।। কবির য়াহমদ।।
দেশে প্রকাশ্যে কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি কি পালন করছে আওয়ামী লীগ? না। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কেউ কি প্রকাশ্যে? না। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা কি দেশে আছেন? না। তিনি কবে ফিরবেন কেউ কি জানে? উত্তর এখানেও না-সূচক।
তবু দেখুন, এখানেও প্রাসঙ্গিক আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ নিয়ে চর্চা হচ্ছে দেশে। চর্চা ঠিক নয়, ভয় পাচ্ছে আওয়ামী লীগবিরোধী সকল রাজনৈতিক দল।
দেশে নেই, অথচ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের সবচেয়ে চর্চিত দলের নাম আওয়ামী লীগই। মাঠের রাজনীতিতে এখন আওয়ামী লীগের নামগন্ধ না থাকলেও এই দলটিকে ভয় পাচ্ছে প্রতিপক্ষ।
এখানেই কিন্তু আওয়ামী লীগের সার্থকতা। দেশের রাজনীতিতে না থেকেও রাজনীতির কেন্দ্রে দলটি। এই হিসেবে আওয়ামী লীগকে ‘রাজনীতির অক্সফোর্ড’ বলতে পারেন নির্দ্বিধায়!
বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার অনেকটাই আওয়ামী লীগের দখলে। গুজব থেকে শুরু করে সরকারের যেকোনো বিষয়ে দলটির সমর্থকেরা প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে যাচ্ছেন। এর প্রভাব পড়ছে জনমনে। আট মাস আগের অনলাইন, আর এখনকার অনলাইনের পার্থক্য বিস্তর। জুলাই-আগস্টে যে অনলাইন থেকে অনেকটাই বিতাড়িত ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা, এখন তারা এর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে।
এরফলে প্রান্তের যে লোক সোশ্যাল মিডিয়াকে খবরের আধার ভাবে, তার কাছেও এই বার্তা জোরাল হচ্ছে ‘আগেই ভালো ছিলাম’। হ্যাঁ, জীবন যাপনের দিক থেকে হয়ত সে উপলব্ধি করছিল, কিন্তু তার কানে যখন এক বাক্য বারবার যাচ্ছে, তখন এটা তার বিশ্বাসের অংশ হয়ে গেছে।
মুহাম্মদ ইউনূসের পৌনে আট মাসের দেশ শাসনে ইতিবাচক কী অগ্রগতি? যে সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী দিয়ে সাবেক সরকার কোটি-কোটি প্রান্তিক হতদরিদ্রদের আর্থ-সামাজিক সুরক্ষা দিয়েছিল, সেগুলো যখন নিজেদের চোখের সামনে ভেঙে পড়তে দেখেছে মানুষ, তখন তাদের কাছে বাস্তবতা কঠিন রূপে দেখা দিচ্ছে। ফলে আট মাস আগে আন্দোলনে কে কাকে কীভাবে মেরেছে সেসব নিয়ে মানুষের ভাবান্তর আছে বলে মনে হচ্ছে না।
এইতো কিছুদিন আগেও আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়ে কথা বলতে মানুষ ভয় পাচ্ছিল, এখন এই অবস্থার অবসান হতে চলেছে। এর কারণ কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ও কথিত স্টেকহোল্ডারদের কামড়াকামড়ি। আর আছে ক্ষমতাসীন ও সহযোগীদের লুটপাটের নাতিদীর্ঘ খতিয়ান।
এখন এই মুহূর্তে দেশের মানুষ একবাক্যে স্বীকার করে টেলিভিশন আর পত্রপত্রিকা যা বলে তার বেশিরভাগই সঠিক খবর নয়। মানুষের মনে এই বিশ্বাস প্রবল হয়েছে গণমাধ্যমগুলো আসল খবর প্রকাশ করছে না। এটা কেবল সরকারবিরোধী অংশই বিশ্বাস করছে এমন না, খোদ সরকার সমর্থকেরাও এমনটা বিশ্বাস করে। ফলে একটা আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এবং এই আস্থার সঙ্কটের পরিণাম ভয়াবহ হয়ে থাকে। আওয়ামী লীগের আমলের শেষের দিকেও এই আস্থার সঙ্কট ছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের দেশ শাসনের পৌনে আট মাসেই এটা আগের সরকারের আমলের কাছাকাছি অবস্থায় চলে গেছে।
মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন নিয়ে গড়িমসি করছে। দেশের কেউই নির্বাচন দূরে ঠেলে দেওয়ার পক্ষপাতী নয়। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে সরকারের পরিস্কার কোন পরিকল্পনা অদ্যাবধি দেশবাসী দেখতে পায়নি। সরকারের মূল দল বা কিংস পার্টি, যার নাম ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি-এনসিপি চায় গণপরিষদ নির্বাচন; কিন্তু দেশের সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলো চায় সংসদ নির্বাচন। আর দেশবাসী মনে করছে সরকার সেটাই করতে চায় যা কিংস পার্টি এনসিপি চাইছে। সঙ্গে আবার মানুষ মনে করছে সরকার চাইলেই এটা করতে পারবে না। এখানে সরকারের সক্ষমতা নিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে।
যে এনসিপিকে ক্ষমতায় নেওয়ার খায়েশ মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের, তারা আত্মপ্রকাশের এক মাসেও নিজেদের শক্ত সাংগঠনিক ভিত্তির প্রকাশ করতে পারেনি। উল্টো যেখানে যাচ্ছে তারা, সেখানে নিজেদের মধ্যেই মারামারি করছে। এই এনসিপি আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ চায়, আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল চায়, আওয়ামী লীগকে নির্বাচন করতে দেবে না বলে ঘোষণাও দিয়েছে তারা। অর্থাৎ তাদের রাজনীতিই মূলত আওয়ামী লীগকেন্দ্রিক। আওয়ামী লীগ দেশের মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও এই দলটিকে নিয়েই যত ভয় তাদের।
ঠাট্টাচ্ছলে অনেকেই বলছেন, গত কয়েক মাসে এনসিপির নেতারা যতবার আওয়ামী লীগ-আওয়ামী লীগ জপ করেছে, ততবার আল্লাহ-আল্লাহ জপ করলে এতদিনে তারা ওলি-আউলিয়া হয়ে যেত! বাস্তবে হয়ত ওলি-আউলিয়া হতে পারত না, তবে যে হারে তারা আওয়ামী-চর্চা করছে, তা সত্যি উল্লেখের মতো।
শুরুতে আওয়ামী লীগকে ‘রাজনীতির অক্সফোর্ড’ বলছিলাম, দেখুন মাঠে না থেকেও কীভাবে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে আওয়ামী লীগই। কেবল এনসিপিই নয়, বিএনপি-জামায়াত-গণঅধিকার পরিষদ-এবি পার্টি থেকে শুরু করে আম জনতার দল নামের যত দল আছে, তাদেরও একটাই দুশ্চিন্তা–এই বুঝি ফিরে এল আওয়ামী লীগ! অথচ দেখুন, ফেব্রুয়ারি মাসে পরীক্ষামূলক একটা কর্মসূচি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ, এরপর থেকে দলীয় কোন কর্মসূচি নাই।
এই এত যে চর্চা এটা কীভাবে দেখছে আওয়ামী লীগ? যদি বলি উপভোগ করছে, তবে কি ভুল বলা হবে? মনে হয় না। নিয়ম করে প্রায় রাতে যে সব গুজব ছড়ায় সোশ্যাল মিডিয়ায়–এসব কীভাবে দেখবেন? এসবে কি ভয় পাওয়া হয় না অনেকের? হয়। এই গুজবে অনেকেই আশাবাদী হয়ে ওঠে ঠিক, আবার গুজবগুলো গুজব বলে প্রমাণের পর হয়ত হতাশ হয় অনেকেই, কিন্তু দেখবেন পুনর্বার যখন গুজব ছড়ায় তখন তারা আবার দ্বিগুণ উৎসাহে আশাবাদী হয়ে বসে। অথচ এখানে তাদের হতাশায় নুইয়ে পড়ার কথা ছিল, কিন্তু তারা হতাশ হচ্ছে না। বরং এমন একটা আবহের জন্ম দিচ্ছে যেখানে মনে হয় এই বুঝি ক্ষমতায় ফিরে এল আওয়ামী লীগ!
এই যে গুজব, এসবকে স্রেফ গুজব ভেবে অগুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখতেও রাজি না সরকার, তারা একদিকে যেমন ভয় পাচ্ছে, অন্যদিকে গুজব যাতে বাস্তব না হয় সে চেষ্টাও করে যাচ্ছে। ফলে রাজনীতির মাঠে অনুপস্থিত থেকেও উপস্থিত আওয়ামী লীগ।
একবার ভেবে দেখেছেন, মাঠে অনুপস্থিত থেকেও যেভাবে চর্চায় উপস্থিত আওয়ামী লীগ; তারা যখন সত্যি সত্যি ফিরবে, তখন কী হবে সরকার ও সরকারঘনিষ্ঠদের? পাতলুন ভিজে যাওয়ার অবস্থা কি হবে না? এখনই তো কাছাকাছি অবস্থায়!
বর্তমানে যে অবস্থায় আওয়ামী লীগ, এটা কি নতুন তাদের? না, নতুন নয়। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর একই অবস্থায় পড়েছিল আওয়ামী লীগ। তখনো আওয়ামী লীগের নাম নেওয়াকে অপরাধ হিসেবে দেখা হতো। শেখ হাসিনা তখনো দেশান্তরী হয়েছিলেন। তখনো আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতে। এখনো তাই। ফেরার রাস্তা কি তবে অজানা শেখ হাসিনার? মনে হয় না। বরং বলা যায়, চেনা রাস্তা এটা তার!
বরং এখন আগের চেয়ে সহজ পথ তার সামনে। আগে যেখানে এখনকার মতো মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছার সুযোগ ছিল না; এখন আছে, এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে। মাত্র পৌনে আট মাসে আওয়ামী লীগ নিয়ে যে পরিবর্তন এটা কি সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব নয়?
এবার ভেবে দেখুন, জুলাই-আগস্ট পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার বিচার নিয়ে যে আওয়াজ ওঠত, এখন কি সেই আওয়াজে জোর আছে? না, একদম নেই! অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছাতে বসেছে এখন বরং আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার বিচার নিয়ে কথা বললে সেটাকে বরং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে আওয়াজ তোলার যথেষ্ট লোক আছে বাংলাদেশে। এই পরিবর্তন এসেছে সরকার ও সরকারঘনিষ্ঠদের সীমাহীন কর্তৃত্ববাদী আচরণ ও মাৎস্যন্যায়ের কারণে। বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুর আগেই যেন শাস্তি নির্ধারিত!
সরকার-সরকারঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক দল ও এনসিপির নেতারা যেভাবে আমাদের গৌরবের স্মারক মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় মেতেছে, তাতে দেশটা ফের ২০০৮ সালের পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। মাত্র সাত-আট মাসে দেশের জনমত পেছনের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এই অবস্থা আর মাত্র বছর-দেড় বছর চলতে থাকলে, এই মুহূর্তের আওয়ামী লীগবিরোধিরাও আওয়ামী লীগের পেছনে দাঁড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা কি থাকছে না?
ইঙ্গিত কি পাচ্ছেন না কোথাও? আপনার সোশ্যাল মিডিয়ার বন্ধুদের মাঝে কি পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন? অনেকে হয়ত সরাসরি বলছে না, কিন্তু ভেতরটা সরাসরি সে পথেই!
আওয়ামী লীগ কেবল নিজেদের রাজনীতি করে না, আওয়ামী লীগ প্রতিপক্ষের রাজনীতিও নির্ধারণ করে দেয়। আট মাসের দেশ কি বলছে না সে কথা?
লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক