Close Menu

    সাবস্ক্রাইব

    সর্বশেষ খবরের সাথে আপডেট থাকুন।

    জনপ্রিয় সংবাদ

     বাঙালি, পরিচয় সবখানে বাঙালি

    June 2, 2025

    ড: ইউনুস গংরা পরিকল্পিতভাবে  ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে বাংলাদেশকে ঠেলে দিচ্ছে,  এক গভীর ষড়যন্ত্র

    June 2, 2025

    অর্থনীতির গতি মন্থর, বিনিয়োগ ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন

    June 2, 2025
    Facebook Instagram WhatsApp TikTok
    Facebook Instagram YouTube TikTok
    JoyBangla – Your Gateway to Bangladesh
    Subscribe
    • হোম পেইজ
    • বিষয়
      • দেশ (Bangladesh)
      • আন্তজাতিক (International)
      • জাতীয় (National)
      • রাজনীতি (Politics)
      • অথনীতি (Economy)
      • খেলা (Sports)
      • বিনোদন (Entertainment)
      • লাইফ স্টাইল (Lifestyle)
      • শিক্ষাঙ্গন (Education)
      • টেক (Technology)
      • ধম (Religion)
      • পরবাস (Diaspora)
      • সাক্ষাৎকার (Interview)
      • শিল্প- সাহিত্য (Art & Culture)
      • সম্পাদকীয় (Editorial)
    • আমাদের সম্পর্কে
    • যোগাযোগ করুন
    JoyBangla – Your Gateway to Bangladesh
    Home » কেমন ছিল ’৭১–এর ঈদ
    National

    কেমন ছিল ’৭১–এর ঈদ

    JoyBangla EditorBy JoyBangla EditorApril 1, 2025No Comments15 Mins Read
    Facebook WhatsApp Copy Link
    Share
    Facebook WhatsApp Copy Link

    ।। বায়েজিদ আহমেদ।।

    কলকাতায় মুজিবনগর সরকারের কার্যালয়ের সামনে ঈদের নামাজ পড়ছেন তাজউদ্দীন আহমদ, এম এ জি ওসমানীসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা

    সাড়ে সাত কোটি বাঙালি স্বাধীন হয়েছিল ঠিক ৫৪ বছর আগে—১৯৭১ সালে। স্বাধীনতাযুদ্ধের সেই বছরের পবিত্র ঈদুল ফিতর উদ্‌যাপিত হয়েছিল ২০ নভেম্বর, বারের হিসাবে দিনটি ছিল শনিবার। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা, মা-বোনদের ধর্ষণ, মুক্তিবাহিনী ও সংখ্যালঘুদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ চালাচ্ছিল। তাই একাত্তরে বিজয়ের প্রতীক্ষায় থাকা স্বজন হারানো বাঙালির ঈদ–আনন্দ ‘ম্লান’ হয়ে গিয়েছিল বলে স্মৃতিচারণামূলক বিভিন্ন লেখা ও সাক্ষাৎকারে তথ্য পাওয়া যায়।

    ঈদের দিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি যুদ্ধ হয়। বহু মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, আহত হন অনেকে। অন্যদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য যুদ্ধে মারা যান, অনেকেই আবার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়েন।

    ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর ঈদ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বাণী

    ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর ঈদ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বাণীছবি: ‘জয় বাংলা’ পত্রিকা থেকে সংগৃহীত

    ১৯৭১ সালে পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ১৯ নভেম্বর মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার ২৮ সংখ্যায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বাণী প্রকাশিত হয়। এতে তিনি দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন:

    ‘আমাদের দেশে এবার ঈদ এসেছে অত্যন্ত মর্মান্তিক পরিবেশে। দখলকৃত এলাকায় শত্রুসৈন্যের তাণ্ডব চলছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে বিচ্যুত হয়ে শরণার্থী হয়েছেন। মুক্ত এলাকায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি চলছে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য। রক্তের বিনিময়ে মানুষ মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম করছে। এবার ঈদ আনন্দ মুছে গেছে আমাদের জীবন থেকে। আছে শুধু স্বজন হারানোর শোক, দুর্জয় সংগ্রামের প্রতিজ্ঞা ও আত্মত্যাগের প্রবল সংকল্প।

    গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও আমার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও জনসাধারণকে ঈদ উপলক্ষে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। ঈদের যে আনন্দ আজ আমরা হারিয়েছি, তা আমাদের জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে সেদিনই, যেদিন আমরা দেশকে সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত করব। আমি আপনাদের আশ্বাস দিচ্ছি যে যথাসর্বস্ব করে যে স্বাধীনতাসংগ্রামে আমরা আজ লিপ্ত, তার চূড়ান্ত সাফল্যের দিনটি নিকটতর হয়ে এসেছে। সেই মুহূর্তটিকে এগিয়ে আনার সংগ্রামে আমরা সকলে যেন নিঃস্বার্থভাবে নিজেদের নিয়োগ করতে পারি, এই ঈদে তাই হোক আমাদের প্রার্থনা।’

