।। সৈয়দ ইফতেখার হোসেন ।।
মধ্যপ্রাচ্য বা আরব দেশগুলোতে অথবা দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে কিংবা এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যেসব অশান্তি বা সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে, অথবা অনিয়মতান্ত্রিকভাবে সরকার পরিবর্তন হয়েছে তার পিছনে বিশ্বের কোনো কোনো পরাশক্তির মদদ হয়তো ছিল কিন্তু পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে কখনো কখনো জাতিসংঘের সহায়তা, নির্লিপ্ততা বা উস্কানি এই সব অপকর্ম করতে নানা ধরণের অপশক্তিকে সহায়তা করেছে যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ বর্তমান বাংলাদেশে।
বাংলাদেশ তথা এশিয় দেশগুলোতে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে নানা বিষয়ে গণআন্দোলন কোনো নতুন বিষয় নয়। এমন আন্দোলনের ফলে অনেক সময় কোনো কোনো দেশে সরকারেরও পতন হয়েছে। থাইল্যান্ড এই ক্ষেত্রে অনেক বেশি অগ্রগামী। এরপর পাকিস্তান, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল ও বাংলাদেশের উদাহরণতো রয়েছেই। শুধু মাত্র ব্যতিক্রম ভারত। প্রায় ক্ষেত্রে বিদেশি শক্তিগুলো তাদের নিজস্ব স্বার্থে এইসব আন্দোলনে নানা ধরণের সহায়তা জুগিয়েছে। তার জন্য তারা যেসব কৌশল অবলম্বন করে তাকে রাজনীতিতে বলা হয় ‘ডিপ স্টেট’, যার অর্থ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রকে নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে অস্থিতিশীল করার জন্য এইসব দেশে এক শ্রেণির সুবিধাভোগী সুধী সমাজকে ‘কায়েমি স্বার্থ’ হিসেবে পালন পোষণ করা এবং এক সময়ে তাদের নিজ দেশের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো। এইসব কর্মকাণ্ডের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় নানা ধরণের বেসরকারি সংস্থা, যাকে বলা হয় ‘এনজিও’। এইসব এনজিও জনকল্যানকর কাজের অজুহাতে বিদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণের অর্থ জোগান পায়। বর্তমানে একটি নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা থেকে হঠিয়ে অসাংবিধানিকভাবে ড. ইউনুস যে বেআইনী সরকার গঠন করেছেন তার বেশিরভাগ সদস্যই এমন সব এনজিও পরিচালনা করেন। ১৯৬৩ সালে হলিউডে ’দি আগলি আমেরিকান’ (কুৎসিত আমেরিকান) নামে একটি চলচিত্র নির্মিত হয়েছিল, যা নিয়ে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। ছবিটি থাইল্যন্ডে (সারখান ছদ্মনামে) রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টিকে কেন্দ্র করে। ১৯৫৩ সালে ইরানের নির্বাচিত সরকারকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একই পন্থায় উৎখাৎ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের প্রথম এমন রাজনৈতিক কুকর্মের যাত্রা শুরু করেছিল।
গত আগস্টে বাংলাদেশের দীর্ঘতম ক্ষমতাসীন নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের জন্য ‘সূক্ষ্ম পরিকল্পনা’ এবং শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনে জাতিসংঘ ও মার্কিন যুক্তরাষ্টে্রর যে বিশাল ভূমিকা ছিল, তার কালো বিড়াল অবশেষে ঝুলি থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এরই মধ্যেই বর্ণনা করেছেন কিভাবে তার পূর্বসূরী জো বাইডেন সরকার বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য নানা ধরণের কর্ম পরিকল্পনা প্রস্তুত ও তা বাস্তবায়ন করেছিলেন। এই কাজে তিনি তার সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্র সচিব ডোনাল্ড লুকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তাঁকে এই কাজে সর্বাত্মক সহায়তা করেছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। তাঁদের সঙ্গে ছিল এই দেশের ডজনখানেক এনজিও, যাদের কর্মকর্তারা বর্তমানে ইউনুসের বেআইনি সরকারের উপদেষ্টা পদেই শুধু নয় বেশ কয়েকটি গুরুত্ব পদেও রয়েছেন যেমনটা বলেছি। তাঁরা শেখ হাসিনা সরকার উৎখাতের সর্বশেষ সভাটি করেছিলেন ২০২৪ সালের মে মাসে ঢাকায়। সে সভায় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের ছয়টি এনজিওর সিনিয়র কর্মকর্তারা, যার মধ্যে গ্রামীণের ফারহানা ইসলাম ও জেনল্যাবের ইশরাত রউফ অন্যতম।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প এরই মধ্যে বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর পূর্বসূরি জো বাইডেন ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি শক্তিশালী করার জন্য (অস্থিতিশীল করে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যূত করতে) দুই ব্যক্তির মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশে পাচার করেছিল। তিনি এও ঘোষণা করেছেন সব মিলিয়ে এই কাজে বাংলাদেশে ৫০ মিলিয়র ডলার প্রবেশ করেছিল। তার মতে এই বিশাল পরিমাণের অর্থ মূলত বাংলাদেশের দুটি এনজিওর মাধ্যমে বিভিন্ন সরকারবিরোধী কাজে ব্যয় করা হয়েছিল। ট্রাম্প নাম না বললেও এখন জানা যায় এই দুটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বদিউল আলম মজুমদারের ‘সুজন’ ও ইউনূসের উপদেষ্টা রেজওয়ানা হাসানের ‘বেলা’। এই অর্থ বাংলাদেশে বিলিবণ্টনের দায়িত্ব নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংস্থা ‘ইউএসএ আইডি’, ‘এনডিআই’ ও ‘আইআরআই’।
নির্বাচিত শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত করার কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালে। পরে ষড়যন্ত্রকারীরা ড. ইউনূসের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং তাঁকে বলে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যূত হয়ে গেলে তাঁকেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে হতে পারে। এই কথাগুলো একাধিক ষড়যন্ত্রকারি প্রকাশ্যে মিডিয়ার সামনে বলেছেন। অথচ ইউনূস প্রায়শ বলে থাকেন ৫ আগস্টের আগে তিনি কিছু জানতেনই না। ইউনূস বেশ ঠাণ্ডা মাথায় মিথ্যা কথা বলতে পারদর্শি। আবার সেই ইউনূস ওয়াশিংটনে গিয়ে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের এক অনুষ্ঠানে তাঁর বিশেষ সহকারি মাহফুজ আলমকে সবার সামনে পরিচয় করে দেন এই বলে যে, ‘এই সেই তরুণ যে দীর্ঘ দিন ধরে অত্যন্ত সুচারুভাবে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যূত করার পরিকল্পনা করেছিল। কোনো কিছুই হঠাৎ করে হয়নি’।
বিভিন্ন সময় শেখ হাসিনা অভিযোগ করেছেন যে তিনি দক্ষিণে অবস্থিত একটি দ্বীপে (সেন্ট মার্টিন) সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে অস্বীকার করে আমেরিকানদের বিরাগভাজন হয়েছেন। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মূখপাত্র ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে এক বিবৃতিতে বলেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনাকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করছে, যা যুক্তরাষ্ট্র অস্বীকার করে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ও এই বিপদ সংকেত উড়িয়ে দেয়।
যদিও শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যূত করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে ছাত্র আন্দোলন মার্কিন অর্থায়নে পরিচালিত হয়, তবে জাতিসংঘ এর চূড়ান্ত সাফল্যে আরো নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করেছে বলে এখন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধান ভলকার টুর্ক বিবিসিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পরিষ্কার করে দিয়েছেন। এই ব্যক্তিকে ইউনূস নিজ উদ্যোগে আমন্ত্রণ জানিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন, তাঁর ভাষায় ‘জুলাই—আগস্ট মাসে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের শেখ হাসিনা কত নির্মমভাবে নির্যাতন চালিয়েছেন তা অনুসন্ধান করার জন্য। টুর্ক বাংলাদেশে আসেন, ইউনুসের নির্বাচিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলেন। তবে তিনি এও স্বীকার করেন যে, তিনি তাঁর কাজে সরকারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা পাননি। এটি ছিল টুর্কেও একটা চালাকি যাথে তিনি জনগনকে বুঝাতে পারেন তিনি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে কাজ করেছেন । আওয়ামী লীগের একজন সাবেক সংসদ সদস্য একটি বিদেশি গণমাধ্যমে বলেন তিনি টুর্কের সঙ্গে কথা বলতে চেয়ে চিঠি দিয়ে বিফল হয়েছেন।
ফিরে গিয়ে টুর্ক জাতিসংঘে একটি গোঁজামিলের একপেশে প্রতিবেদন দাখিল করেন। তাঁর প্রতিবেদনে তিনি স্বীকার করেন শেখ হাসিনা যখন দেশে তাঁকে হটানোর জন্য বিক্ষোভের নামে যে নৈরাজ্য চলছিল তা নিয়ন্ত্রণ করতে সেনাবাহিনীকে (সেনাপ্রধান ? ) নির্দেশ দেন, তখন টুর্ক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে ‘জুলাই—আগস্ট ২০২৪ সালের ছাত্র বিক্ষোভ দমনে সেনাবাহিনী জড়িত হলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন থেকে তাদের নিষিদ্ধ করা হবে।’ (প্রতিবেদনের ১৩৭ পংক্তি)। অথচ বাংলাদেশে দেশের মানুষের জানমাল রক্ষা করার কাজে বেসামরিক প্রশাসনকে সহয়তা করা দেশের সশস্ত্রবাহিনীর সাংবিধানিক দায়িত্ব। বিশ্বের সব স্বাধীন দেশেই একই ব্যবস্থা চালু আছে। কদিন আগে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে একটি সামরিক ট্রেন ছিনতাই করেছিল ‘বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি’ নামক একটি সংগঠন। জিম্মি করা হয় ট্রেনের সব যাত্রীকে। সেই জিম্মিদের উদ্ধার করতে গিয়ে ২৮ জন সেনা সদস্যের প্রাণহানি ঘটে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে ভারতেরও সেনা সদস্য আছে। তাই বলে তাদের নিজ দেশের প্রতি তাদের যে দায়িত্ব আছে তা তারা ভুলে যাননি। ভারতের পশ্চীম সীমান্তে কাশ্মিরের জঙ্গিদের সঙ্গে নিয়মিতভাবে ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। প্রয়োজনে সেনাবাহিনী তলব করা হয়। তাদের ক্ষেত্রেতো টুর্ক কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস রাখেন না। বর্তমানে নেপালে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে একটি গণআন্দোলন চলমান । সেই আন্দোলন মোকবেলায় প্রয়োজনে সরকার সেনাবাহিনী ডাকতে পারে । নেপাল বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষাকারি বাহিনীতে যে সকল দেশ সেনা পাঠায় তার শীর্ষে অবস্থান করছে । নেপাল তার দেশের স্বার্থে যদি তাদেও সেনাবাহিনী তলব করে তাহলে কি সেই দেশের সেনাবাহিনী শান্তিরক্ষা মিশনে নিষিদ্ধ হবে? কখনো না ।
আর্থিক কারণে বাংলাদেশে সেনাবাহিনী বর্তমানে অনেকটা ভাড়াটে বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা তাদের কাছে এখন গৌণ। সরকারের অজান্তে এই বাহিনীতে সহজে ঢুকে পড়েছে একটি বিরাট বাংলাদেশবিরোধী অপশক্তি। এদের কাছে দেশের প্রতি দায়িত্ববোধের চেয়ে জাতিসংঘের মিশনে গিয়ে কিছু অর্থ কামানো বা অন্যেও হয়ে দেশবিরোধী কাজ করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের ধারণা মিশনে কাজ করলে বাহিনীর জন্য পেশাদার মর্যাদা এনে দেয় যা মোটেও সত্য নয়। অথচ সেনাপ্রধান ওয়াকারউজ্জামান সেদিন আরো একটু দায়িত্বশীল হলে আজ বাংলাদেশ একটি অবৈধ সরকারের দুঃশাসনের ফলে ধ্বংসের যে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে তা হয়তো রোধ করা যেত। অবশ্য এরই মধ্যে সশস্ত্র বাহিনী থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ভলকার টুর্কের বক্তব্যকে অস্বীকার করেছে। তাহলে তো সরকারের উচিৎ বিষয়টা আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের কাছে প্রতিবাদ করা।
