।। নিলুফা ইয়াসমীন হাসান।।
লন্ডন: যুক্তরাজ্যে বসবাসরত একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগে আয়োজিত মহান স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে জাতির উদ্দশ্যে প্রশ্ন রেখে বলা হয়েছে, একজন মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা দেখার জন্যই কি আমরা জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম? একজন মুক্তিযোদ্ধার অপমান কি সারা জাতির অপমান নয়?
একাত্তরের রনাঙ্গনের মোট ১৮জন মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিতিতে হলভর্তী উপচে পরা দর্শকদের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠানের সভাপতি যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের সাবেক হাই কমিশনার, বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব গিয়াস উদ্দিন আহমেদ যখন এই প্রশ্ন ছুড়ে দেন, তখন অনুষ্ঠানে নেমে আসে পিনপতন নিরবতা। লজ্জায় নত হয়ে বসে থাকেন হলভর্তী দর্শকরা।

জনাব গিয়াস উদ্দিন ‘বৈষম্য বিরোধী’ আন্দোলন নামের নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, বঙ্গবন্ধু, জাতীয় নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান, জয় বাংলা এগুলো নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেন? একবারও কি ভেবে দেখেছেন, এবিষয়গুলো অস্বীকার আর আমরা নিজেরা নিজেদের অস্বীকার করা কি এক নয়? তিনি বলেন বৈষম্যের কথা বলে স্বাধীনতাকে আঘাত করছেন? বৈষম্যের কি দেখেছেন আপনারা। পাকিস্তানী আমলে পাকিস্তান আর্মিতে ২%ও বাঙালী ছিলোনা, সিভিল সার্ভিসে ছিলোনা ৫%ও। আমরা সেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যে স্বাধীনতা আনলাম, সেই স্বাধীনতা আজ আপনারা মুছে ফেলতে চান? ভুলে যাবেন না ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনা।
৬ই এপ্রিল, রবিবার বিকেলে পূর্ব লন্ডনের ব্রাডি আর্টস সেন্টারে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে সাংবাদিক, রাজনীতিক, সংস্কৃতিকর্মী ও কমিউনিটির বিশিষ্টজনরা ছিলেন উপস্থিত। বসার জায়গা না পাওয়ায় বিপুল সংখ্যক দর্শক দাড়িয়ে দাড়িয়ে শুনেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের আবেগঘন স্মৃতিচারণ, অনুধাবণ করেছেন তাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরন জনিত বুকের চাপা কষ্ট।
অনুষ্ঠানে মূল আলোচক ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচয়িতা ও অন্যতম সংবিধাণ প্রণেতা ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলামের কন্যা ব্যারিষ্টার তানিয়া আমির।

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, বাহাত্তরের সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান জয় বাংলা মুছে ফেলতে চায়- এরা কারা? আজকের এই অপশক্তির পূর্বসূরী পাকিস্তানীরা একাত্তরে ৩০ লক্ষ মানুষের জীবন নিয়েও যে জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি, এরা সেই জাতির স্বাধীনতা নিশ্চিহ্ন করতে চায় আজ ৫৪ বছর পর এসে?
তিনি বলেন, বাঙালি একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি। ১৯৭১ এর ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচিত হওয়ার পর ১৭ই এপ্রিল বাদ্যনাথ তলায় তা আনুষ্ঠানিক ঘোষিত হয়। ভারত সরকার যখন যথাযোগ্য মর্যাদায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারকে সব ধরনের সহযোগীতায় রাজি হয়, তখনই তাজ উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকার ভারতের ঐ সহযোগিতা গ্রহন করেন।
তানিয়া আমির বলেন, পরম বিপদের সময়ও যখন আমাদের পূর্বপ্রজন্ম জাতীয় আত্মমর্যাদার প্রশ্নে আপোষ করেননি, সেখানে আজ ৫৪ বছর পর এসে কারো হুমকি ধামকিতে ঐ প্রজন্মের উত্তরসূরীরা ভয় পেয়ে যাবে এটি যেন কেউ না ভাবে। তিনি বলেন, বারবার আমাদের স্বাধীনতার উপর আঘাত আসে, বারবার আমরা তা প্রতিরোধ করি। এর কারন আমরা শত্রুদের ক্ষমা করে দেই এবং তারা এই ক্ষমার সুযোগে বারবার হিংস্র হওয়ার সুযোগ পায়। ব্যারিষ্টার তানিয়া বলেন, আসুন এবার থেকে আমরা শত্রুদের ক্ষমা করার কথা ভুলে যাই। কারন ক্ষমা যতবার করবো, ততবারই এরা আবারও হিংস্র হয়ে আমাদের স্বাধীনতায় থাবা বসাবে। এভাবে যদি চলে আমরা দেশ গড়বো কিভাবে?

