।। শামীম আজাদ।।
রুমিকে আমি যুদ্ধের আগে দেখিনি, চিনতাম না। তাঁকে দেখেছি রুমির যুদ্ধসাথীদের চোখে, স্বাধীনতার পরে। ওরা আমারও বন্ধু বলে শহীদ জননী আমারও জননী হয়েছিলেন।তাঁর ক্যান্সার চিকিৎসার সময় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় তাঁরই ভীষণ জনপ্রিয় টিভি কলাম অব্যাহত রাখতেই আমার বিচিত্রায় প্রবেশ। এখন যা গল্প মনে হয়।
কত রাত দুপুর বিকেল যে জননীর এলিফেন্ট রোডের বাড়ি ‘কণিকা’য় কেটেছে কিংবা তিনিই গাড়ি চালিয়ে আমার বাসায় এসে সজীব ও ঈশিতার সংগে সময় কাটিয়ে গেছেন বা আমি ঢাকা কলেজের ক্লাশ শেষে দৌড়ে গেছি তা আজ আর গোনা যাবে না।
কখনো অলস দুপুরে মাঝের ঘরে জননীর পাশে শুয়ে রুমির গল্প শুনতে শুনতে উপরে ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখেছি শরীফ খালুর ডিজাইনে তৈরী বাড়ীর কাঠামো। ছাদে সেই পুরানো ফ্যান ঘুরছে। ঐ যে ফ্যান মাথার উপর ঘুরছে সেও তো একদিন একাত্তরের আগে সামনের চেয়ারটাতে বসা রুমি জামি দু’ভাইর কথোপকথনের সময় হাওয়া দিয়েছিলো! বইয়ে বইয়ে মুড়িয়ে রাখা এ বাড়ী এই ‘কণিকা‘ তো তাঁদেরই বাড়ী! তাহলে ঐ যে তাকভরা বই ! এখানেও নিশ্চয়ই রুমির পড়া কিংবা না পড়া কোনো বই এখনও রয়ে গেছে!
জননী খাটের নিচে হীম সাগর আম রেখে পাকিয়ে সুমিষ্ট হলে ওদের ঐ ডাইনিং টেবিলটার পাশে ঐ দুটো চেয়ারে বসে দু‘ভাইকে খাইয়েছেন। আর যেদিন খাঁটি ঘি’য়ে সোনালী করে সুজি ভেজে মোহনভোগ বানিয়েছেন, সুগন্ধে রুমি- জামি রান্না ঘরেই দৌড়ে এসে গেছে। মায়ের মত মোহনভোগ আর কেউ রান্না করতে পারে না । হয়তো ঠিক তখন বেডরুম আর রান্নাঘরের মাঝামাঝি বাথরুম থেকে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে বেরিয়ে এসেছেন সুদর্শন শরীফ খালু! আহ্।
জননীর কাছ থেকে এসব গল্প শুনে শুনে আর তাঁদের বাড়ির আনাচে কানাচে ঘোরাঘুরিতে না দেখা রুমি আমার দেখা হয়ে উঠেছে। আর যা বাকি ছিল ওঁর ও আমার বন্ধু বীর বিক্রম আলম, শহীদউল্লাহ খান বাদল, শাহাদত চৌধুরী শাচৌ ওঁরাই পূর্ণ করে দিয়েছে। বহুবছর পরে জননীর বই থেকে কোটি কোটি মানুষ তা জেনে চলেছে। আর অনেকে এবং পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য গল্পের অন্যতম একজন সাইফ ইমাম জামি – একা একা এখনো তা বয়ে চলেছেন। জামি আজ ভারাক্রান্ত, কিন্তু অক্লান্ত।
রুমি তো আমারই সম বয়সী। তাহলে বেঁচে থাকলে এখন সে কি করতো! জামির মত ওঁরও কি তাহলে একজন জীবনসাথী হতো? মিষ্টি চেহারার এই রুমি কেমন বাবা হতো? এতদিনে সে পিতা শুধু নয় পিতামহও হতো হয়তো। কেমন দাদা বা নানা হতো সে! ওরা কি যুদ্ধের গল্প শুনতে তাকে ঘিরে ধরতো! যেমন আমার কন্যা ঈশিতার কন্যা – দৌহিত্রী আনাহিতা যেভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে… ! আহ্। সকলেই জীবনে কিছু না কিছু দিয়ে যান কিন্তু শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা দেশের দিয়ে গেছেন
তাঁদের জীবন, যৌবন, সকল সম্ভাবনা, সব …সব!
আজ রুমির জন্মদিন। বেঁচে থাকলে তাঁর তিয়াত্তর বা চুয়াত্তর হতো। জামি আমার মুক্তিযুদ্ধের কারনে পাওয়া ভাই। আমার চোখের সামনে জামির বয়স বাড়ছে। সে থাকে আটলান্টিকের ওপারে। ওঁর সংগে প্রায়ই কথা হয়। দেখাও। ওর চুল এখন সল্ট এ্যান্ড পেপার! সেদিনও বল্লেছি, তোমার বয়স বাড়ার সংগে শরীফ খালুর মত দেখতে হয়ে যাচ্ছো জামি! কৌতুক করে বলে ওঠে, শামীম যাক তা হলে শেষ বয়সে এসে হ্যান্ডসাম হলাম! সত্যি কথা হল, পুরো পরিবারটাই ছিল এক রূপের আখড়া। গুণের, বিদ্যার ও দেশপ্রেমের।
আমার দেখা শহীদ জননী সাধারন একটা নরম শাড়িতেও পরমা হয়ে উঠতেন। ক্যান্সারের পর সব চুল ঝরে যখন নতুন চুল উঠলো, তার হয়ে উঠলো আরো ঘন ও স্বাস্থ্যবান। আমি আর সেলিনা (শাচৌর স্ত্রী) বলতাম, আগে ছিলেন সুচিত্রা সেন আর পরে হয়ে গেছেন সুচিত্রা মিত্র!
আমরা বুড়ো হলাম কিন্তু রুমির তো আর বয়স বাড়বে না। জাতীয় বীর শহীদদিগের কি বয়স বাড়ে? বাড়ে না। যতদিন বইবে পদ্মা যমুনা, যতদিন রবে বাংলাদেশ
শহীদ রুমি ও সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলবে সকলেই।
বীর বিক্রম শহীদ শাফী ইমাম রুমি আপনার জন্মদিনে জানাই অভিবাদন হে বীর। 🌷💐শুভ জন্মদিন রুমি।
ছবি সৌজন্য: অন্তর্জাল, সাইফ ইমাম জামি 🙏🏽Saif Imam আর ঈশিতার সংগে জননীর ছবিটি লন্ডনে আমার তোলা।