।। বিশেষ প্রতিবেদন।।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সময় প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে কর্মরত হিন্দু ধর্মাবলম্বী সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপকভাবে বিদায় করার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, এ উদ্দেশ্যে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, হিন্দু কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরির জন্য মন্ত্রণালয় থেকে আনুষ্ঠানিক চিঠিও পাঠানো হয়েছিল।
চিঠিতে বলা হয়েছিল, “গত ২৭ আগস্ট রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের আপন বিভাগ থেকে (স্মারক নম্বর উল্লেখ করে) উপর্যুক্ত বিষয় ও স্মারকের আলোকে ঢাকায় কর্মরত হিন্দু ধর্মাবলম্বী যুগ্মসচিব ও সমমর্যাদার এবং তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের নামের তালিকার সফটকপি ও হার্ডকপি বাংলায় নির্দিষ্ট ই-মেইল ঠিকানায় আগামী ২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রশাসন-১ শাখায় পাঠানোর জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।” তবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পরবর্তীতে ওই চিঠি প্রত্যাহার করা হয়।
যদিও হিন্দু কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহের নির্দেশনা সম্বলিত চিঠিটি বাতিল করা হয়েছিল, তারপরও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে সাম্প্রতিক পরিবর্তন পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয় যে, তালিকা অনুযায়ীই হিন্দু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বর্তমান সচিবদের তালিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ৮৪ জন সচিবের মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বী আছেন মাত্র একজন, যিনি কোনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নেই। তাকে জনপ্রশাসনের একটি প্রশিক্ষণ একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, গ্রেড-১ পর্যায়ের ১৫ জন কর্মকর্তার মধ্যে একমাত্র হিন্দু কর্মকর্তাকে একটি কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান পদে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, ৩৮৪ জন অতিরিক্ত সচিবের মধ্যে ১৮ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী, যার মধ্যে ১১ জনই ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হিসেবে রাখা হয়েছে। বাকি ৭ জন অতিরিক্ত সচিবকে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব দেওয়া হলেও অধিকাংশকেই ‘গুরুত্বহীন দপ্তরে’ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
৮৪ জন সচিবের মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মাত্র একজন
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে মোট ৮৪ জন সচিব রয়েছেন, যার মধ্যে ১৭ জন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন এবং তারা জ্যেষ্ঠ সচিবের মর্যাদা লাভ করেছেন। এছাড়া, ১৩ জনকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে, আর বাকি ৫৪ জন সচিব বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের দায়িত্বে রয়েছেন।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত ১৭ জন সচিব হলেন— ড. শেখ আব্দুর রশীদ (মন্ত্রিপরিষদ সচিব), এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া (প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব), ড. নাসিমুল গনি (জ্যেষ্ঠ সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়), এম এ আকমল হোসেন আজাদ (জ্যেষ্ঠ সচিব, পরিকল্পনা কমিশন), ড. মো. মোখলেস উর রহমান (জ্যেষ্ঠ সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়), মমতাজ আহমেদ (জ্যেষ্ঠ সচিব, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়), মো. এহছানুল হক (জ্যেষ্ঠ সচিব, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ)।
অন্যদের মধ্যে রয়েছেন, আখতার আহমেদ (জ্যেষ্ঠ সচিব, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়), ড. মো. নেয়ামত উল্লাহ ভূইয়া (জ্যেষ্ঠ সচিব, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়), এ. এস. এম. সালেহ আহমেদ (জ্যেষ্ঠ সচিব, ভূমি মন্ত্রণালয়), সিদ্দিক জোবায়ের (জ্যেষ্ঠ সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ); মোহাম্মদ ইউসুফ, (জ্যেষ্ঠ সচিব, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়), শীষ হায়দার চৌধুরী (সচিব, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, আইসিটিডি), ড. মো. মাহফুজুল হক (সচিব, রাষ্ট্রদূত, বাংলাদেশ দূতাবাস, লিসবন, পর্তুগাল), বেগম শরিফা খান (সচিব, বিকল্প নির্বাহী পরিচালক, বিশ্ব ব্যাংক [লিয়েনে কর্মরত]), এ. জে. এম. সালাহউদ্দিন নাগরী (সচিব, ভূমি সংস্কার বোর্ড) এবং ড. কাইয়ুম আরা বেগম (সচিব, সদস্য, পরিকল্পনা কমিশন)।
