরকা মূলত অমুসলিমদের পোশাক।
বুরকা প্রধানত পরা হতো— (ক) তীব্র রোদ ও বৈরি আবহাওয়া থেকে রক্ষা পেতে; (খ) গুপ্তচরবৃত্তি, চৌর্যবৃত্তি, ও চোরাকারবারের সহায়ক পরিধেয় হিশেবে; (গ) সম্মানজনক নয়, এমন পেশায় নিয়োজিত নারীদের রক্ষাকবচ হিশেবে; (ঘ) হারেমখানায় স্ত্রীর মর্যাদা পান নি, এমন নারী ও যৌনদাসীদের পরিচয় আড়ালকারক হিশেবে; এবং (ঙ) নেকাব দ্বারা চোখের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে (কারণ আরব নারীদের চোখ সুন্দর ছিলো)।
তবে বুরকা শুধু মাথা বা মুখের হয় না। পায়েরও হয়। যেমন চীনা নারীরা পা দেখাতে চায় না। তাদের জন্য জুতা একপ্রকার বুরকা।
ইসলামের শুরুর দিকে ‘হিজাব’ বা ‘পর্দা’ বলতে আড়ালকারক চাদর ও দেয়াল বুঝাতো। তখন বহুকক্ষবিশিষ্ট ঘর-বাড়ি আরবে ছিলো না। মসজিদে এতেকাফের সময় চাদর টাঙ্গিয়ে যেভাবে আলাদা কক্ষ তৈরি করা হয়, সেভাবে হিজাব টাঙ্গিয়ে ঘরের ভেতর সাময়িক কক্ষ সৃষ্টি করা হতো। নবী যখন তাঁর ঘরে স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে একসাথে থাকতেন, তখন প্রায়ই সাহাবিরা গল্পগুজব করতে আসতো। দূর থেকে মেহমানরা দেখা-সাক্ষাৎ করতে আসতো। একটি ছোট ঘরে হুটহাট অপরিচিত মানুষজন আসায় নবী পরিবারের নারী সদস্যরা বিব্রত বোধ করতেন। এ জন্য হিজাব টাঙ্গিয়ে, অর্থাৎ ঘরের মাঝখানে চাদর-সদৃশ কাপড় টাঙ্গিয়ে, নারী সদস্যদের প্রাইভ্যাসি দেয়া হতো।
কিন্তু নবীর মৃত্যুর পর হিজাব শব্দটিকে কোরানের বিভিন্ন আয়াতের সাথে মিশিয়ে এর অর্থ ও পরিধি বাড়ানো হয়েছে। বিকৃত করা হয়েছে আসল রূপ। খিমার, জিলবাব, প্রভৃতি বিষয়কে হিজাবের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে। যে-আয়াতগুলো কেবল নবীর স্ত্রী-কন্যার জন্য প্রযোজ্য, সে-আয়াতগুলোকেও সাধারণ নারীদের ওপর চাপানো হয়েছে। এ কৃতিত্ব মতলববাজ ধর্মবণিকদের।
নবীর কোনো স্ত্রী ও কন্যা বুরকা পরতেন না। তাঁর স্ত্রী খাদিজা মুখ খোলা রেখে চলাফেরা করতেন। তিনি স্বাধীনভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যও করতেন। নিয়মিত হাট-বাজারে যেতেন। ইসলামের নামে অতিরঞ্জিত কিছু পালন করা ইসলামসম্মত নয়। কোরানে কোথাও নারীদেরকে বুরকা পরতে নির্দেশ দেয়া হয় নি। বরং কিছু আয়াত পড়ে মনে হয়েছে, বুরকা একটি ইসলাম-বিরোধী পোশাক।
