।। মনজুরুল হক ।।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও ডীপস্টেটের আশা ছিল নির্বাচন ভন্ডুল হবে, একটা এনার্কি তৈরি হবে। হয়নি। সেই থেকে তাদের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের আড়ালে ফান্ডিং শুরু। ২০২১ সালেই বাংলাদেশ চূড়ান্ত সুপারিশ পায় যে ২০২৪ সাল নাগাদ LDC থেকে উত্তরণ ঘটবে। অর্থাৎ উন্নয়ন সাহায্য বন্ধ হয়ে যাবে। সেই সুযোগে বাড়তে থাকে ইউএসএআইডি’র ফান্ড। প্রায় চল্লিশটির মত প্যারাসাইট এনজিও ভেতরে ভেতরে তৈরি হতে থাকে…. এই এনজিও, জামাত, হিজবুত, হেফাজত, আনসারুল বাংলার মত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী র্যাডিক্যাল ইসলামিস্ট (যাদের বীজ-সার-মাটি শেখ হাসিনাই যুগিয়েছিলেন), বিএনপির ফার রাইট গ্রুপ, ধর্মাশ্রয়ী কয়েকটি বাম লিবারাল সংগঠন, সশস্ত্র বাহিনীর পাকিস্তানপন্থী অংশ এবং বিশ্বজুড়ে ‘সুনাম’ আছে সেই ড. ইউনূসের সুপরিকল্পিত ছকে একটা নখদন্তহীন কোটাবিরোধী আন্দোলনকে ‘স্টাইকার’ ধরে ‘সিভিকোমিলিটারি ক্যু’ ঘটিয়ে শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করে ক্ষমতা দখল করেছে। এই পট পরিবর্তনকে এখনও যারা ‘জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান’ বলে ষড়যন্ত্রকারীদের হাত শক্তিশালী করছেন তারা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকে, ৩০ লক্ষ শহিদকে, ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমকে অসম্মান করছেন।
🔘
ইন্টেরিম সরকার গত সাত মাসে সকল ক্ষেত্রে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। গত জানুয়ারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই ইউএসএআইডি’র ফান্ড বন্ধ করে দেন। আইএমএফ ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ ঝুলিয়ে রেখেছে। ইউরোপের বিভিন্ন অনুদান বন্ধ। ভারতের ঋণ বন্ধ। ভারত এক্সপোর্টও অর্ধেক করে দিয়েছে। একটা টাকা বিদেশি ইনভেস্টমেন্ট নেই। সকলপ্রকার উন্নয়ন প্রজেক্ট বন্ধ। ২ লাখের ওপর মানুষ চাকরি হারিয়েছে। ইনফ্লাশন ১২-র ওপরে। দেশীয় শিল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। আমনের ভরা মৌসুমেও চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ১৭ টাকা।
🔘
ঠিক সেই সময়ে জাতিসংঘের মসহাসচিবকে ডেকে এনে কোন ‘লাইফ সাপোর্ট’ পেল বাংলাদেশ? আন্তেনীয় গুতারেস এসে ড. ইউনূসের সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে গিয়ে সলিডারিটি জানিয়েছেন, ইফতার করেছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আশ্বাস শুনিয়েছেন। বাস্তবতা হলো ড. ইউনূস এবং গুতারেস এক বছর কেন? দশ বছর চেষ্টা করলেও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না। এর মধ্যে ড. ইউনূস রোহিঙ্গাদের সমাবেশে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ভাষণ দিয়ে নতুন বিপদ তৈরি করেছেন। মিয়ানমার জান্তা সরকার বহুদিন ধরে বলে আসছে-‘রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের চট্টগ্রামের অধিবাসী। তারা মিয়ানমারে মাইগ্রেট করেছিল।‘ এবার তারা বিশ্ব মিডিয়াকে ডেকে ডেকে বোঝাবে-‘এই দেখুন ড. ইউনূস তার স্বজাতি স্বগোত্রের সঙ্গে নিজস্ব ভাষায় কথা বলছেন!’
