।। ড. শামীম আহমেদ।।
আজ একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক বিষয়ে কথা বলব যে বিষয়ে এই মুহুর্তে বাংলাদেশীরা বিভ্রান্ত হয়ে আছে বলে মনে করছি। যারা রাজনীতি সচেতন, সে আপনি যে দলের সমর্থকই হোন না কেন, জেনে রাখলে আপনার জন্য ভালো হবে।
প্রথম বিষয়টা হচ্ছে ইদানীং বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ ‘লালবদর’ নিয়ে। লালবদর নিয়ে কথা বলার জন্য ফ্যাসিজম বা ফ্যাসিবাদ কী সে বিষয়েও একটু কথা বলতে হবে। এই লালবদর কিন্তু জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও অগাস্ট ষড়যন্ত্রের সাথে সাথে শুরু হয় নাই। শুরু হয়েছে তারও বহু পরে। যেটা কৌতুহলোদ্দীপক বিষয় সেটা হচ্ছে ৫ অগাস্টের পর তুমুলভাবে আওয়ামী লীগ সরকারকে ‘ফ্যাসিস্ট’ বলা শুরু হয় এবং সেটিতে জনগণের ব্যাপক সমর্থন ছিল। কিন্তু তারপর যখন মানুষ দেখা শুরু করল হাসিনা পরবর্তী সরকার মূলত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মোছার সর্বাত্মক চেষ্টায় লিপ্ত, তখন হঠাৎ করে সবাই বুঝে গেল, শেখ হাসিনা যদি ফ্যাসিস্ট হন, তাহলে ইউনুস হচ্ছে মেগাফ্যাসিস্ট।
আমি আপনাদের কাগজে লিখতে দিতে পারি যারা ফ্যাসিস্ট শব্দটা ব্যবহার করে, তাদের ৮০ শতাংশ মানুষ ফ্যাসিস্ট শব্দটার অর্থই জানে না। তারা সম্ভবত স্বৈরাচার অর্থে ফ্যাসিস্ট শব্দটা ব্যবহার করে। শুনতে একটু যুতসই মনে হয়, তাই এর ব্যাপক ব্যবহার আমরা দেখেছি। তবে অগাস্ট ষড়যন্ত্রের কুশীলব অর্থাৎ ডার্টি মাস্টারমাইন্ডরা শেখ হাসিনার পতনের পর তাকে ‘ফ্যাসিস্ট’ উপাধি দিবে, এই সিদ্ধান্ত বহু আগেই নিয়েছে, তাদের ডিপস্টেট মিটিং এ – একাধিকবার, দেশে ও দেশের বাইরে ও অনলাইন আলোচনায়। তাদের আলটিমেট লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সকল শক্তিকে ফ্যাসিস্টের আবরণে মুড়িয়ে দেয়া এবং এই চেষ্টা নতুন কিছু নয়। আরব বসন্তে ডিপ স্টেট যে মডেলে কাজ করেছে, এটি তারই ধারাবাহিকতা।
ফ্যাসিবাদ কী সেটা যারা জানেন না, তাদের একটু জানাই। না জানার মধ্যে লজ্জার কিছু নাই। আপনি প্রতিনিয়তই শিখতে পারেন, শিখলে নিজেরই লাভ হবে। স্ক্রিনশট নিয়ে রাখতে পারেন। মাঝে মাঝে বের করে পড়ালেখা করলেন। ভবিষ্যতে যখন মিথ্যাচার করবেন, অন্তত জেনে করতে পারবেন। আর যদি পড়ার পর হেদায়েত লাভ হয়, তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ!