প্রখ্যাত টেলিভিশন উপস্থাপিকা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব উর্মি মাজহারের উপস্থাপনায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ৩০ লক্ষ মানুষ, জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাসহ সকল শহীদদের স্মরণে দাড়িয়ে নিরবতা পালনের মাধ্যমে শুরু হয় অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান শুরুর ঘোষণার পরপরই ‘ওরা আসবে চুপি চুপি…’ গানের তালে তালে ধীরে ধীরে হেঁটে অনুষ্ঠানে এসে উপস্থিত হন দেওয়ান গৌস সুলতান, লোকমান হোসেন, আবু মুসা হাসান ও ফয়জুর রহমান খানসহ বর্তমানে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত মোট ১৮জন মুক্তিযোদ্ধা। হলভর্তি দর্শকরা তখন ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মাধ্যমে দাড়িয়ে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই মুক্তিযোদ্ধা ফয়জুর রহমান খান ও মুক্তিযোদ্ধা আবু মুসা হাসান রাখেন সংক্ষিপ্ত বক্তব্য।
ফয়জুর রহমান খান তার বক্তব্যে উপস্থিত দর্শকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, বাঙালির স্বাধীনতা যখন শকুনদের আক্রমনে ক্ষতবিক্ষত, ঠিক এমনি মুহূর্তে আজকের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে আপনারা আমাদের সাহস আবার ফিরিয়ে এনেছেন। যেকোন দুর্যোগেই জয় বাংলা স্লোগানে আবার আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারবো এই আত্মবিশ্বাস আজ ফিরে পেলাম।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মুসা হাসান বলেন, আজ আমরা ৫৪তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছি এমন এক সময়ে যখন আমাদের প্রিয় দেশমাতৃকার স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়েছে, যখন আমাদের অহংকার ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধকে মুছে ফেলার জন্য স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি উঠে পড়ে লেগেছে।
লাখো শহীদের রক্তে কেনা স্বাধীনতার গৌরবগাথা মুছে ফেলার জন্য চলছে একের পর এক চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র। তিনি বলেন, বালাদেশে এবারের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ও কর্মসূচিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের নাম উচ্চারিত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর দুনিয়া কাপানো ৭ই মার্চের ভাষন এখন নিষিদ্ধ হয়ে গেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় যে জয়বাংলা শ্লোগান ছিল আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস, যে জয় বাংলা শ্লোগান পাকিস্তানি হায়েনাদের বুকে কাপন ধরাতো, সেই জয়বাংলা শ্লোগানও আজ নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।
আবু মুসা হাসান বলেন, ১৯৭০ সালের ৭ই মার্চ তৎকালীন রমনা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষন – যার যা আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার নির্দেশ, “ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম – এবারের সংগ্রাম – স্বাধীনতার সংগ্রাম” সমগ্র বাগালি জাতিকে উজ্জীবিত করে তুলেছিল। বঙ্গবন্ধুর বজ্র কণ্ঠের ঘোষণার পরই সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। তাই ২৫ শে মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অতর্কিত হামলায় বাঙালি জাতি দিশেহারা না হয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর আজ ভাবতে অবাক লাগে, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাসভবন বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দিয়ে জাতির জনকের অবদানকে মুছে ফেলার অপপ্রয়াস চলছে। দেশব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের স্থাপনাগুলো গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, ভেঙে ফেলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সাত বীরশ্রেষ্ঠের ম্যুরাল। ১৯৭১ সালের ১৭ ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম বাগানে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এর অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের স্মৃতি বিজড়িত মুজিবনগরের স্থাপনাগুলো মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে।
হাসান বলেন, আমি আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আজ নির্দ্ধিধায় বলতে পারি, বঙ্গবন্ধুর অমর কীর্তি মুছে ফেলা সম্ভব হবেনা, বাঙালির মনের মণিকোঠা থেকে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি মুছা যাবে না, বাগালির হৃদয় থেকে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা কে মুছা যাবেনা।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মুসা হাসানের দৃপ্ত ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব। আমরা যতদিন বেঁচে থাকবো, ততদিন এই অহংকার এবং গর্বকে নিয়েই বেঁচে থাকবো। আমরা ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান জয়বাংলা, ৭২ এর সংবিধান, জাতির জনক, জাতীয় সঙ্গীত এবং জাতীয় পতাকার প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ছাড় দেবনা। অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণের ফাঁকে ফাঁকে ছিলো দেশের গান ও কবিতা আবৃত্তি।