🔘
আচ্ছা মহাসচিব কী একটিবারও শুনতে চেয়েছেন এখানে অন্যান্য সংখ্যালঘুদের কী অবস্থা? কেন হিন্দুদের মন্দিরগুলো ভাঙা হয়েছে? কেন ৮৫টা মাজার ভাঙা হয়েছে? কেন সনাতনীদের ধর্মগুরু জেলে বন্দী? কেন ‘তৌহিদী জনতা’ নামক মব দেশজুড়ে ভায়োলেন্স করে বেড়াচ্ছে? কেন তারা নারীর পোশাক ঠিক করে দিতে চাচ্ছে? কেন তারা নারীকে বাইরে বের হতে নিষেধ করছে? কেন আগস্টের পর আওয়ামী লীগ করার অপরাধে অসংখ্য শিল্প-কারখানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে? কেন সংস্কারের নামে উগ্র ইসলামিস্টটা রাষ্ট্রের চালক হয়ে বসেছে? কেন দেশের মানুষ নিরাপত্তাহীন? কেন মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা সংগ্রামের সকল স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলা হয়েছে? কেন দেশজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আইসিস, আল-কায়েদার পতাকাবাহী সশস্ত্র লোকজন?
🔘
না। এই তালিকা থেকে একটি প্রশ্নও তিনি করেননি। কেন করবেন? তিনি তো এসছেন প্রিয় বন্ধু ড. ইউনূসকে রক্ষা করতে। সারা বিশ্ব জ্বলেপুড়ে খাক হলে এই গুতেরাসই বাণী দেন-‘দুঃখজনক’! এটাই গুতেরাসের হিপোক্র্যাসি।
🔘
তাহলে মহাসচিব সাহেবকে দিয়ে ড. ইউনূস কী করতে চাইছেন? যে অঞ্চলটি অনেকদিন ধরেই চরম অশান্ত। কিছুদিন আগে আরাকান আর্মি তাদের নতুন সর্ববৃহৎ বন্দর কিয়াউকপিউ দখল করে নিয়েছে। যেখানে চীন-মিয়ামনমার ইকোনমিক করিডোর, ন্যাভাল বেজ, স্থায়ী আর্মি সেনানিবাস তৈরি হচ্ছিল। এখানে চীন লগ্নি করেছিল ৯ বিলিয়ন ডলার বা ৮০ হাজার কোটিরও বেশি। এই পুরো টাকাটা জলে যাচ্ছে। জুন্টা সেনারা পোড়ামাটি নীতিতে বোম্বিং করছে। আরাকান আমিও পোর্টের দখল নেওয়ার জন্য মরিয়া। ফলে এখানকার চীনা-বার্মিজ-আরাকানি মিলেয়ে ৪ হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।
🔘
বঙ্গপোসাগরের ন্যাচারাল রিসোর্স, মাইনিং, সী রিসোর্স এবং সী-এন্ট্রি মিলিয়ে এই অঞ্চল এখন বিশ্বের পরাশক্তির শক্তিগুলোর রাডারে। ভারতের সিটিইউ বন্দরে ‘কালাদান প্রজেক্ট’। রাখাইন দখলে রাখা নিয়ে আরাকান আর্মি ও জুন্টা বাহিনীর মরণপণ লড়াই। সে সময় গুতারেসের এই সফর বিশ্বের নজর আকর্ষন করার একটা স্ট্রাটিজি। এই এক্স ডিপ্লোম্যাট গুতারেস সাহেবেরও এখন ‘গরু হারানোর’ দশা। তা না হলে তার মুখ থেকে ড. ইউনূসকে সমর্থন জানাতে গিয়ে এমন কিছু শব্দ উঠে এসেছে যা বাঙালি জাতিস্বত্ত্বার ওপর খবরদারির সামিল।
🔘
ড. ইউনূস পশ্চিমের সুনজর থেকে সরে গেছেন। তাই তার দরকার নতুন শক্তিশালী বন্ধু। ধরা যাক সেটা চীন। চীনের সঙ্গে তিনি সম্পর্ক উন্নয়ন ঘটিয়ে শক্তি এবং অর্থ দুটোই পেতে চান। বেশ। তাহলে গুতারেস কেন? তিনি চীনের বিরুদ্ধে কেন? তিনি তো আমেরিকার প্রতিনিধি নন।
🔘
আসল বিষয় হলো ওই – ইউএসএআইডি’র ফান্ড। প্রায় চল্লিশটির মত প্যারাসাইট এনজিও, মাইলাম নামক সেই পুরোনো ডিপ্লোম্যাট, ডোনাল্ড লু, ফলকার টুর্ক, এরা সব এক রসুনের গোঁড়া। এরা বাংলাদেশকে ‘খাওয়ার’ পর এখন রোহিঙ্গা রিপ্যাট্রিয়েশন করাতে চান! রিপ্যাট্রিয়েশন মানে পরিষ্কার, ইন্টারফেয়ারেন্স রাখাইন স্টেট অব বার্মা। অর্থাৎ এখানেও তিনি একটা ঘুলুট পাকাবেন।
অনেকেরই মনে আছে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু আন্তেনীয় গুরারেসকে ইসরায়েলে ঢুকতে দেয়নি। সরাসরি ব্যান করেছিল। নেতানিয়াহুর বক্তব্য ছিল-“আমরা যে প্যালেস্টাইনিদের মেরেছি তা নিয়ে আপনি তীব্র নিন্দা করেছেন, কখনও কী ৭ অক্টোবরে হামাস যে নারী-শিশু মিলয়ে ১৩শ’ ইহুদীকে হত্যা করেছিল, তাদেরকে নিন্দা করেছেন? করেননি।“
🔘
বাংলাদেশে এখন সরকারের সামান্যতম সমালোচনাকারীদের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ। তার পরও আছিয়া নামের ৮ বছরের মেয়েটির মানবতার নিকৃষ্টতম নিপীড়ন-বলাৎকারে মৃত্যু হয়েছে। সারাদেশ তো বটেই, বিশ্ব মিডিয়ায়ও বিষয়টি অবিশ্বাস্য ঘটনা হিসাবে আলোচিত হয়েছে। বলা হচ্ছে বাংলাদেশে ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে কোনও নারী নিরাপদ নয়। এমন একটা বিষয়ে কী গুতেরাস ঔৎসুক্য দেখিয়েছেন? না। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্ন করতে না দেওয়া এক সংবাদ সম্মেলন করেছেন।
🔘
ফলকার টুর্ক যখন কথাচ্ছলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সতর্ক করেছিলেন যেন শেখ হাসিনাকে সাপোর্ট না করা হয়। আইএসপিআর থেকে টুর্কের সেই বক্তব্যের প্রতিবাদ করা হয়েছে। তার পরও ইউএন চিফ, হিউম্যান রাইট চিফ, রিফিউজি চিফকে ঢাকায় এনছেন ড. ইউনূস। এরপর এসেছেন প্রাক্তন অ্যাম্বাসেডর উইলিয়াম বি মাইলাম। এসবের উদ্দেশ্য কী?
🔘
উদ্দেশ্য সিম্পল। একে একে সকল দুয়ার বন্ধ হওয়ায় ড. ইউনূসের সামনে এখন দুটো মাত্র পথ খোলা। হয় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা, যার প্রভাবে ট্রাম্পের শ্যেন দৃষ্টি থেকে পরিত্রাণ, অথবা ইসলামি র্যাডিকালাইজেশনের হাতের পুতুল হয়ে পাকিস্তানের পরিণতি বরণ।
🔘
মনে রাখতে হবে; গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ বিষয়ে ট্রাম্পের ‘মোদীর ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া’র পর মোদী বাংলাদেশ নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। যা করার করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। তিনি বলেছেন-‘Make up your mind’। এর মানে দাঁড়ায় হয় ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলুন নয়ত আমরা সেকেন্ড অপশন হিসাবে আপাদেরকে ‘পাকিস্তানের মত’ ট্রিট করতে বাধ্য হব।
🔘
এখন এইসব ক্যারিয়ার ব্যুরোক্র্যাট, প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত, ইউএন-এর একাধিক বিভাগের চিফ ডেকে এনে বিশ্ব মিডিয়ার নজর বাংলাদেশে নিবদ্ধ করতে চাইলে কী দেখবে তারা? গত সাত মাস ধরে দেশটা চরম নৈরাজ্যিক অবস্থায় পড়েছে। ইসলামিক র্যাডিক্যালদের উত্থান, দেশজুড়ে মব ভায়োলেন্স, খু.নো.খু.নি, হা.না.হা.নি, লুটপা.ট অগ্নি.সংযোগ, আইনের চরম বত্যয়, ‘তৌহিদী জনতা’ নামের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী, স্পেশাল মিলিশিয়া গঠনের মত ফ্যাকচ্যুয়াল সিভিল ওয়্যারের দিকে ধাবিত হওয়া দেশ।
এইমুহূর্তে বড় শঙ্কা হচ্ছে যুদ্ধের শঙ্কা। সেটা বুঝেই ড. ইউনূস কয়েকদিন আগে ভারতের ‘সেভেন সিস্টার’ বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করতে পারার ছাড়পত্র দিতে চাইছেন। পাশাপাশি চীনকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে মোকাবেলাও করতে যাচ্ছেন।
🔘
জিওপলিটিক্যাল লজিকে চীনের এইমুহূর্তে বাংলাদেশকে পাশে দরকার এটা ঠিক। তাই বলে ভারতকে চটিয়ে? মোটেও না। ট্রাম্প এসেই চীনের ওপর ২৫% ইম্পোর্ট ডিউটি আরোপ করায় চীনের বাজার সংকুচিত হয়েছে। সেখানে ভারতের ১৪০ কোটির বড় বাজার সে হাতছাড়া করতে চাইবে না। বিশ্ব আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত গতিতে জিওপলিটিক্যাল মোড চেঞ্জ করছে। ট্রাম্প কানাডাকে দ খ ল করার কথা বলে শত্রু বানিয়ে ফেলেছে। আবার ইউক্রেন ইস্যুতে ডোনেশন বন্ধ করে ইইউর বিরাগভাজন হয়েছে। এখন কানাডা, ইউকে ও ইইউ মিলে আমেরিকার বিপক্ষে চলে গেলে অবাক হওয়া যাবে না। আবার রাশিয়া-চীন-ভারত মিলে একটা অক্ষশক্তি গড়ে তোলার বিষয়টাও তিন দেশের প্রাইম লিস্টে আছে।
🔘
সুতরাং ড. ইউনূস চীনকে ঋণের সুদ কমাতে অনুরোধ করবেন। নতুন ঋণ চাইবেন। এসবের বিনিময়ে যদি চীনকে তিস্তা প্রজেক্ট তুলে দেন বা চীন যদি চাপে ফেলে নিয়েও নেয় তাতেও সংকট মিটবে না, কারণ তিস্তা প্রজেক্টের খুব কাছে ভারতের ‘চিকেনস নেক’। সেটা অরক্ষিত মনে হলে ভারত বসে থাকবে না।
🔘
এরই মধ্যে আবার শেখ হাসিনার ‘প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেশে ফেরা’ নিয়ে ট্রাম্পের এক্স হ্যান্ডেল বার্তা ঠিক না বেঠিক তাই নিয়ে ধুন্ধুমার বিতর্ক শুরু হয়েছে। সেনাপ্রধান ওয়াকার -উজ-জামানের সঙ্গে সরকারের ‘সুসম্পর্ক’ জার্ক করেছে। দেশে ‘টিনি ক্যু’এর প্রতিবাদ করেছে আইএসপিআর। তার পরও বাতাস তো থেমে থাকে না। কম-বেশি অনেকেই জানে উত্তর পাড়ায় চারটি ফ্যাকশন উপলব্ধ। প্রো পাক, প্রো ইন, প্রো বাং এন্ড নিউট্রাল।
🔘
দেশ এখন যেভাবে চলছে তাতে আগামী কয়েক মাসে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে। আমরা সাধারণ নাগরিকরা যেসকল বিষয় নিয়ে আশঙ্কা করছি, দেখা গেল সেই সকল বিষয়ে ইন্টেরিম গভর্নমেন্টের আশঙ্কা নেই। তবে আশঙ্কা থাকুক না থাকুক অরাজকতা বাড়তে থাকলে র্যাডিক্যালাইজেশনের ‘প্রজেক্ট’ সাকসেসফুল হবে। বাংলাদেশর অবস্থা সিরিয়ার মত হয়ে উঠতে পারে।
………………………
১৭ মার্চ ২০২৫