    কলকাতায় মুজিবনগর সরকারের কার্যালয়ের সামনে ঈদের নামাজ শেষে মোনাজাত করছেন তাজউদ্দীন আহমদ, এম এ জি ওসমানীসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ছবি: একাত্তরের দিনপঞ্জি বই থেকে নেওয়া

    ঈদ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর বাণী

    ঈদের দিন পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী সদর দপ্তরের সামনের মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীসহ মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ঈদের নামাজ শেষে তাঁরা একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করেন।

    ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাণীছবি: ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার সৌজন্যে

    একাত্তরের ২৫ মার্চ রাত থেকে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মান্নান সম্পাদিত প্রবাসী সরকারের মুখপত্র ‘জয় বাংলা’ সাপ্তাহিক পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর বাণী প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘উৎসবের ঈদ নয়, ত্যাগের ঈদ’। এটি মূলত শেখ মুজিবের আগের একটি বাণী ছিল, সম্পাদক সেটিই দেশবাসীর উদ্দেশে ছাপিয়ে দিয়েছিলেন। বাণীটি ছিল এ রকম—

    ‘আমি নিজেকে বাঙালি ভাবতে গর্ববোধ করি। বহতা নদীর মতো আমাদের সংস্কৃতির ধারাও বেগবতী ও প্রাণাবেগপূর্ণ। আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হলে বাঙালি আবার বিশ্বসভায় মাথা তুলে দাঁড়াবে। বাঙালি হওয়ার সঙ্গে ধর্মে মুসলমান থাকার কোনো বিরোধ নেই। একটি আমার ধর্ম। অন্যটি জাতি পরিচয়। ধর্ম আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচার। জাতি-পরিচয় আমার সমষ্টিগত ঐতিহ্য। একজন হিন্দু বাঙালি ও মুসলমান বাঙালি অথবা বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টান বাঙালির মধ্যে পার্থক্য এটুকুই যে তাদের ধর্মমত শুধু আলাদা কিন্তু খাদ্য, রুচি, ভৌগোলিক পরিবেশ, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, বর্ণ ও রাজনৈতিক লক্ষ্যের দিক থেকে তারা অভিন্ন।’

    একাত্তরের ঈদের সময় মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক লাখের বেশি সদস্য। তাদের সহযোগিতা করেছিল রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা। ১৯৭১ সালের ঈদুল ফিতর উপলক্ষে পাকিস্তান সরকার তাদের সেনাবাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যদের বেতন ও রেশন বাড়িয়ে দেয়।

    পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার তথ্যমতে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোম্পানি কমান্ডারদের বেতন ধরা হয়েছিল রেশনসহ ২৫৫ রুপি। তবে যারা রেশন নেয়নি, তাদের বেতন নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩০০ রুপি। আর প্লাটুন কমান্ডারদের বেতন ধরা হয়েছিল রেশনসহ ১৩৫ রুপি ও রেশন ছাড়া ১৮৫ রুপি। এদিকে রাজাকারদের জন্য পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে মাসিক ভাতা নির্ধারণ করা হয় ৭৫ থেকে ১২০ রুপি।

    যুদ্ধের জন্য মানুষের মনে আনন্দ ছিল না। পাড়ায়-মহল্লায় পাকিস্তানি বাহিনী রেড দিচ্ছে, চারদিকে বোমাবাজি হচ্ছে। মোটকথা চরম অস্থির সময় ছিল। তাই সাধারণ মানুষের কাছে ঈদ উদ্‌যাপনের বিষয় ছিল না।’

    আফসান চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধ-গবেষক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

    কেমন ছিল একাত্তর সালের ঈদ

    মুক্তিযুদ্ধ-গবেষক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আফসান চৌধুরী যুদ্ধের সময় ছিলেন ঢাকা কলেজে এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ‘প্রথম আলো’কে স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা দেশে ঈদ উদ্‌যাপন হয়নি, তবে পালন হয়েছে। কারণ, যুদ্ধের জন্য মানুষের মনে আনন্দ ছিল না। পাড়ায়-মহল্লায় পাকিস্তানি বাহিনী রেড দিচ্ছে, চারদিকে বোমাবাজি হচ্ছে। মোটকথা চরম অস্থির সময় ছিল। তাই সাধারণ মানুষের কাছে ঈদ উদ্‌যাপনের বিষয় ছিল না।’