এই তালিকা অনুযায়ী, চুক্তিভিত্তিক সচিবরা গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া, ৫৪ জন নিয়মিত কর্মকর্তা সচিব পদে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিপ্তরের দায়িত্বে রয়েছেন।
তারা হলেন- মো. মোকাব্বির হোসেন (জ্যেষ্ঠ সচিব, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়); সুকেশ কুমার সরকার (সচিব, মহাপরিচালক, জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমি – এনএপিডি); সাঈদ মাহবুব খান (সচিব, রেক্টর, বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র – বিপিএটিসি); মো. আব্দুর রউফ (সচিব, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়); মো. আবদুর রহমান খান (সচিব, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ); ড. ফারহিনা আহমেদ (সচিব, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়); ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান (সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়); মো. মুশফিকুর রহমান (সচিব, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ); নাজমুল আহসান (সচিব, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়); মো. আশরাফ উদ্দিন (সচিব, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়); ড. মো. খায়রুজ্জামান মজুমদার (সচিব, অর্থ বিভাগ); নাজমা মোবারেক (সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ); ইসরাত চৌধুরী, এনডিসি (সচিব, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়); খোরশেদা ইয়াসমীন (সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশন); মাহবুবা ফারজানা (সচিব, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়); মো. মোস্তাফিজুর রহমান (সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়); ডা: মো. সারোয়ার বারী (সচিব, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ);
এ. এইচ. এম সফিকুজ্জামান (সচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়); নাসরীন জাহান (সচিব, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়); মো. সাইফুল্লাহ পান্না (সচিব, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়); মো. হামিদুর রহমান খান (সচিব, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়); মো. মাসুদুল হাসান (সচিব, খাদ্য মন্ত্রণালয়); মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী (সচিব, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়); ফারজানা মমতাজ (সচিব, বিদ্যুৎ বিভাগ); মো. ফাহিমুল ইসলাম (সচিব, রেলপথ মন্ত্রণালয়); মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম (সচিব, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিভাগ); ড. মো. সানোয়ার জাহান ভূঁইয়া (সচিব, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন সচিবালয়); ইকবাল আবদুল্লাহ হারুন (সচিব, পরিকল্পনা বিভাগ); এ. কে. এম. আফতাব হোসেন প্রামাণিক (সচিব, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়); ড. মো. মহিউদ্দিন (সচিব, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়); ড. খ. ম. কবিরুল ইসলাম (সচিব, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ); মো. নিজাম উদ্দিন (সচিব, স্থানীয় সরকার বিভাগ); মো. নজরুল ইসলাম (সচিব, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ); আবু তাহের মো. মাসুদ রানা (সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়); খান মো. নূরুল আমীন (সচিব, জন বিভাগ);
মো. আব্দুল খালেক (সচিব, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়); মো. ওবায়দুর রহমান (সচিব, শিল্প মন্ত্রণালয়); আলেয়া আক্তার (সচিব, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ); মো. কামাল উদ্দিন (সচিব, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়); মো. তাজুল ইসলাম (সচিব, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ); মো. মিজানুর রহমান (সচিব, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ও সংসদ সচিবালয়); মোহাম্মদ আবদুর রউফ (সচিব, সেতু বিভাগ); মাহবুবুর রহমান (সচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়); মো. আমিন উল আহসান (সচিব, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন); মুহম্মদ ইব্রাহিম (সচিব, চেয়ারম্যান, ভূমি আপীল বোর্ড); নাসরীন আফরোজ (সচিব, নির্বাহী