।। দেশের স্থিতিশীলতার জন্য রাজনৈতিক সরকারই শেষ ভরসা ।।সাংঘর্ষিক রাজনীতি চিরতরে বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। ।
[বাংলাদেশ সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ জয় বাংলা’ নিউজ পোর্টালকে সাক্ষাতকার দেন। বাংলাদেশে বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশে তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা গুরুত্বপূর্ণ, এ নিয়ে কথা বলেন জয় বাংলার প্রতিবেদকের সাথে। প্রশ্নোত্তর ও কথোপকথন পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।]
১. সাম্প্রতিক বিষয় নিয়েই প্রশ্ন করা হয় প্রথমে। বিশেষত বাংলাদেশী রপ্তানি পন্যের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭% শুল্ক আরোপকে নিয়ে কথা বলা হয। প্রশ্ন ছিল, এই শুল্ক আরোপকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
উত্তর: বাংলাদেশের রপ্তানি পন্যের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭% শুলক আরোপ বিরাট অশনি সংকেত। এটা মারাত্মক ধরণের কূটনৈতিক ব্যর্থতা। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও মার্কিন সরকার এই শুল্ক আরোপ করেছে। কিন্তু সহনীয় মাত্রায়। পাকিস্তান ও ভারতের ওপর আরোপিত শুল্কও অনেক কম। বাংলাদেশের ওপর এতো বেশি কেন? এটা কূটনৈতিক ব্যর্থতার ফসল। দেশ এক বিপন্ন পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে।
২. ব্যাংককে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদী ও ড. ইউনুস বৈঠক সম্পর্কে কিছু বলুন।
উত্তর: ব্যাংককে একটি আর্ন্তজাতিক সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা মিলিত হয়েছিলেন। এক সাথে বসেছেন, আলোচনা করেছেন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে। এখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে ড. ইউনুসের একটি সৌজন্য বৈঠক হয়েছে। এ বৈঠকে নরেন্দ্রমোদী জোর দিয়েছেন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধে এবং আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের হয়রানিসহ হামলা-মামলা বন্ধকরা নিয়ে। এগুলোই গুরুত্ব পেয়েছে। একই সাথে জঙ্গিবাদের উত্থানেও ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
৩. আর্ন্তজাতিক প্রসঙ্গ ছাড়া দেশের আভ্যন্তরীন রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে চাই। সংবিধান সংশোধন বা নতুন সংবিধান রচনার কথা বলা হচ্ছে। ইউনুস কি এখতিয়ার রাখেন সংবিধান পরিবর্তন করার?
উত্তর: এই প্রশ্নে সাবেক এই নীতিনির্ধারক মন্ত্রী বলেন, সংবিধান সংশোধন বা সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। একটি নির্বাচিত সংসদই এটি করার জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ।
৪. বাংলাদেশে নির্বাচন হবে কিনা আপনি মনে করেন। যদি নির্বাচন হয়, তবে আওয়ামীলীগ অংশ নিবে কিনা? আওয়ামীলীগকে তো রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না বলে বলা হচ্ছে। তাহলে কি করে নির্বাচনে অংশ নিবেন?
উত্তর: দেশে নির্বাচন দরকার। নির্বাচন না হলে অর্নিবাচিত কোন সরকার অনির্দিষ্টকাল দেশ চালাতে পারে না। কিন্তু নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ প্রয়োজন। বলা হচ্ছে, আওয়ামীলীগকে নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না। যারা মেটিকুলাসলি ডিজাইনের মাধ্যমে এখন ক্ষমতায় আছে তাদের একটি অংশ এবং গণতন্ত্র বিরোধী অপশক্তি চায় না আওয়ামীলীগ নির্বাচনে আসুক।আওমীলীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য অবশ্যই সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ পরিবেশ এবং Level playing field দরকার।সেক্ষেত্রে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই অংশ নেয়া হবে।
৫. সাধারণ নাগরিকরা নিরাপত্তাহীনতায় আছে।‘মবজাস্টিজ’ চলছে দেশে এবং গণমাধ্যমের ওপরেও মবজাস্টিজ চলছে। গণমা্ধ্যমে স্বাধীনতা নেই। একটি বিশেষমহল এসব ঘটাচ্ছে, সরকার নীরব। মানুষ কি আবার এই অবস্থা বা এই অবস্থার মদদ দাতা হিসাবে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামবে মনে করেন?