    আফসান চৌধুরী জানান, ’৭১ সালে তাঁর পরিবার ঢাকার মগবাজারের দিলু রোডে থাকত। ঈদের দিন তাঁর বাবা ও ছোট ভাই মেহবুব চৌধুরী দিলু রোডের মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। মহল্লায় তাঁদের পরিবারসহ চারটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ছিল। তাঁদের বাড়িতে হিন্দু পরিবারকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। যে কারণে বাড়িতে একটা গুমোট ও ভয়ের পরিবেশ ছিল। মোটকথা ঈদ ‘উৎসব’ আকারে ‘উদ্‌যাপন’ করা হয়নি, পালন করা হয়েছে।

    প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে ঈদ

    একাত্তরে ঢাকার গেরিলাদের প্রিয় ‘আম্মা’ ছিলেন শহীদ শাফী ইমাম রুমীর মা জাহানারা ইমাম। দেশবাসীর কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘শহীদজননী’ হিসেবে। জাহানারা ইমাম ’৭১-এর উত্তাল দিনগুলোতে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের বাসা ‘কণিকা’–তে স্মৃতিচারণামূলক ডায়েরি লেখেন। একাত্তর সালে ওই বাড়িটি ছিল গেরিলাদের আশ্রয়স্থল। দেশ স্বাধীনের পর ডায়েরিকে বইয়ে রূপান্তর করেন। জাহানারা ইমাম সেই ডায়েরিতে ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর ঈদের দিন লেখেন:

    ‘আজ ঈদ। ঈদের কোনো আয়োজন নেই আমাদের বাসায়। কারও জামাকাপড় কেনা হয়নি। দরজা-জানালার পর্দা কাচা হয়নি। ঘরের ঝুল ঝাড়া হয়নি। বাসায় ঘরের টেবিলে রাখা হয়নি আতরদান। শরীফ, জামী ঈদের নামাজও পড়তে যায়নি।

    কিন্তু আমি ভোরে উঠে ঈদের সেমাই, জর্দা রেঁধেছি। যদি রুমীর সহযোদ্ধা কেউ আজ আসে এ বাড়িতে? বাবা-মা-ভাই-বোন, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো গেরিলা যদি রাতের অন্ধকারে আসে এ বাড়িতে? তাদের খাওয়ানোর জন্য আমি রেঁধেছি পোলাও-কোরমা, কোপ্তা কাবাব। তারা কেউ এলে আমি চুপি চুপি নিজের হাতে বেড়ে খাওয়াব। তাদের জামায় লাগিয়ে দেওয়ার জন্য এক শিশি আতরও আমি কিনে লুকিয়ে রেখেছি।’

    বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বড় মেয়ে শারমিন আহমদের বই ‘তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা’। এ বইতে (পৃষ্ঠা ১১৮) যুদ্ধকালীন ঈদের দিনের স্মৃতিচারণা করা হয়েছে। তিনি লিখেছেন:

    ‘ঐ নভেম্বর মাসেই এল রোজার ঈদ। আব্বু রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে তাদের ক্যাম্পে মিলিত হলেন। আমাদের ফ্ল্যাটে ঈদের দিন কোনো বিশেষ খাবারের আয়োজন হলো না। নতুন কাপড়ও জুটল না। শাক, ডাল, আলুভর্তা, ভাত খেয়ে ঈদ উদ্‌যাপিত হলো। আম্মা আমাদের বললেন যে লাখ লাখ শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধার ভাগ্যে জোটেনি কোনো ঈদের আনন্দ। তাদের বেদনার ভাগীদার আমাদের হতে হবে।’

    ঈদের দিন প্রকাশিত ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’-এর প্রতিবেদন

    যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’ হেডলাইন করে ‘স্বাধীনতার জন্য আমৃত্যু লড়াই।’ পাকিস্তানের করাচি থেকে সাংবাদিক ম্যালকম ব্রাউনের পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়:

    ‘পাকিস্তানি সেনাদের সাথে আমৃত্যু সংগ্রাম করা হলেও বাঙালিরা স্বাধীনতা চায়। পূর্ব পাকিস্তানের শহরে শহরে এবং গ্রামাঞ্চলে ঘুরে সামগ্রিকভাবে এই ধারণা হয়।’ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘হোটেল, ব্যাংক, দোকান, বাজার, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, বিদেশি কনস্যুলেট অফিস সর্বত্রই রয়েছে মুক্তিবাহিনী। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে জলাভূমি বেশি। সেখানে ঢোকা সেনাদের পক্ষে কঠিন। পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ ভিয়েতনাম থেকে কিছু শেখেনি। গেরিলারা সর্বত্র রাস্তা, সেতু ও জলপথ ধ্বংস করছেন। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পেট্রল সরবরাহ বন্ধ করে দিচ্ছে। পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের ঘরের বাইরে আসা প্রায় বন্ধ। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত এক বিশেষ কমিটিতে নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে আলোচনাকালে ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কে বি অ্যান্ডারসন পূর্ববঙ্গ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানান।’

    চাঁদরাতে শহীদ হন আশফাকুস সামাদ, বীর উত্তম

    ঈদের দিন ৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বেদনাবিধুর একটি দিন। ওই দিন তাঁরা হারিয়েছিলেন তাঁদের সাহসী যোদ্ধা সাহেবগঞ্জ সাবসেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট আশফাকুস সামাদ বীর উত্তমকে। আশফাকের পুরো নাম আবু মঈন মোহাম্মদ আশফাকুস সামাদ। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।

    আশফাক বন্ধুদের নিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যান। জুন মাসে বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের ক্যাডেট অফিসার হিসেবে নির্বাচিত হন। জলপাইগুড়িতে সাড়ে তিন মাস প্রশিক্ষণ শেষে ৯ অক্টোবর সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট পদে ‘কমিশন’ পান।

    আশফাককে ৬ নম্বর সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাবসেক্টরের একটি কোম্পানির কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ সময় জয়মনিরহাট, ভূরুঙ্গামারী, রায়গঞ্জ যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বেই ভূরুঙ্গামারী ও আশপাশের এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে আসে এবং সেখানে মুক্তাঞ্চল গঠিত হয়।

    ১৯ নভেম্বর রাতে আশফাকুস সামাদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী থানার রায়গঞ্জ দখল করতে যান। ওই সময় তাঁরা আগে থেকেই সেখানে থাকা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ফাঁদে পড়ে যান। তবে বিচলিত না হয়ে আশফাক ও তাঁর সহযোদ্ধারা সাহসের সঙ্গে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। দুই পক্ষে শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। অবস্থা বেগতিক দেখে সহযোদ্ধাদের পেছনের দিকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে একাই মেশিনগান দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

    এককভাবে প্রতিরোধের একপর্যায়ে হানাদার বাহিনীর একটি গুলি তাঁর হেলমেট ভেদ করে মাথায় ঢুকে যায়। ফলে প্রচুর রক্তক্ষরণে ঘটনাস্থলেই শাহাদাতবরণ করেন অকুতোভয় বীর যোদ্ধা আশফাক। ওই যুদ্ধে তাঁর সঙ্গে আরও শহীদ হন ইপিআরের সিপাহি কবীর আহমেদ, আবদুল আজিজসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা।

    ২০ নভেম্বর ভোরে অর্থাৎ ঈদের দিন রায়গঞ্জ ব্রিজের কাছে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যায় লেফটেন্যান্ট আশফাকুস সামাদের মরদেহ। পরে উইং কমান্ডার খাদেমুল বাশার ও অন্য মুক্তিযোদ্ধারা লাশ উদ্ধার করে সামরিক কায়দায় শহীদ লেফটেন্যান্ট আশফাকুস সামাদকে স্যালুট জানান। লালমনিরহাট মসজিদের পাশে জানাজার পর ৪১ বার ‘গান স্যালুট’ দেওয়া হয় তাঁকে।

    ইতিহাসের পাতায় একাত্তরের ঈদ

    যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের পরাজিত করে বিজয়ের উল্লাসে মাতোয়ারা মুক্তিযোদ্ধারা

    যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের পরাজিত করে বিজয়ের উল্লাসে মাতোয়ারা মুক্তিযোদ্ধারাছবি: বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বই থেকে নেওয়া

    হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ’–এর দশম খণ্ডে মুক্তিযুদ্ধকালীন ঈদের দিন সম্পর্কে বলা হয়:

    ‘সিলেট অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা অষ্টগ্রামের সালাম টিলা ও মণিপুর টিলার পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর আক্রমণ চালান। পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্যাপক মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এতে বেশ কিছু যোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষ হতাহত হন। কিন্তু এর মধ্যেও মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ প্রত্যাহার না করে অবস্থান দুটি দখলের প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যরা সালাম টিলা ও মণিপুর টিলার অবস্থান ত্যাগ করে পিছু হটে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য একটি দল জকিগঞ্জের পাক-অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালিয়ে জকিগঞ্জ দখল করে নেয়। এই যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য ও ২৩ জন রাজাকার নিহত হয়।