এই মুহুর্তে বিশ্বের অনেকগুলো দেশে বুরকা নিষিদ্ধ। কারণ আধুনিক রাষ্ট্রে বুরকা একটি গুরুতর নিরাপত্তা হুমকি। বুরকা নিষিদ্ধ মানেই হিজাব নিষিদ্ধ নয়। ফ্রান্স বুরকা নিষিদ্ধ করেছে, যেরকম নিষিদ্ধ করেছে মরক্কোসহ আরও অনেক মুসলিম দেশ, কিন্তু এ দেশগুলো হিজাব নিষিদ্ধ করে নি। কোথাও “অমুক দেশ হিজাব নিষিদ্ধ করেছে”— এমন শোরগোল শুনলে বুঝতে হবে, মতলববাজরা ভুল তথ্য প্রচার করছে। সঠিক তথ্য হবে— অমুক দেশ বুরকা নিষিদ্ধ করেছে। ইসলামে হিজাব আছে, বুরকা নেই।
সম্প্রতি লক্ষ করেছি, বাংলাদেশ পুলিশ প্রায়ই বুরকা পরা ইয়াবা ও গাঁজা-ব্যবসায়ী আটক করছে। ছেলেরা বুরকা পরে মেয়ে সেজে মাদক ব্যবসা করছে। সেদিক থেকে দেখলে বুরকা শুধু ইসলামবিরোধী পোশাক নয়, এটি একটি জনবিরোধী পোশাকও বটে।
কেউ বুরকা পরতে চাইলে পরুক, এতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ চাওয়া মাত্র তাকে নেকাব সরিয়ে মুখমণ্ডল প্রদর্শন করতে হবে। ‘পরিচয় যাচাই’ বা ‘আইডি ভেরিফিকেশন’ খুব গুরুত্বপূর্ণ ‘পাবলিক ইন্টারেস্ট’। আধুনিক রাষ্ট্রে মানুষের স্বাধীনতা অবাধ নয়। স্বাধীনতার সীমানা আছে। কারও ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ‘পাবলিক ইন্টারেস্ট’-এর সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারবে না। পাবলিক সিকিউরিটি, রুল অব ল, ফেয়ারনেস অব জাস্টিস— এ বিষয়গুলো রাষ্ট্রব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ। এগুলোকে ফাঁকি দিতে ধর্মীয় স্বাধীনতার দোহাই দেয়া গ্রহণযোগ্য নয়।
বুরকা নারীর ব্যক্তিত্বকেও নষ্ট করে। বুরকা পরা নারীদের অনেকেই ‘লো সেল্ফ-ইস্টিম’ বা হীনম্মন্যতায় ভোগেন। তাদের সাহস, মনোবল, ও আত্মবিশ্বাস কম থাকে। এ জন্য নারীদের উচিত, যথাসম্ভব বুরকা পরিহার করা। বুরকা ইসলামের কোনো অংশ নয়। একটি বিশেষ মহল বুরকাকে ইসলামি পোশাক বলে প্রচার করছে। বুরকা পরার সাথে আল্লাহকে পাওয়ার, বা বেহেশতে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। কাউকে বুরকা পরতে বাধ্য করা, বা সারাক্ষণ ধর্মের ভয়ে বুরকা পরা, এগুলো আল্লাহর পছন্দের কাজ নয়। নবীর জীবদ্দশায় মুসলিম নারীরা রঙিন ও জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরতেন।
হিজাব কী? হিজাব শব্দটির বিবর্তিত অর্থ এখন এরকম— লজ্জাস্থান ঢেকে ও মুখ খোলা রেখে আরামদায়ক পোশাক-আশাক পরিধান করা। শাড়ি, সালওয়ার-কামিজ, প্যান্ট, টি-শার্ট, চাদর, স্কার্ট, ব্লাউজ, এগুলো সবই হিজাব। হিজাব মানেই চোখ-মুখ ঢেকে ফেলা নয়। খিমার, জিলবাব, যিনাতাহুন্না, এসবের সাথে চোখ-মুখ ঢাকার কোনো সম্পর্ক নেই।
.
‘মূর্তিভাঙা প্রকল্প’ পৃষ্ঠা ২৪-২৭, বই,লেখক: মহিউদ্দিন মোহাম্মদ।