উত্তর: গণমাধ্যমের স্বাধীনতা তো দূরের কথা, ‘মবজাস্টিজ’ সৃষ্টিকারীরা গণমাধ্যম দখল করেই ফেলেছে। মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় আছে শুধু না, ‘মবের মুল্লুক’ আর ‘মগের মুল্লুক’ দুটিই এখন দেশে কার্যকর। প্রায় ১ লাখ আওয়ামী নেতাকর্মী জেলে,১ কোটি মানুষ ব্যবসা সহায়সম্বল হারিয়েছে লুটপাটের কারণে এবং ঘর ছাড়া। মানুষ ত্যাক্ত বিরক্ত,বিক্ষুদ্ধ। মানুষ ক্ষোভে ফুঁসছে। অস্বস্থিতে আছে মানুষ। ভবিষ্যতই বলবে মানুষ কি করবে।
৬. মৌলবাদের যে উত্থান ঘটেছে, সেটা কি আওয়ামীলীগ সরকারের ‘হেফাজতসহ অন্যান্য ইসলামী দলের সাথে ‘সমজোতা’র ফসল?
উত্তর: হেফাজতের সাথে ‘সমজোতার’ প্রশ্ন আনা সঠিক নয়। কওমী শিক্ষাকে আধুনিকরণ করার একটি উদ্যোগ আওয়ামীলীগ নিয়েছিল। এটি সমজোতা নয়। কওমী সনদের স্বীকৃতিপ্রদান করে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে মূল ধারায় নিয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি করেছিল সরকার। এখানে বিভাজন থেকে মুক্ত করা হয়েছে সমাজকে। জঙ্গী তো শুধু মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে বলা ঠিক নয়, আমরা দেখেছি মূলধারার উচ্চশিক্ষিত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে জঙ্গীরা সক্রিয়। হলি আর্টিজান ঘটনায় যারা জড়িত ছিল, তাদের পরিচয় সবাই জানেন। তা উল্লেখযোগ্য প্রমাণ।
৭. মুক্তিযুদ্ধকে মুছে ফেলার যে ষড়যন্ত্র চলছে, ইউনুস ও তার কিংস পার্টি ‘এনসিপি’ একই সুরে কথা বলছে, এটা কি শুধুই আভ্যন্তরীন ষড়যন্ত্র, না আর্ন্তজাতিক ষড়যন্ত্র?
উত্তর: অবশ্যই আর্ন্তজাতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে মুছে ফেলার জন্য দেশীবিদেশী একাত্তরের পরাজিত শক্তি একাট্টা হয়েছে। ড.ইউনুস সাহেবের পরামর্শেই ‘এনসিপি’ গঠিত হয়েছে বলে তারা বলেছে। আগে বলেছি, মেটিকুলাসলি যে ডিজাইন তারা বাস্তবায়ন করেছে, এটা এই ষড়যন্ত্রের ফসল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ মুছে ফেলা যাবে না।
৮. বাংলাদেশের শিল্পখাতের বহু প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। মিডিয়ার খবরের মতে পোশাকখাত তো ধংশ হয়ে যাচ্ছে। এতে অর্থনৈতিকভাবে দেশ কি দেউলিয়া হতে পারে?
উত্তর: শিল্পখাত তো ধংসের পথে। প্রায় ৫০০ পোশাক কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। ৫লক্ষাধিক শ্রমিক চাকরি হারিয়েছে শুধু পোশাকখাতে। অন্যান্য খাতে আরো বিপুল সংখ্যক মানুষ চাকরিচ্যুত হয়েছে। মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। এই সময়ে মার্কিন শুলক আরোপ ৩৭%। অশনি সংকেত তো বটেই। আগেই বলেছি, দেশ এক বিপন্ন পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে।
এই জন্য দরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন।নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা। যে কোনো দেশপ্রেমিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র নির্বাচিত সরকারের এখতিয়ার।অর্থনৈতিক বলুন আর রাজনৈতিক বলুন যে কোনো স্থিতিশীলতার জন্য রাজনৈতিক সরকার শেষ ভরসা।
৯. তাহলে, বাংলাদেশে সুষ্টু রাজনৈতিক ধারা প্রবর্তনের উপায় কি?
উত্তর: আমাদের দেশে আসলে সাংঘর্ষিক এবং নেতিবাচক রাজনীতি দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। এখন দেশে যা ঘটছে তা অকল্পনীয়। আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের ঘরবাড়ি পর্যন্ত ভেঙে/জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে/হচ্ছ। এগুলো ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক উদাহরণ সৃষ্টি করছে। এই চরদখলের, সাংঘর্ষিক রাজনীতি চিরতরে বন্ধ হওয়া দরকার। একদল আরেক দলের বিরুদ্ধে সব কিছুতে না বলার নেতিবাচক রাজনীতিও বন্ধ হওয়া চাই। আসলে দেশে National reconciliation খুবই প্রয়োজন। জাতিকে বিভক্ত করার পরিবর্তে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার রাজনীতি হতে হবে।তাহলেই দেশকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে, অন্যথায় নয়।