    ‘এদিকে রংপুর অঞ্চলে কুড়িগ্রামের রায়গঞ্জের সিঅ্যান্ডবি সেতুর দুই পাশে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় আক্রমণ চালান। দীর্ঘক্ষণ ধরে যুদ্ধ চলে। সম্মুখযুদ্ধ একপর্যায়ে হাতাহাতি যুদ্ধে রূপ নেয়। সম্মিলিত বাহিনী পাক-প্রতিরক্ষা ভেঙে তাদের রায়গঞ্জ ও আন্দাবীঝড় অবস্থান দুটি দখল করে নেয়। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পাকিস্তানি সৈন্যরা পিছু হটে যায়। যুদ্ধে সম্মিলিত বাহিনীর কমান্ডার সদ্য কমিশনপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুস ছালাম পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে প্রাণত্যাগ করেন। এ ছাড়া আরও দুজন মুক্তিযোদ্ধা এ যুদ্ধে নিহত হন।’

    কবি ও সাংবাদিক সাজ্জাদ শরিফ সম্পাদিত ‘একাত্তরের দিনপঞ্জি: মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক ঘটনালিপি’ গ্রন্থে ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর ঈদের দিনের একটি বর্ণনা পাওয়া যায়।

    ‘এই দিনটি ছিল ঈদ। মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়ের সামনে ঈদের জামাতে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানীসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। ঈদের দিন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস আই নুরুন্নবী খান বীর বিক্রম তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেলটা, ইকো এবং ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার কোম্পানির সৈন্যদের নিয়ে সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায় পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি রাধানগর ঘিরে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলছিলেন। তিনি লিখেছেন, “কোনো অবস্থানেই মুক্তিযোদ্ধারা জামাতের সাহায্যে ঈদের নামাজ পড়ার সুযোগ পায়নি।…নতুন জামাকাপড় পরা বা মিষ্টি-সুজি-সেমাই খাওয়া বা উন্নত মানের খাবারেরও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। দুপুরের দিকে দূরবর্তী গ্রাম থেকে স্বেচ্ছাসেবকেরা কিছুটা উন্নত মানের খিচুড়ির ভার বয়ে নিয়ে এসেছিল।”’

    মুক্তিযোদ্ধার জবানবন্দিতে একাত্তরে ঈদ

    মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, বীর বিক্রম

    ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করে ১৯৬৮ সালে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কমিশন লাভ করেন হাফিজ উদ্দিন আহমদ। ২৭ বছর বয়সে অংশ নেন মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে। যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীর বিক্রম’ উপাধি লাভ করেন। ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের একমাত্র বাঙালি খেলোয়াড়। দেশ স্বাধীনের পর মোহামেডান ফুটবল দলে অধিনায়কত্ব করেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি ছিলেন ছয়বারের সংসদ সদস্য। পানিসম্পদ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

    একাত্তরে প্রবাসী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ পরিদর্শন করছেন

    একাত্তরে প্রবাসী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ পরিদর্শন করছেনছবি: সংগৃহীত

    একাত্তর সালের ঈদ নিয়ে ‘প্রথম আলো’র সঙ্গে স্মৃতিচারণা করেন হাফিজ উদ্দিন আহমদ। তিনি জানান, যুদ্ধের সময় ছিলেন ‘জেড’ ফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানি কমান্ডার। তাঁর অধীনে প্রায় ৭০০ সৈন্য ছিল।

    মেজর (অব.) হাফিজ বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর চাঁদরাতে পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে আমাদের “অপারেশন” ছিল। যুদ্ধের সময় শ্রীমঙ্গলে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায় আমরা অবস্থান করছিলাম। শ্রীমঙ্গল রেলস্টেশনে পাকিস্তানি সৈন্যদের ঘাঁটি ছিল। আমরা রাত দুইটা-তিনটার দিকে অতর্কিতে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাই। এতে ঘটনাস্থলে তাদের বেশ কয়েকজন সৈন্য হতাহত হলেও আমাদের কেউ হতাহত হননি। সফল অপারেশন করে আস্তানায় ফিরে আসার পর সহযোদ্ধাদের কাছে জানতে পারি পরদিন ঈদ।’

    ‘ঈদের দিনও আমাদের পোশাক ছিল ঘামে ভেজা ইউনিফর্ম। নামাজের সময় অস্ত্রটি পাশে সরিয়ে রেখেছিলাম। ঈদ উপলক্ষে বিশেষ কোনো আয়োজন ছিল না। যত দূর মনে পড়ে নামাজের পর সবাই মিলে সেমাই খেয়েছিলাম।

    হাফিজ উদ্দিন আহমদ জানান, ঈদের দিন সকালে সামান্য উঁচু টিলায় ঈদের নামাজ পড়ি। তবে পাকিস্তানি সেনারা যাতে আমাদের আক্রমণ করতে না পারে, সে জন্য নামাজের সময় কিছু সৈন্য ঈদ জামাত পাহারা দেয়। নামাজে ইমামতি করেন ব্যাটালিয়নের ‘রিলিজিয়াস টিচার’।

    তিনি বলেন, ‘আমার এখনো মনে পড়ে, নামাজের সময় সবাই স্বাভাবিক ছিলাম। তবে মোনাজাতের সময় সবাই কান্নাকাটি করেছিল। কারণ, প্রায় ৭ মাস ধরে যুদ্ধ চলছে, সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। পরিবারের সাথে যোগাযোগ নাই, বেশ কিছু সহযোদ্ধাকেও হারিয়েছি। পুরোনো ঈদের স্মৃতি বারবার মনে পড়ছিল। তাই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি।’

    মেজর (অব.) হাফিজ স্মৃতিকাতর হয়ে বলেন, ‘মোনাজাতের সময় আল্লাহকে বলেছিলাম, হে আল্লাহ, আমরা যেন অচিরেই স্বাধীনতা লাভ করি। আমাদের ত্যাগ যেন কোনোভাবেই বিফলে না যায়। এ ছাড়া যে সহযোদ্ধারা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন, সেসব শহীদ ভাই, দেশবাসী এবং আমাদের পরিবারের জন্য দুহাত তুলে দোয়া করি।’

    এক প্রশ্নের জবাবে হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘ঈদের দিনও আমাদের পোশাক ছিল ঘামে ভেজা ইউনিফর্ম। নামাজের সময় অস্ত্রটি পাশে সরিয়ে রেখেছিলাম। ঈদ উপলক্ষে বিশেষ কোনো আয়োজন ছিল না। যত দূর মনে পড়ে নামাজের পর সবাই মিলে সেমাই খেয়েছিলাম। আর সকালে রুটি, দুপুরে ভাত, সবজি ও ডাল এবং রাতে রুটি খেয়েছিলাম। সবই অন্যান্য দিনের রুটিন অনুযায়ী হয়েছিল।’ ঈদ উপলক্ষে বিশেষ কোনো আয়োজন ছিল না বলে জানান হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম।

    ডা. ফওজিয়া মোসলেম, সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

    ১৯৭১ সালে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতা দেখে ঘরে বসে থাকতে পারেননি ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেত্রী ডা. ফওজিয়া মোসলেম। তাঁর স্বামী ছিলেন তৎকালীন ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক সাইফউদ্দীন আহমেদ মানিক। তাই মাত্র এক মাস বয়সী কন্যাশিশু জয়াকে নিয়ে অন্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরার রাজ্যের আগরতলায় চলে যান।

    ‘তখন ঈদ উদ্‌যাপনে উৎসবের আমেজ ছিল না। ‘রিচুয়াল’ হিসেবে আমরা পালন করেছি। ঈদ উপলক্ষে ক্যাম্পে বিশেষ খাবারেরও ব্যবস্থা করা হয়নি। তবে আমার মনে আছে, ক্যাম্পের খাবার ছিল সকালে আলুভাজি আর রুটি। দুপুরে ডালঘন্ট আর ভাত। রাতে ছিল সাধারণ খাবার। ঈদ উপলক্ষে নতুন কাপড়ের সুযোগ ছিল না। এমনকি ছোট্ট বাচ্চার জন্য ঈদের নতুন কাপড় কেনার কথা চিন্তাও করিনি।’

    ডা. ফওজিয়া মোসলেম প্রথম আলোকে বলেন, আগরতলায় ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির গেরিলাদের জন্য তৈরি ক্রাফট হোস্টেলের ক্যাম্পে গিয়ে কাজ শুরু করেন। ওই প্রতিষ্ঠানে আরও কাজ করতেন তাঁরই সহযোদ্ধা ডা. মাখদুমা নার্গিস রত্না। এই দুই চিকিৎসকের কাজ ছিল যারা ক্যাম্পে ট্রেনিং নিতে আসত ও ট্রেনিং শেষ করে যুদ্ধে যেত, সেসব মুক্তিযোদ্ধার ‘ফিজিক্যাল ফিটনেস’ পরীক্ষা করা। এ ছাড়া সাধারণ অসুখের চিকিৎসাও দিতেন তাঁরা।

    ডা. ফওজিয়া জানান, ‘আগরতলায় কামান চৌমুহনী এলাকায় ভাড়া করা বাসায় থাকতাম। সেখানে এক মাসের ছোট বাচ্চাকে পরিবারের কাছে রেখে হাসপাতালে চলে যেতাম। একাত্তরের ২০ নভেম্বর ঈদের দিন অন্য আর দশ দিনের মতো সাদামাটাভাবেই কেটেছে। নতুন শাড়ি পরার সুযোগ হয়নি। ঈদ উদ্‌যাপনের পরিবেশটাই ছিল না। পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুক্তিকামী মানুষ আসছে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে। মাথায় চিন্তা কবে দেশ স্বাধীন হবে, পাকিস্তানি হায়েনাদের হাত থেকে কবে আমরা মুক্তি পাব।’

    ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘তখন ঈদ উদ্‌যাপনে উৎসবের আমেজ ছিল না। ‘রিচুয়াল’ হিসেবে আমরা পালন করেছি। ঈদ উপলক্ষে ক্যাম্পে বিশেষ খাবারেরও ব্যবস্থা করা হয়নি। তবে আমার মনে আছে, ক্যাম্পের খাবার ছিল সকালে আলুভাজি আর রুটি। দুপুরে ডালঘন্ট আর ভাত। রাতে ছিল সাধারণ খাবার। ঈদ উপলক্ষে নতুন কাপড়ের সুযোগ ছিল না। এমনকি ছোট্ট বাচ্চার জন্য ঈদের নতুন কাপড় কেনার কথা চিন্তাও করিনি।’

    মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান

    ভারতে বেঙ্গল লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) বা মুজিব বাহিনীর সদস্যদের সশস্ত্র ট্রেনিং

    ভারতে বেঙ্গল লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) বা মুজিব বাহিনীর সদস্যদের সশস্ত্র ট্রেনিংছবি: বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বই থেকে নেওয়া

    বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান। ১৯৭১ সালে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৩ বছর। পড়তেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে।

    ‘আমার মনে আছে, ঈদের নামাজ পড়ে খুব কান্নাকাটি করছিলাম। মোনাজাতের সময় আল্লাহকে বলছিলাম, হে আল্লাহ, আপনি আমাদেরকে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ড, জুলুম ও নির্যাতন থেকে রক্ষা করুন। আমাদের স্বাধীন করে দিন, আমাদেরকে মুক্ত করে দিন।’

    প্রথম আলোকে তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় রোজার ঈদ হয়েছিল ২০ নভেম্বরে। ওই সময় তিনি বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট, বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর কিশোরগঞ্জের কমান্ডার ছিলেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ঈদের নামাজ পড়ার। তাই আগের দিন ভারতীয় সীমান্তবর্তী সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের কলাগ্রাম ইউনিয়ন এলাকায় গিয়ে একটি মাঠে ঈদের নামাজ পড়েন।

    ফজলুর রহমান বলেন, ‘আমার মনে আছে, ঈদের নামাজ পড়ে খুব কান্নাকাটি করছিলাম। মোনাজাতের সময় আল্লাহকে বলছিলাম, হে আল্লাহ, আপনি আমাদেরকে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ড, জুলুম ও নির্যাতন থেকে রক্ষা করুন। আমাদের স্বাধীন করে দিন, আমাদেরকে মুক্ত করে দিন।’

    তিনি বলেন, ‘ঈদের নামাজ শেষে স্থানীয় গ্রামবাসী আমাদের শ খানেক মুক্তিযোদ্ধাকে সেমাই ও অন্যান্য খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করেছিল। পরে বেলা তিনটার দিকে রওনা দিয়ে সারা রাত নৌকায় চড়ে পরের দিন নেত্রকোনার খালিয়াজুরিতে চলে আসি। তবে ঈদের দিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো অপারেশন করেননি বলে জানান ফজলুর রহমান।’

    ঈদের দিনে ‘যুদ্ধের সংবাদ’

    মাহমুদ হাসান তাঁর ‘দিনপঞ্জি একাত্তর’ বইয়ে যুদ্ধকালীন দিনগুলোর ধারাবাহিক বর্ণনা দেন। সেখানে ঈদের দিনের সংবাদ সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে:

    ‘পাকিস্তান বেতার থেকে বলা হয়, যশোর ও সিলেট সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনী আজ সর্বাত্মক হামলা চালায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হামলা প্রতিহত করে পাল্টা হামলা চালিয়েছে। এদিকে ভারতীয় পার্লামেন্টে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ভারত আশা করে জাতিসংঘ মহাসচিব পূর্ববঙ্গে গৃহযুদ্ধের অবসানে আত্মনিয়োগ করবেন। তিনি বলেন, পূর্ববঙ্গের সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভাগ্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সমস্যাকে ধামাচাপা দিয়ে এটিকে একটি পাক-ভারত বিরোধে রূপান্তরিত করলে তা শুধু সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলবে। আমি জাতিসংঘ মহাসচিবকে এই নিশ্চয়তা দিতে চাই, পাকিস্তান আক্রমণ করার অথবা পাকিস্তানের সাথে সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার কোনো ইচ্ছেই আমাদের নেই।’

    তথ্যসূত্র:

    ১. হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ
    দলিলপত্র: ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও একাদশ খণ্ড, তথ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, জুন ১৯৮৪
    ২. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর-৬), মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
    ৩. আব্দুল মান্নান সম্পাদিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মুখপত্র ‘জয় বাংলা’
    ৪. একাত্তরের ঈদের এই দিনে, লে. কর্নেল নুরুন্নবী খান, বীর বিক্রম
    ৫. ‘একাত্তরের দিনপঞ্জি: মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক ঘটনালিপি’, সম্পাদনা সাজ্জাদ শরিফ
    ৬. ডেইলি স্টার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২
    ৭. বাংলাদেশ: ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড, আফসান চৌধুরী, ফেব্রুয়ারি ২০০৭
    ৮. ‘দিনপঞ্জি একাত্তর’, মাহমুদ হাসান, ফেব্রুয়ারি ২০১৩
    ৯. বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম, ডা. মাহফুজুর রহমান, ১৯৯৩

    picks
    Share. Facebook WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবাংলাদেশের জামায়াত-ই-ইসলামীকে বিদেশী সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করুন
    Next Article ড. ইউনুসকে পাঁচ বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট দেখতে চাই: নয়া ষড়যন্ত্রের গন্ধ
    JoyBangla Editor

    Related Posts

    বিশ্লেষণ || তোমরা কি ভুলে গেছো মল্লিকাদের নাম?

    June 2, 2025

    অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর তাজুলের অপসারণ চায় ছাত্র ইউনিয়ন

    June 2, 2025

    ক্ষমতা দখল করলেই সরকার হওয়া যায় না — এটা দুনিয়া দেখিয়ে দিল ইউনুসকে

    June 1, 2025

    মৃত সোলাইমান সাক্ষী দিবেন আদালতে কিভাবে!

    June 1, 2025
    Leave A Reply Cancel Reply

    সম্পাদকের পছন্দ

    বিশ্লেষণ || তোমরা কি ভুলে গেছো মল্লিকাদের নাম?

    June 2, 2025

    অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর তাজুলের অপসারণ চায় ছাত্র ইউনিয়ন

    June 2, 2025

    ক্ষমতা দখল করলেই সরকার হওয়া যায় না — এটা দুনিয়া দেখিয়ে দিল ইউনুসকে

    June 1, 2025

    মৃত সোলাইমান সাক্ষী দিবেন আদালতে কিভাবে!

    June 1, 2025
    • Facebook
    • Twitter
    • Instagram
    • TikTok
    মিস করবেন না
    Lifestyle

     বাঙালি, পরিচয় সবখানে বাঙালি

    By JoyBangla EditorJune 2, 20250

    ।। মহিউদ্দিন মোহাম্মদ।। ‘বাঙালি’ আর ‘বাংলাদেশী’ এক জিনিস নয়। বাঙালি হলো জাত, জাতি, নির্দিষ্ট খাসলতের…

    ড: ইউনুস গংরা পরিকল্পিতভাবে  ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে বাংলাদেশকে ঠেলে দিচ্ছে,  এক গভীর ষড়যন্ত্র

    June 2, 2025

    অর্থনীতির গতি মন্থর, বিনিয়োগ ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন

    June 2, 2025

    বিশ্লেষণ || তোমরা কি ভুলে গেছো মল্লিকাদের নাম?

    June 2, 2025

    সাবস্ক্রাইব

    সর্বশেষ খবরের সাথে আপডেট থাকুন।

    About Us
    About Us

    মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ ও লালন করে দেশ ও বিদেশের খবর পাঠকের কাছে দুত পৌছে দিতে জয় বাংলা অঙ্গিকার বদ্ধ। তাৎক্ষণিক সংবাদ শিরোনাম ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পেতে জয় বাংলা অনলাইন এর সঙ্গে থাকুন পতিদিন।

    Email Us: info@joybangla.co.uk

    Our Picks

    বিশ্লেষণ || তোমরা কি ভুলে গেছো মল্লিকাদের নাম?

    June 2, 2025

    অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর তাজুলের অপসারণ চায় ছাত্র ইউনিয়ন

    June 2, 2025

    ক্ষমতা দখল করলেই সরকার হওয়া যায় না — এটা দুনিয়া দেখিয়ে দিল ইউনুসকে

    June 1, 2025

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.