।। অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত ।।
গত ১৬ মার্চ ২০২৫ দিবাগত রাতে বরগুনার আমতলী উপজেলায় ইসমাইল শাহ মাজারে বার্ষিক ওরস চলাকালে উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর বর্বর হামলার ঘটনা ঘটে, যেখানে অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের স্থানীয় নেতাদের নেতৃত্বে শতাধিক ব্যক্তি মাজারপূজা ও গানবাজনা বন্ধের দাবি জানায়, যা প্রত্যাখ্যান করায় সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। মাজারের শামিয়ানা ও বৈঠকখানায় অগ্নিসংযোগ করা হয়, দানবাক্স লুট করা হয়, এবং সুফি অনুসারীদের ওপর নির্মমভাবে হামলা চালানো হয়। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং সাম্প্রতিক সময়ে সারাদেশে ঘটে যাওয়া ধারাবাহিক ধর্মীয় সহিংসতারই একটি অংশ।
বাংলাদেশে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ঐতিহ্য বহু পুরোনো, যেখানে সুফিবাদ ও মাজার সংস্কৃতির প্রতি মানুষের গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। অথচ, গত ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলে, উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো যেন আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। গত ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১০০টিরও বেশি মাজারে হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট এবং ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এই নৃশংস কার্যকলাপের মূল লক্ষ্য ছিল সুফি ধারার অনুসারীদের দমন করা, তাদের ধর্মীয় চর্চা ও ঐতিহ্যকে নিশ্চিহ্ন করা এবং দেশে একটি উগ্রবাদী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।
সিলেটের শাহপরান মাজারে গত ১৫ অক্টোবর ২০২৪ সালে ওরস চলাকালে হামলা চালানো হয়। হামলাকারীরা মাজারের ভেতরে ঢুকে ভক্তদের ওপর হামলা চালায়, তাদের কুপিয়ে আহত করে এবং দরগাহের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভেঙে ফেলে। একইভাবে, ২৮ নভেম্বর ২০২৪ সালে চট্টগ্রামের বায়েজিদ মাজারে একদল উগ্রপন্থী পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়ে মাজারের মূল ফটক পুড়িয়ে দেয়, দানবাক্স লুট করে এবং আশপাশের দোকানপাট ভাঙচুর করে।
রাজশাহীর চন্দ্রপ্রভা মাজারে ১২ জানুয়ারি ২০২৫ সালে গভীর রাতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে অন্তত ১০ জনকে গুরুতর আহত করা হয়। সেই রাতে কয়েকটি কবর ও স্মৃতিস্তম্ভও ধ্বংস করা হয়। কুমিল্লার দরগাহ মাজারেও গত ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে একই ধরনের ঘটনা ঘটে। হামলায় সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হলেও, সরকারের অদক্ষতা ও নীরবতার কারণে অনেকেই জামিনে মুক্তি পেয়ে পুনরায় সংগঠিত হয়েছে।
সরকারের নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতা এই ধরনের সহিংসতাকে আরও উৎসাহিত করছে। মাজার ও সুফি সম্প্রদায়ের অনুসারীরা ভয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, কিন্তু সরকার ও প্রশাসন কার্যত নিশ্চুপ। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হামলার পর ঘটনাস্থলে গেলেও, তারা দোষীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি, হামলার শিকার ব্যক্তিরা থানায় মামলা করতে গেলেও অনেক ক্ষেত্রে মামলা নেয়া হয়নি, আর মামলা নিলেও অপরাধীদের চিহ্নিত করার পরেও তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। সরকারের এই নীরবতা একপ্রকার মৌন সমর্থনেরই ইঙ্গিত দেয়।
দেশের সংবিধান সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সমান অধিকার দিয়েছে, ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে সেই অধিকার আজ মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা, রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির নোংরা খেলা এবং ধর্মীয় উগ্রবাদীদের মদদ দেওয়ার ফলে বাংলাদেশ একটি গভীর সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে।
এই সহিংসতার লাগাম টানতে এখনই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
প্রথমত, দোষীদের চিহ্নিত করে দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত, যাতে এই হামলার পেছনের প্রকৃত ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচিত হয়। যারা এসব হামলাকে সমর্থন বা প্রশ্রয় দিচ্ছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।
দ্বিতীয়ত, মাজার ও অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। পুলিশের উপস্থিতি বাড়ানো, সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবস্থা করা এবং নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ করা জরুরি। ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখতে স্থানীয় প্রশাসন ও ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে সমন্বয় তৈরি করতে হবে।
তৃতীয়ত, ধর্মীয় শিক্ষার নামে যেসব প্রতিষ্ঠানে উগ্রবাদ ছড়ানো হচ্ছে, সেগুলোকে চিহ্নিত করে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। মুক্তচিন্তার পক্ষে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় সহাবস্থান বজায় রাখতে শিক্ষা কার্যক্রমের পুনর্বিন্যাস করা জরুরি। উগ্রবাদ ও সহিংসতা থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমেও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
সরকার যদি দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়, তবে বাংলাদেশ আরও গভীর সংকটে নিমজ্জিত হবে। ধর্মীয় সহিংসতা, উগ্রবাদী গোষ্ঠীর দৌরাত্ম্য এবং প্রশাসনের ব্যর্থতা দেশের স্থিতিশীলতার জন্য এক মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠছে। এই মুহূর্তে নীরবতার সময় নেই; সরকারকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা মৌলবাদী সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেয় না। অন্যথায়, ভবিষ্যতে এর চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য দেশকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
[লেখকঃ
বাংলাদেশি মানবাধিকার আইনজীবী, ফ্রান্স সরকারের ম্যারিয়ান ইনিশিয়েটিভ ফর হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার্স লরিয়েট ২০২৩ এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, জাস্টিসমেকার্স বাংলাদেশ ইন ফ্রান্স (জেএমবিএফ), ওয়েবসাইটঃ https://www.jmbf.org, ইমেইলঃ shahanur.islam@jmbf.org]