তাই যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা ছাত্রদের গণ—বিক্ষোভ মোকাবেলায় সেনাবাহিনীকে আহ্বান জানান, তখন তিনি খুব কমই জানতেনই না যে জাতিসংঘের হুমকির কারণে সেনাবাহিনী চলমান অযৌক্তিক সংঘাতময় আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রয়োজনিয় ব্যবস্থা নিবে না এবং দেশকে এক ভয়াবহ অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে ফেলে দিবে যার ফলাফল শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয় বিশে^র মানুষ দেখছে। এক কথায় ভলগার টুর্কের হুমকিতে সেনা বাহিনী দেশের সাথে বিশ^াসঘাতকতা করেছে, তাদেও শপথ ভঙ্গ করেছে । যে দেশটি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সামিল হওয়ার জন্য ক্ষণ গুনছিল সেই দেশ বর্তমানে দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। আন্তর্জাতিক একাধিক সংস্থা জানিয়েছে এমনভাবে দেশ চলতে থাকলে বাংলাদেশে দূর্ভিক্ষ বা খাদ্যাভাব অত্যাসন্ন। সেনাপ্রধান ওয়াকারউজ্জামান আগস্টের চার তারিখ রাতেও শেখ হাসিনাকে অভয় দিয়েছিলেন সব তাঁর নিয়ন্ত্রণে আছে চিন্তার কোন কারণ নেই। সেই সেনাপ্রধান পরদিন শেখ হাসিনাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছিলেন। তাহলে ভলকার টুর্ক কি ওয়াকারকে ওই রাতেই ফোন করে হুমকি দিয়েছিলেন? মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে যখন রাত তখন ইউরোপে দিন।
যে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সেই জাতিসংঘ জন্মের পর থেকেই বিশ্বে অশান্তি সৃষ্টিতে নানাভাবে ইন্ধন জুগিয়েছে। জাতিসংঘের ইতিহাসে সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ছিল ১৯৭২ সালে সংস্থার চতুর্থ মহাসচিব হিসেবে হিটলারের নাৎসি পার্টির সদস্য অষ্ট্রিয় নাগরিক কুর্ট ওয়াল্ডহ্যামের নিয়োগ। ভলকার টুর্কও অষ্ট্রিয়ার নাগরিক ছিলেন। ওয়াল্ডহ্যাম শুধু নাৎসি পার্টির সদস্য ছিলেন তাই নয় তিনি ইহুদি বন্দি শিবিরের পাহারাদারও ছিলেন। এইসব তথ্য তিনি বেমালুম চেপে দুইবার বিশ্ব সংস্থাটির মহাসচিব হয়েছিলেন।
ভলগার টুর্ক বাংলাদেশকে নিয়ে যে কুৎসিৎ খেলায় মেতেছিলেন তা শুধু একটি দেশের সার্বভৌমত্বের ওপরই আঘাত করার সামিলই নয় তিনি জাতিসংঘের সনদের একাধিক ধারা লংঘন করেছেন। সংস্থাটির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর কাজ হচ্ছে জাতিসংঘ কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে কোনো একটি ঘটনার সত্যতা যাচাই করা, কোনো দেশকে হুমকি দেওয়া নয়। আর শান্তি রক্ষা মিশনের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ রূপে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের। টুর্ক বাংলাদেশ নিয়ে কী নোংরা খেলায় মেতেছিলেন তা এখন জাতিসংঘ জেনেছে। সংস্থার মহাসচিব এন্থনি গুটরেস পবিত্র রমজান মাসের নির্যাস নেওয়ার জন্য সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেছেন। এটি তার একটি রুটিন সফর হলেও ইউনুস সরকার তার নিজের স্বার্থে গুতরেসের এই সফরকে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন । গুতরেস প্রতি রমজানে বিশে^র বিভিন্ন শরনার্থি শিবির (বিশে^র প্রায় সব শরনার্থিই দূর্ভাগ্যজনক ভাবে মুসলমান) সফর করেন, তাদের সাথে দেখা করেন, তাদের সূখ দূঃখের কথা শোনেন । এবার তিনি বাংলাদেশে এসে একেবারে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন কারণ ইউনুস এই সফরকে ঘিরে একটা জজবা সৃষ্টি করেছিলেন । ২০১৮ সালেও তিন বাংলাদেশ সফর করেছিলেন এবং রোহিঙ্গা শিবিরও সফর করেছেন । সেখানে তাকে স্বাগত জানান চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার । যাওয়ার আগে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে তাঁকে ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষনরত একটি ছবি উপহার দিয়ে যান । গুতরেস এবার কিছু শিষ্টাচার বর্হিভ’ত কাজ করেছেন । তিনি ঢাকার জাতিসংঘ মিশন দপ্তরে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে কিছু রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করেছেন । এটি তার কাজ নয় । বিএনপি’র মহাসচিব যথার্থই বলেছেন ‘এই সভা কেন ডাকা হয়েছে তা তিনি জানেন না’। সেই সভায় তিনি ইউনুসের তথাকথিত সংষ্কার নিয়ে কথা বলেছেন ও তাতে সহায়তা করবেন বলে জানিয়েছেন । এটি একটি অবৈধ সরকারকে শুধু সমর্থনই নয় বিশে^র অন্যান্য দেশের সরকার উৎখাতকে উৎসাহিত করবে । এই সভাই যারা অংশগ্রহন করেছে তাদেও মধ্যে জামায়াতের মতো অবৈধ যুদ্ধাপরাধিদের দলও ছিল ও ছিল অনেকগুলো অনিবন্ধিত দল । কোন কোনটি সার্কাস পার্টি।
শনিবার বিকালে এন্থনি গুতরেসকে এক সংবাদ সম্মেলনে হাজির করা হয় ইউনুসের তথ্য সচিবের উদ্যোগে । সেখানে কারা উপস্থিত থাকবেন তা তিনি শুধু নির্দ্ধারণই করেন নি কোন চারজন এবং কি বিষয় নিয়ে গুতরেসকে প্রশ্ন করা যাবে তাও বলে দেন । উপস্থিত অন্যদের নির্দেশ দেন তারা যেনো প্রশ্ন করার জন্য কেউ হাত না তুলেন । এই সব ফরমায়েশি প্রশ্ন ও তার উত্তর নিয়ে পরদিন দেশে সকল গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করেছে । রোহিঙ্গা ক্যাম্প সফর কালে ইউনুস তাদের বলেন আগামী ঈদ তারা নিজ দেশে করতে পারবেন বলে তিনি আশা করেন। কিন্তু গুতরেস ঢাকায় ফিরে বলেন রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরানোর কঠিন হবে । গুতরেস বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থের পরিপন্থি দুটি অপিনামদর্শি প্রস্তাব তুলে ধরেন । তিনি বলেন বাংলাদেশের উচিৎ আরাকান আর্মির সাথে আলোচনা করা । আরাকান আর্মিতো কোন স্বীকৃত সংস্থা নয়। তারা মিয়ানমারের ভিতরে একটি ক্রিয়াশীল সশস্ত্র গোষ্টি । এমন সশস্ত্র গোষ্টি মিয়ানমারে ডজনখানেক আছে । বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কতো মিয়ানমারের সাথে । কোন বুদ্ধিতে গুতরেস এমন একটি প্রস্তাব দেন ? তার দ্বিতীয় প্রস্তাবটি আরো ভয়াবহ । তিনি বাংলাদেশর ভিতর দিয়ে আরাকানে সহায়তা পাঠানোর জন্য একটি করিডোর চান । কার কাছে এই সহায়তা পাঠাবেন ? যেখানে সামনের মাস হতে রোহিঙ্গাদের রেশন অর্ধেকে নেমে আসছে এই সহায়তার অর্থ কোথা থেকে আসবে এমন প্রশ্ন করার সুযোগ কোন সাংবাদিকাদেও হয়তো ছিল না । আর বাংলাদেশর ভিতর দিয়ে কেনো করিডোর? এটাকি শেখ হাসিনা যে বলতেন এই অঞ্চলে একটি ক্রিস্টান রাষ্ট্র স্থাপনের ষড়যন্ত্র চলছে অনেক দিন ধরে গুতরেসের এমন বক্তব্য কি তার পূর্ব লক্ষণ?
এন্থনি গুতরেস রবিবার বাংলাদেশ ত্যাগ করেছেন । প্রশ্ন এখন তার মতো একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি বাংলাদেশে এসে যে সব দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ড করে গেলেন তার জবাব কে দেবো ? মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে গুতরেস তিনদিনের বাংলাদেশ সফর বাংলাদেশের অবৈধ ইউনূস সরকারকে হয়তো খানকিটা চাঙ্গা করে দিয়েছে । টুর্কেও বিষয়টি গুতরেসের না জানার কোনো কারণ নেই। এখন দেখার পালা তিনি বা জাতিসংঘ টুর্কের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়। এটি সত্য জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান গুলো দেশে দেশে অনেক ভালো কাজ করে তবে খোদ জাতিসংঘ বর্তমান অবস্থায় থাকার দরকার আছে কিনা তার সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে চিন্তা করতে হবে ।
লেখকঃ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ।