বাংলাদেশে গত এক মাসে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রয়োগকারী ব্যক্তি ও মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার, হয়রানি এবং সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ একদল মানবাধিকার সংগঠন।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানবাধিকার সমুন্নত রেখে সম্মানজনক সমাজ গঠনের জন্য বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘনের চর্চা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সম্প্রতি সংঘটিত হামলাগুলোর সবই রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা সংঘটিত না হলেও, সরকারের দায়িত্ব রয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, যার মধ্যে অ-রাষ্ট্রীয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হামলা থেকে নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়াও অন্তর্ভুক্ত।
সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা
গত ফেব্রুয়ারি মাসে সাংবাদিকদের ওপর একাধিক সহিংস হামলার ঘটনা ঘটেছে। ৩রা ফেব্রুয়ারি শরীয়তপুরে একজন সাংবাদিককে হাতুড়ি ও ছুরি দিয়ে আক্রমণ করা হয়। তিনি একটি বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন। এ ঘটনায় আরও তিন সাংবাদিক আহত হন। ২৪শে ফেব্রুয়ারি এই হামলার সাথে জড়িত ছয়জনকে আদালতে হাজির করা হয়।
একই দিনে লক্ষ্মীপুরে মুখোশধারী ব্যক্তিরা চার সাংবাদিকের উপর বাঁশের লাঠি ও বন্দুক নিয়ে হামলা চালায়। ৫রা ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে তিন সাংবাদিককে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সদস্যরা আক্রমণ করে। তারা ১৯৯৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ট্রেনে হামলার মামলায় ২০১৯ সালে দোষী সাব্যস্ত ৪৬ জনের খালাসের খবর কভার করছিলেন।
৯ই ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি বিক্ষোভ কভার করার সময় ৫ সাংবাদিককে পুলিশ লাঠিচার্জ, লাথি ও ঘুষি মেরে আহত করে। ২৫শে ফেব্রুয়ারি ঠাকুরগাঁওয়ে একজন সাংবাদিককে বিএনপির এক সদস্য আক্রমণ করে। তিনি ওই রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন।
সাংবাদিক ছাড়াও অন্যদের ওপর হামলা
শুধু সাংবাদিক নয়, লেখক, কবি ও মানবাধিকার কর্মীরাও হামলার শিকার হয়েছেন। ১০ই ফেব্রুয়ারি আমার একুশে বইমেলায় তসলিমা নাসরিনের লেখা বই বিক্রির অভিযোগে একটি বইয়ের স্টল ভাঙচুর করা হয়। তসলিমা ১৯৯৪ সালে ইসলাম অবমাননার অভিযোগে মৃত্যুর হুমকি পেয়ে দেশ ছেড়েছিলেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এ ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিলেও দোষীদের শাস্তি দেওয়া হয়নি।
১৩ই ফেব্রুয়ারি কবি সোহেল গালিবকে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। তার একটি কবিতায় ইসলাম সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ। ৩রা মার্চ ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনাল মানবাধিকার কর্মী রাখাল রাহার বিরুদ্ধে একটি ফেসবুক পোস্টের জন্য তদন্তের নির্দেশ দেয়। তিনি সোহেল গালিবের গ্রেপ্তার নিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে একটি ব্যঙ্গাত্মক কবিতা লিখেছিলেন।
আইনি কাঠামো ও সাইবার নিরাপত্তা আইন
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর অগ্রহণযোগ্য বিধিনিষেধ আরোপ করে। ২৫শে ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রামে লেখক ও কর্মী নাহিদ হাসানের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা দায়ের করা হয়। এই আইনটি পূর্বে সরকার সমালোচক, মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক ও ব্লগারদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার সিএসএ বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিলেও, প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫ (সিপিও) আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ এবং আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদের (আইসিসিপিআর) ১৯ অনুচ্ছেদে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা স্বীকৃত। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটি বলেছে, ধর্মের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন বা ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সমালোচনা নিষিদ্ধ করা আইসিসিপিআর-এর ১৯ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন।
সুপারিশ
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে:
নতুন আইন প্রণয়নে স্বচ্ছ পরামর্শ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মান মেনে চলা।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রত্যাহার করা।
ধর্মীয় অনুভূতির অজুহাতে মতপ্রকাশের উপর বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া।
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের উপর হামলার তদন্ত ও দোষীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান, অতীতের দমন-ভীতির চক্র ভেঙে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে।