বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের চীন সফরের মাত্র এক সপ্তাহ আগে আজ ১৮ই মার্চ, মঙ্গলবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন সিনেটর ঢাকায় এসে দেশের তিন বাহিনীর প্রধান এবং গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
তিনি গত দুই বছর ধরে আটকে থাকা দুটি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সংক্রান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী এবং নৌবাহিনীকে রাজি করানোর চেষ্টা করছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সিনেটর ও অস্ত্র ক্রয় সংক্রান্ত কমিটির চেয়ারম্যান গ্যারি পিটার্স (মিশিগান ১৪তম কংগ্রেসনাল ডিস্ট্রিক্ট) ইউনূসের আমন্ত্রণে ঢাকায় এসেছেন।
তিনি আজ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল হাসান মাহমুদ খান, নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান এবং ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে বৈঠক করেন।
ইউনূস প্রশাসন পিটার্সের সফরের বিস্তারিত প্রকাশে সতর্ক থাকলেও, সশস্ত্র বাহিনীর অন্তত দুজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার সুত্রে জানা যায় যে, পিটার্স দুটি স্পর্শকাতর প্রতিরক্ষা চুক্তি— অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট (আকসা) এবং জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট (জিসোমিয়া)— চূড়ান্ত করতে তিন বাহিনীর প্রধানদের সম্মত করানোর চেষ্টা করেছেন। এই চুক্তি দুটি গত দুই বছর ধরে আটকে রয়েছে।
আকসা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে মার্কিন সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর কাছ থেকে খাদ্য, জ্বালানি, পরিবহন এবং গোলাবারুদের মতো সাধারণ সরবরাহ ও সেবা ক্রয় ও মূল্য পরিশোধ করতে পারবে এবং বাংলাদেশও একই সুবিধা প্রাপ্ত হবে।
অন্যদিকে, জিসোমিয়া চুক্তি বাংলাদেশকে মার্কিন তৈরি সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের সুযোগ দেবে এবং দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় ও উচ্চমানের সামরিক প্রযুক্তি বিক্রির পথ সুগম করবে।
এই চুক্তি গোপন সামরিক ও গোয়েন্দা তথ্য সমানভাবে সুরক্ষিত করার নিশ্চয়তা দিয়ে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি তথ্য আদান-প্রদানের সুযোগও তৈরি করবে। ভারতসহ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ৫০টির বেশি দেশ ইতোমধ্যে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।
২০১৮ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি করতে আগ্রহী এবং চুক্তির খসড়াও প্রস্তুত করে ফেলেছিল। এই খসড়া নিয়ে বারংবার যোগাযোগ করে তার পররাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ের সাথে, ২০২৪ সালের নির্বাচনে আগে ও পরে প্রায় এক ডজন মার্কিন কূটনীতিক বাংলাদেশে আসে এই চুক্তির বিষয়ে সরকারের মনোভাব পরিবর্তনের জন্য।
এই খসড়ায় ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে এই অস্ত্র ক্রয় বাবদ বিনা সুদে ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতেও প্রস্তুত ছিল, যা শোধ করতে লম্বা সময় দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশ সরকারকে। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার এই চুক্তির বিরোধিতা করেছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারের অবস্থান ছিল “সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়”। অর্থাৎ, বাংলাদেশ কারও সঙ্গে যুদ্ধ করবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মনোভাব ছিল এমন যে, “আমরা তো অস্ত্রভাণ্ডার সৃষ্টি করতে চাই না। কারণ আমাদের তা প্রয়োজন নেই। আমরা খুবই শান্তিপ্রিয় দেশ। সব প্রতিবেশীর সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক রয়েছে। অস্ত্র সংগ্রহ করলেই যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব চলে আসে। আমরা এতে নেই। তোমাদের (যুক্তরাষ্ট্র) অন্যান্য প্রযুক্তি আছে, সেটা আমাদের দাও। অস্ত্র আমাদের খুব কম প্রয়োজন।”
ধারণা করা হয়, এই চুক্তির বিরোধীতার জন্যি শেখ হাসিনা সরকার মার্কিন প্রশাসন, অর্থাৎ বাইডেন প্রশাসনের বিরাগভাজন হয়। যার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ স্টেটের কালো থাবা পড়েছিল শেখ হাসিনা সরকারের ওপর।
শেখ হাসিনা জানতেন, এই চুক্তিগুলোর কিছু ভয়াবহ দিক রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এসব চুক্তি করার অর্থ হলো, অস্ত্র ও তথ্য প্রাপ্তির বিনিময়ে মার্কিন স্বার্থে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য থাকতে হবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু দেশ যদি বাংলাদেশের মিত্রও হয়, তবে মার্কিন স্বার্থে সেসব দেশে যুদ্ধ বা অন্য কোনো কারণে অস্ত্র-সেনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য থাকতে হবে। যা মিত্র দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
তাই দূরদর্শী চিন্তা থেকে এসব চুক্তিতে অগ্রসর হননি শেখ হাসিনা। বরং বিকল্প দেশ থেকে সামরিক সরঞ্জাম এবং অস্ত্র ক্রয়কে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে তুরস্কের সাথে বেশ কিছু চুক্তি করেন তিনি। চুক্তির শর্ত অনুসারে তুরস্ক তাদের সামরিক সরঞ্জাম বাংলাদেশে উৎপাদনে সম্মতও হয়েছিল। তুরস্ক থেকে কিছু সার্ভেইল্যান্স এবং অ্যাটাক ড্রোন সিস্টেম কিনেছিল বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ তার ফোর্সেস গোল-২০৩০ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকীকরণের পাশাপাশি অস্ত্র ও সরঞ্জাম ক্রয়ে একক দেশের ওপর নির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিল।
এই লক্ষ্যে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ক্রয়ের পরিকল্পনা করছে বলে সেসময় অনেক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রথমবারের মতো মার্কিন অস্ত্র ব্যবস্থা ক্রয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। পাশাপাশি, উচ্চমূল্যে মার্কিন অস্ত্র না কিনে অনেক কমদামে ইতালি, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, ভারত, চীন, তুরস্ক থেকে অস্ত্র ক্রয়েও আগ্রহ প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশ।