।। মনজুরুল হক ।।
মার্কিন ইন্টেলিজেন্স চিফ তুলসী গ্যাবার্ড বর্তমানে ভারতসফররত। সেখানে বিভিন্ন মিডিয়ায় তার বক্তব্য নিয়ে বাংলাদেশে তুলকালাম ঘটেছে। প্রধান উপেদষ্টার দফতর থেকে তুলসীর বক্তব্যের প্রতিবাদ করা হয়েছে। কী বলেছেন তুলসী? তিনি বলেছেন-“বাংলাদেশে ইসলামী চরমপন্থার ভয়াবহ উত্থান ঘটেছে, যা ঠেকাতে ভারতের সঙ্গে একযোগে কাজ করছে ট্রাম্প প্রশাসন। বাংলাদেশে ইসলামী খেলাফত কায়েমের চেষ্টা চলছে বলেও সতর্ক করেছেন তিনি। এমন বার্তাকে দেখা হচ্ছে ড. ইউনূস সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কঠিন হুশিয়ারি হিসেবে। বাংলাদেশর সাম্প্রতিক কারণে তিনটি বিষয়ে উদ্বিঘ্ন যুক্তরাষ্ট্র।
📍
দিল্লিতে ২০টি দেশের গোয়েন্দা প্রধানদের RAISINA DIALOGUE 2025 সম্মেলন হয়েছে। এই ‘রাইসিনা ডায়লগ’ বিষয়টি কী? সংক্ষেপে-The Raisina Dialogue is a multilateral conference held annually in New Delhi, India. Since its inception in 2016, the Raisina Dialogue has emerged as India’s flagship conference on geopolitics and geo-economics, committed to addressing the most challenging issues facing the international community.
📍
ওই ২০ টি দেশের মধ্যে ডাক পায়নি পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। যদিও তাদের অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল পাকিস্তান ও বাংলাদেশে র্যাডিকালাইজেশনের উত্থান প্রসঙ্গে। বৈঠক শেষে তুলসী গ্যাবার্ড ১৬ মার্চ আলাদাভাবে বৈঠক করেছেন ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে। ১৭ মার্চ বৈঠক করেছেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজ নাথ সিং-এর সঙ্গে। এই বৈঠকের কোনও মিডিয়া ব্রিফিং হয়নি, কোনও রিপোর্ট হয়নি। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে মিটিং শেষ করেছে ২০ টি দেশের গোয়েন্দা প্রধানগণ।
📍
বাংলাদেশে ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হত্যা, নির্যাতন’ নিয়ে উদ্বেগে আমেরিকা। বিশেষত, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টানদের নিয়ে। বাংলাদেশে ‘ইসলামিক সন্ত্রাস’ নিয়েও যথেষ্ট অস্বস্তি রয়েছে আমেরিকার। নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ভাবধারাকে নির্মূল করতে বদ্ধপরিকর। গত ফেব্রুয়ারি মাসে আমেরিকা সফরে গিয়ে প্রতিবেশী দেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। সে সময় তাঁর উপরই বিষয়টি ছেড়েছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ বার মার্কিন গোয়েন্দাপ্রধানের গলায় শোনা গেল সেই উদ্বেগ।
📍
তিনি আরও জানিয়েছেন, ট্রাম্পের নতুন মন্ত্রিসভা এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে এই নিয়ে সবেমাত্র কথাবার্তা শুরু হলেও বিষয়টি উদ্বেগে রেখেছে তাঁদের। সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর ভাবধারা এবং লক্ষ্য একই— ইসলামিক খলিফার নীতি এবং শাসন চালু করা।’’
📍
গত বছর আগস্টে গণআন্দোলনের পরে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। দেশ ছাড়েন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা। তার পর থেকে সে দেশে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। এই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নয়াদিল্লি। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথাও বলেছে। গত ডিসেম্বরে নয়াদিল্লি জানায়, হাসিনা সরকারের পতনের পরে সে দেশে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের ২,২০০টি ঘটনা হয়েছে। বাংলাদেশ যদিও সেই অভিযোগ মানেনি।
📍
চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোর বিকাশও একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। গত কয়েক মাসে দ্রুত বিকাশমান চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলো নানামহল থেকে আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েছে। এই গোষ্ঠীগুলো ধর্মের নামে সহিংসতা ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে তাদের আদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে, যা দেশের শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এদের নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারকে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোর অর্থায়ন ও প্রশ্রয় বন্ধ করতে হবে, তাদের অপপ্রচার ও মিথ্যা প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে সরব হতে হবে।
📍
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি মোটেও স্বস্তির নয়। খোদ প্রধান উপদেষ্টা কিছুদিন আগে বলছিলেন, দেশ এখন এক ধরনের ‘যুদ্ধাবস্থার’ মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থায় সংখ্যালঘু নির্যাতন, ধর্মীয় চরমপন্থার উত্থান এবং আন্তর্জাতিক চাপ দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
📍
যদিও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দাবি, “কোনও নির্দিষ্ট প্রমাণ বা অভিযোগের উপর ভিত্তি না করেই ওই মন্তব্য করেছেন গ্যাবার্ড। আমেরিকার গোয়েন্দাপ্রধানের মন্তব্য গোটা বাংলাদেশকে ‘অন্যায় এবং অতিরঞ্জিত’ ভাবে তুলে ধরা হয়েছে।“
📍
এখন তুলসী গ্যাবার্ডকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার যতোটা হালকাভাবে নিয়ে সরকার প্রধান নিজেকে ‘বড় মাঠের খেলোয়াড়’ বলে ট্যুইস্ট করেছেন সেটা যে কেবলই বাগাড়ম্বর হয়ত খুব শিগগিরই তার প্রমাণ মিলবে। মধ্যপ্রাচ্যে সরাসরি যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সামরিক কর্মকর্তা গ্যাবার্ড যুক্তরাষ্ট্রের সকল গোয়েন্দা বিভাগগুলোর প্রধান হয়েছেন হাওয়া থেকে নয়। তিনি প্রধানত প্রাক্টিসিং হিন্দু, ইসকনের সদস্য এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামী জঙ্গিগ্রুপগুলোর সঙ্গে কনফ্রন্টেশনের অভিজ্ঞতায় চরম র্যাডিক্যাল ইসলামবিরোধী।
📍
নরেন্দ্র মোদী ও ভারতের অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে তুলসী গ্যাবার্ডের প্রধানত: তিনটি ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রথম ইস্যুটি হলো-বাংলাদেশে জঙ্গি ও ধর্মীয় উগ্রবাদ। দ্বিতীয়টি-এই উগ্রবাদীদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ও বিশেষ কিছু দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ও তৃতীয়টি হলো-ধর্মীয় মংখ্যালঘুদের নির্যাতন। জুলাই-আগস্টে জেল ভেঙ্গে জঙ্গিদের পালিয়ে যাওয়া, জেলে থাকা সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গিদের জামিনে মুক্তি দেওয়া। সম্প্রতি পূর্ব ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ সংগঠনের খেলাফত কায়েমের জন্য রাজধানীতের মিছিল করা। এই মিছিলের তথ্যটি তুলসীকে জানিয়েছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। তাদের বক্তব্য- ‘৭ মার্চ নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাহরির ‘মার্চ ফর খিলাফত’ কায়েমের মিছিল করার পূর্ব ঘোষণা দিলেও সরকার কোনও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। ৫ আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর পরই রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় কলেমাখোচিত আইএস-এর কালো পতাকাবাহী মিছিল দেখা গেছে।‘ সেই ছবিগুলোও তুলসীর কাছে পাঠানো রিপোর্টে যুক্ত হয়েছে।
📍
ঢাকার মার্কিন সূত্র মতে ২০২৩ সালে ২০ জুলাই নরসিংদীর জেলা কারাগার থেকে ৯৮ জন ও ২০২৪ সালের ৭ আগস্ট গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে ২০৯ জনসহ মোট ৩০৭ জন জঙ্গি পালিয়ে গেছে। তাদের মতে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আছে ৯টি। বাংলাদেশে আইএস-এর শাখা আছে এমন তথ্য ইউএস-এর স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ২০১৮ সালে তৎকালিন সরকারকে অবহিত করা হয়েছিল। তখন এদের সহযোগী হিসাবে ‘আনসার আল ইসলাম’ ও ‘জামাত-উল-আনসার ফি হিন্দাল’ এর সদস্যদের গ্রেফতারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ৫ আগস্টের পর এই দুই সংগঠনের নেতারা জেল থেকে পালিয়েছে অথবা জামিনে মুক্ত হয়েছে। এরপর এরা দেশের সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থান নিয়েছে, যা এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হতে পারে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠী ও সন্ত্রাসের মদদদাতা দেশগুলো থেকে সাহায্য পাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
📍
এই সমস্ত রিপোর্ট এখন তুলসী গ্যাবার্ডের হাতে। তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক আগে থেকেই কনসার্ন। ২০২১ সালে দুর্গা পূজার সময় একটি মন্দিরে সহিংসতার ঘটনায় ব্যাথীত হয়ে এক্স-এ একটি ভিডিও বার্তা দিয়ে বলেছিলেন-‘ বাংলাদেশের মন্দিরে ভগবানের প্রতি এমন ঘৃণা ও সহিংসতায় তার মন ভেঙে গেছে’। এবার চিন্ময়কৃষ্ণ প্রভুর গ্রেফতার ও জামিন না দেওয়া নিয়েও তিনি একাধিকবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
📍
বাংলাদেশে ধমীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন নিয়ে মোদীর ভারত সরকারের প্রতিবাদ, প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধে বাংলাদেশ সরকার কর্ণপাত করেননি। এবার আসল ট্রাম্প প্রশাসনের প্রায় হাফ ডজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত হাই প্রোফাইলদের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি।
📍
এক তুলসী গ্যাবার্ডের ভারত সফরে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলা কথাগুলো চূড়ান্ত কিছু নয়। তার পর পরই ভারতে আসছে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট এডি ভান্স। তিনি ফিরে যাওয়ার পর আসবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তারও আগে তুলসী গ্যাবার্ডের রিপোর্টর ভিত্তিতে বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট হাতে বাংলাদেশ সফর করবেন ডোনাল্ড লু-এর জায়গায় নিয়োগপ্রাপ্ত পল কাপুর। যিনি সরাসরি ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিন্দু।
📍
এই খবরগুলো বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। ধারণা করা হচ্ছে এদের সফর শেষ হলে ট্রাম্পের চূড়ান্ত পরামর্শর অপেক্ষায় আছেন নরেন্দ্র মোদী। এতেই অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানসহ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, পিআইবি থেকে ভাঙা রেকর্ডের মত বাজানো হচ্ছে-‘এসব বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার’, কিন্তু তুলসী গ্যাবার্ডের যে মন্তব্যটি এখন পর্যন্ত কোনও মিডিয়ায় আসেনি (হয়ত দু’তিনদিন পর আসতে পারে) সেটি শুনলে এইসব ‘অস্বীকারবাদীদের’ মুখটা যে শুকিয়ে যাবে তাতে সন্দেহ নেই।
📍
RAISINA DIALOGUE-এর মিটিং শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তুলসী বলেন- “This should not be tolerating anymore. this is Beyond tolerance. we’ve to take an action immediately. so we ‘ve take a deal very soon.
গত পরশুই তুলসী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার আশা ব্যক্ত করেছিলেন। প্রোটোকল অনুযায়ী সেটা সম্ভব অজিত দোভাল হয়ে ভারতের সেনা ও বিমান বাহিনীপ্রধান মারফতে ‘র’ এর মাধ্যমে। গতকাল রাতেই সেই সাক্ষাতটি হয়েছে। যদিও এর সত্যতা কসেচেকড নয়। তুলসী গ্যাবার্ডের সঙ্গে ছিলেন অজিত দোভাল ও ‘র’ এর ডিরেক্টর রবি সিনহা। প্রায় ৩৫ মিনিটের এই সাক্ষাতের রিপোর্ট বাইরে আসেনি। শুধু এতটুকু ফিলার পাওয়া গেছে যে সাক্ষাতটি ছিল সৌহার্দপূর্ণ। তুলসী শেখ হাসিনাকে বলেছেন-Our President assured that you will be back soon to your country……… যে এক্স বার্তাটি ট্রাম্প দিয়েছিলেন ১৩ মার্চ, এবং যেটা আদৌ ট্রাম্পের কীনা তা নিয়ে কম হুলস্তুল হয়নি।
………………………
১৮ মার্চ ২০২৫