চেয়ারম্যান, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ – এনএসডিএ); মো. মাহমুদুল হোসাইন খান (সচিব, পরিকল্পনা কমিশন); ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক (সচিব, রেক্টর, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস প্রশাসন একাডেমি); ড. মো. সহিদ উল্যাহ (সচিব, রেক্টর, জাতীয় উন্নয়ন প্রশাসন একাডেমি); মো. রুহুল আমীন (সচিব, সদস্য, পরিকল্পনা কমিশন); ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান (সচিব, সদস্য, পরিকল্পনা কমিশন); মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম (সচিব, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ – পিপিপি কর্তৃপক্ষ); জাহেদা পারভীন (সচিব, সমন্বয় ও সংস্কার, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ)।
অন্যদিকে যে ১৩ জন সচিবকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি করে রাখা হয়েছে তারা হলেন- মো. মোস্তফা কামাল (জ্যেষ্ঠ সচিব), মো. মশিউর রহমান (জ্যেষ্ঠ সচিব), মো. মনজুর হোসেন (জ্যেষ্ঠ সচিব), মো. সামসুল আরেফিন (সচিব), মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন (সচিব), মো. আজিজুর রহমান (সচিব), মো. নূরুল আলম (সচিব), মো. খায়রুল আলম সেখ (সচিব), মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী (সচিব), ড. ফরিদ উদ্দিন আহমদ (সচিব), রেহানা পারভীন (সচিব), শফিউল আজিম (সচিব), এবং ড. এ কে এম মতিউর রহমান (সচিব)।
গ্রেড-১ এর ১৫ জনের মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মাত্র একজন
সরকারি চাকরির বিধি অনুযায়ী, গ্রেড-১ কর্মকর্তারাও সচিবদের মতো সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। মূলত সচিব, অধ্যাপক পদে থাকা ব্যক্তিরা প্রথম গ্রেডের সুবিধাদি পান। আর অতিরিক্ত সচিব দ্বিতীয় এবং যুগ্ম সচিবরা তৃতীয় গ্রেডের বেতনভুক্ত। অতিরিক্ত সচিব দ্বিতীয় গ্রেডের বেতনভুক্ত হলেও সরকার বিশেষ নির্দেশনায় প্রথম গ্রেডেই তাদের অন্তর্ভুক্ত করে রাখা হয়।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে গ্রেড-১ পদে যে ১৫ জন কর্মকর্তা রয়েছেন তাদের মধ্যে চুক্তিভিত্তিক দুই জন এবং দুই জনকে করা হয়েছে ওএসডি। গ্রেড-১ কর্মকর্তাদের মধ্যে মাত্র সনাতন ধর্মালম্বী একমাত্র কর্মকর্তা হলেন ড. লিপিকা ভদ্র (চেয়ারম্যান , বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন)।
এ ছাড়া গ্রেড-১ এর সমস্ত সুযোগ-সুবিধা পান এমন কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন, মো. আবু বকর ছিদ্দিক (ভাইস চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন) (চুক্তিভিত্তিক); সালেহ আহমদ মোজাফ্ফর (মহাপরিচালক, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো) (চুক্তিভিত্তিক); ড. রওশন আরা বেগম (অতিরিক্ত সচিব, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়); মুনীরা সুলতানা (মহাপরিচালক, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর); মো. আলীম আখতার খান (মহাপরিচালক, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর); সাইদুর রহমান (চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন); ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামান (মহাপরিচালক, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর), এস এম ফেরদৌস আলম (মহাপরিচালক, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং, বিএসটিআই); মো. ইয়াসীন (চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ) (বিআরটিএ); কেয়া খান মহাপরিচালক (মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর); মো. রুহুল আমিন খান (চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন) এবং মো. আব্দুল কাইয়ূম (মহাপরিচালক, জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউট)।
এছাড়া অতিরিক্ত সচিব দু’জনকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওএসডি করে রাখা হয়েছে। তারা হলেন- আব্দুল্লাহ সাজ্জাদ এবং মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী।
অতিরিক্ত সচিব: ৩৮৪ জনের মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা মাত্র ৭ জন
বর্তমান প্রশাসনে অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদায় রয়েছেন মোট ৩৮৪ জন কর্মকর্তা। এরমধ্যে সনাতন ধর্মালম্বী অতিরিক্ত সচিবের সংখ্যা ১৮ জন। আর এই ১৮ জনের মধ্যে ওএসডি বা সংযুক্ত করা হয়েছে ১১ জনকে। বাকি ৭ জন হিন্দু কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত সচিব বিভিন্ন পদে রাখা হলেও সেসব বেশিরভাগই ‘গুরুত্বহীন দপ্তর’।
সাধারণত ওএসডি বা সংযুক্ত করাকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসাবেই ধরে নেওয়া হয়।
এ ছাড়া, কোনো কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়ার পর পরবর্তী পদায়নের আগে, উচ্চশিক্ষার জন্য তিন মাসের বেশি কেউ ছুটি নিলে, এনডিসি কোর্সের জন্য, বিভাগীয় মামলা ও গুরুতর অসুস্থতার কারণে, জনপ্রশাসন থেকে অবসর নিতে চাইলে এবং জনস্বার্থ ও প্রশাসনিক কারণে ওএসডি বা সংযুক্ত করা হয়ে থাকে।
বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যেসব সনাতন ধর্মালম্বী কর্মকর্তা অতিরিক্ত সচিব পদে কর্মরত তারা হলেন, শশাংক শেখর ভৌমিক, অতিরিক্ত সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়; পরিমল সিংহ, অতিরিক্ত সচিব, মহাপরিচালক, বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র (বিটাক); স্মৃতি কর্মকার, অতিরিক্ত সচিব, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট।
এ ছাড়া রয়েছেন, দীপক কুমার সরকার, অতিরিক্ত সচিব, প্রকল্প পরিচালক, ইন্টিগ্রেটেড এইচওয়াইভি জুট অ্যান্ড জুট সিড প্রডাকশন প্রকল্প; প্রভাষ চন্দ্র রায়, অতিরিক্ত সচিব, প্রকল্প পরিচালক, তৃণমূল পর্যায়ে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশ সাধন শীর্ষক প্রকল্প; ড. অঞ্জন কুমার দেব রায়, অতিরিক্ত সচিব, পরিকল্পনা বিভাগ; প্রদীপ কুমার দাস, অতিরিক্ত সচিব, খাদ্য মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (প্রশাসনিক) অর্থাৎ ওএসডি এবং সংযুক্ত করা হয়েছে ১১ জন সনাতনী কর্মকর্তাকে।
ওই কর্মকর্তারা হলেন, প্রদীপ কুমার মহোত্তম, অতিরিক্ত সচিব, সংযুক্ত, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়; সুব্রত শিকদার, অতিরিক্ত সচিব, সংযুক্ত, পরিকল্পনা বিভাগ; বিজয় কৃষ্ণ দেবনাথ, অতিরিক্ত সচিব, সংযুক্ত, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং নিখিল কুমার দাস, অতিরিক্ত সচিব, সংযুক্ত, পরিকল্পনা বিভাগ, ড. মলয় চৌধুরী (৫৯২১); অমল কৃষ্ণ মন্ডল (৫৯৯৭); রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়া (৬০২০); দিলীপ কুমার বনিক (৬০৯৭); মনোজ কুমার রায় (৬৩৪২); অজয় কুমার চক্রবর্ত্তী (৬৩৪২) এবং গৌতম চন্দ্র পাল (৬৫১৮)।
সংশ্লিষ্টদের অভিমত
ইউনূস-সরকারের প্রশাসন ‘হিন্দুশূন্য’ হওয়ার বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক একজন সচিব, যিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের সময়ে গুজব ছড়ানো হয়েছিল সচিব থেকে সরকারের ঊর্ধ্বতন বেশিরভাগ কর্মকর্তাই হিন্দু। সামাজিক মাধ্যমসহ অনেকে তা বিশ্বাসও করেছিলেন। আমি সে সময় একটি মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বে ছিলাম। পরিচিতরা জিজ্ঞেস করলে তাদের জানিয়েছে বিষয়টি গুজব। কিন্তু বর্তমান সময়ের সেই ঘটনা যেন সত্যি হয়ে ফিরলো ৯০ ডিগ্রি এঙ্গেল ঘুরে। অর্থাৎ হিন্দু ধর্মালম্বী শূন্য বর্তমান প্রশাসন।”
তিনি আরও বলেন, “যোগ্যতা প্রমাণ করে বিসিএস ক্যাডার হতে হয়। ধাপে ধাপে যোগ্যতা দিয়ে একজন কর্মকর্তা সচিব হতে পারেন। অথচ বর্তমানে সচিব থেকে গ্রেড-১ কর্মকর্তাদের মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা নেই বললেই চলে। এটি নিছক কাকতালীয় ঘটনা নয়। প্ল্যান করে হিন্দু অফিসারদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দু’একজন যারা আছেন তাদেরও সরিয়ে দেওয়া হবে।” বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এমনটি করা হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেছেন, “সরকারের জন্য এখন প্রশাসনের কাঠামো পুরোপুরি পুনর্বিন্যাস করা সহজ নয়, কারণ সময়ের অভাব রয়েছে। বিশেষ পরিস্থিতির কারণে প্রশাসনে এই পরিবর্তনগুলো অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, যা এড়ানো কঠিন।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে প্রশাসনে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, যা বড় ধরনের অনাস্থার জন্ম দিয়েছে। আগের সরকারের কর্মকর্তাদের প্রতি এই সরকারের আস্থা অর্জন কঠিন হচ্ছে, তাই যাচাই-বাছাই করে নতুন কাঠামো তৈরি করতে সময় লাগবে।” এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি ইউনূস-সরকার হিন্দুমুক্ত প্রশাসনের দিকেই হাঁটছে?
গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও নিপীড়নের ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে, এবং ভারতও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে। তবে ইউনূসের সরকার এসব ঘটনাকে ‘গুজব’ হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছে।
সম্প্রতি মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি তুলে ধরার পর, সরকার এ বিষয়ে বিবৃতি দিয়ে অভিযোগ অস্বীকার করলেও প্রশাসনের ভেতরে অস্বস্তি বিরাজ করছে বলে জানা গেছে।