ফ্যাসিবাদ হলো চরম ডানপন্থী, কর্তৃত্ববাদী, একনায়কতান্ত্রিক ও অতি জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ। যেখানে স্বৈরশাসন, সামরিক শক্তির বহিঃপ্রকাশ, বিরোধীদের দমন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ মূখ্য বিষয়। এটি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, উদারনীতি ও মানবাধিকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
এখন শেখ হাসিনা চরম ডানপন্থী ছিলেন? অবশ্যই না। শেখ হাসিনা রাজনীতি জীবনের শুরুতে ছিলেন বামপন্থী ঘরানার, ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবার পর ধীরে ধীরে লিবারেল বামপন্থী এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর তিনি ক্রমশ লিবারেল কাম ডানঘেঁষা মধ্যপন্থী হয়ে যান। তার ডানপন্থীদের সাথে আঁতাত strategically ভুল ছিল, যেটি এখন বোঝা যাচ্ছে কিন্তু সেটি উনাকে বামপন্থী থেকে ডানপন্থী বানিয়ে দেয়নি।
শেখ হাসিনা কর্তৃত্ববাদী ছিলেন? হ্যা। তিনি একনায়কতান্ত্রিক ছিলেন? কিছুটা। স্বৈরশাসন তার রাষ্ট্রপরিচালনায় ধীরে ধীরে জায়গা করে নিয়েছে কিন্তু তিনি একনায়ক ছিলেন, এমনটা বলা যাবে না। বিএনপির বয়কট সত্বেও দেশে বহুতান্ত্রিক গণতন্ত্রের বহু লক্ষণ ছিল; এমনকি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতে ইসলামীও নিষিদ্ধ ছিল না। তারা সংসদে গিয়েছে, কথা বলেছে। যখন বয়কট করেছে, নিজের ইচ্ছায় করেছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ তে একপক্ষীয় নির্বাচন করা যেমন আওয়ামী লীগের ভুল ছিল, তেমন ওইসব নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা বিএনপির ভুল ছিল বলে মনে করি। বিএনপি যদি অংশগ্রহণ করত, তাহলে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা দখলের জন্য রাতের ভোটের চিত্র আরও নগ্নভাবে প্রকাশ পেত! আমার ধারণা সেটি তাদের পতন ত্বরান্বিত করত, এবং সেই পতনের ফলে বিএনপি ক্ষমতায় আসত, একটি বর্বর উগ্র মৌলবাদী অনির্বাচিত সরকার নয়। এক অর্থে আওয়ামী রাতের নির্বাচন করে দেশের যতটা ক্ষতি করেছে, নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপিও কম ক্ষতি করেনি। এখন বিএনপি ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে এবং জাতিসংঘ ও ডিপস্টেট মনোনিত অনির্বাচিত সরকার বিএনপিকেও আর নির্বাচনের মাধ্যমে সহসা ক্ষমতায় আসতে দিতে চায় না।
ফিরে আসি ফ্যাসিজমের আলাপে। শেখ হাসিনা বিরোধীদের দমন করেছে আমার মনে হয়নি। রিজভি, মির্জা ফখরুল বছরের পর বছর প্রতিদিন মিডিয়ায় ঘ্যানর ঘ্যানর করেছে। আসিফ নজরুল বছরের পর বছর প্রথম আলোয় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লিখে গেছে। রুমিন ফারহানা অক্লান্তভাবে আওয়ামী লীগকে টিভিতে গালি দিয়ে গেছে। যত টিভি টকশো দেখেছি, সবগুলোতে আওয়ামী লীগের সমালোচনা দেখছি। বাকস্বাধীনতায় কোন সমস্যা দেখিনি, দুই একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া।
শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন? না। বিরোধীদল পরিকল্পিতিভাবে সংসদ বর্জন করেছে, নির্বাচন বর্জন করেছে, তার দায়ভার একা শেখ হাসিনার নয়। এই যে ক্ষমতায় কম্মফোর্ট জোন গ্রো করেছিল, সেটির জন্য বিএনপিও দায়ী। সংসদে না গিয়ে, নির্বাচন না করে – শেখ হাসিনাকে এই যে আরামে ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারটা, সেটি তারাই শিখিয়েছিল।
শেখ হাসিনা সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন? না। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে সমাজতন্ত্রের প্রায়োগিক দিক অসম্ভব প্রায়। এর মাঝেও শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধ ভাতা, বিধবা ভাতা, হতদরিদ্র ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের মূলতন্ত্রের আশেপাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। শেখ হাসিনার সময় সবাই পত্রিকায় যা ইচ্ছা লিখেছে, টিভিতে যা খুশী বলেছে। খুশী মনে না হলেও শেখ হাসিনা সেগুলো মেনে নিয়েছে, তাই তিনি উদারপন্থী ছিলেন না, আমি বলব না। তিনি ১০ লক্ষ রোহিংগাকে দেশে আশ্রয় দিয়েছেন, পাকিস্তানের বিহারিদের পাসপোর্ট ও ভোটাধিকার দিয়েছেন, তাই তাকে মানবতাবিরোধী বলারও সুযোগ নেই।
তাই বেশীভাগ সূচক বিবেচনা করলে শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট বলার কোন সুযোগ নেই। শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট হলে ট্রাম্প ফ্যাসিস্ট, বাইডেন ফ্যাসিস্ট, মোদী ফ্যাসিস্ট, নেতানিয়াহু ফ্যাসিস্ট, ইমরান খান ফ্যাসিস্ট, এরদোগান ফ্যাসিস্ট। বাংলাদেশের আগের সব সরকারও ফ্যাসিস্ট। সবচেয়ে বড় ফ্যাসিস্ট ইউনুস। এসব বুঝতে পেরে তাই ক্রমাগত ফ্যাসিস্ট শব্দের ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছে ডার্টি মাস্টারমাইন্ডস ও পঞ্চতান্ডবেরা।
এবার আসেন লালবদর নিয়ে আলাপ করি। ১৫ জুলাই থেকে ২৯ জুলাই ক্রমাগত ছাত্র হত্যা এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার অশোভন ও অসংলগ্ন কথাবার্তা, দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা, ষড়যন্ত্র রুখতে ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে ৩০ জুলাই দেশের অধিকাংশ মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে ডিপ স্টেটের লাল প্রোফাইল অর্থাৎ কালার কোডেড ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেয়। চরম আওয়ামী লীগ করে এমন অসংখ্য মানুষ তাদের ফেইসবুকের প্রোফাইল লাল করেছিল। আমাকে যদি বলেন রাজনৈতিকভাবে দূরদর্শী হবার কারণে আমি আমার প্রোফাইল লাল না করলেও যারা ওইদিন প্রোফাইল লাল করেছিল তাদের অধিকাংশ যারা ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত ছিল না, তাদের প্রতি আমার কোন ক্ষোভ ছিল না। আমি মনে করি দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে, নিজের ভাই বোনদের বেঘোরে প্রাণ হারাতে দেখার শোক থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে তারা প্রোফাইল লাল করেছিল। এখন মেগাফ্যাসিস্ট ইউনুস, তার ডার্টি মাস্টারমাইন্ডস ও পঞ্চতান্ডবরা ক্রমশ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় তাদের খোলস উন্মোচন করায় অনেকেই সেটি বুঝতে পারছেন। কিন্তু ঐদিন ঐ মুহুর্তে তাদের অবস্থান ঠিক ছিল বলেই মনে করি।
এখন ৩০ জুলাই কেউ প্রোফাইল পিকচার লাল করলেই তাদের পাকিস্তানপন্থী বা মৌলবাদ ভাবা অন্যায়। বরঞ্চ এটি করে এখন যাদের বোধোদয় হচ্ছে তাদের সাথে আমরা দূরত্ব তৈরী করে ফেলছি কিনা সেটি বিবেচনা করতে হবে।
আমি আপনাদের আজকে এটি পরিষ্কার করে জানিয়ে দিচ্ছি, আমার এই বার্তা কেবল যারা প্রোফাইল পিকচার লাল করেছিলেন তাদের প্রতিই নয়, বরঞ্চ আওয়ামী নেতাকর্মী ও স্বাধীনতাকামী মানুষদের জন্যেও। মনে রাখবেন, ‘লালবদর’ যে শব্দটি আমরা ব্যবহার করছি তা দিয়ে আমরা যারা ৩০ জুলাই প্রোফাইল পিকচার লাল করেছিল তাদের বোঝাচ্ছি না। লালবদর শব্দটি এসেছে আলবদর থেকে। আলবদর ছিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর, তারা দেশের ভিতরে বাংলাদেশী হয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দালাল হয়েছিল। ঠিক একইভাবে লালবদর হচ্ছে তারা যারা বাংলাদেশী হয়েও পাকিস্তানের আদর্শ এ দেশে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যারা চায় বাংলাদেশ কেবল মুসলমানদের হবে, যারা দেখতে চায় বাংলাদেশ একটি উগ্র মুসলমান দেশে পরিণত হচ্ছে, যারা চায় এদেশে নারীর অধিকার থাকবে না, যারা চায় বাংলাদেশ ইসলামিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত হোক, পাকিস্তানে পরিণত হোক, আফগানিস্তানে পরিণত হোক, ইরানে পরিণত হোক!
লালবদর মানে যারা যৌক্তিকভাবে ৩০ জুলাই ছাত্র হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে প্রোফাইল পিকচার লাল করেছিল – তারা নয়। লালবদর তারা যারা সব জেনে শুনে কোটার নামে মিথ্যা আন্দোলন করে নিজেরাই ছাত্রদের গুলি করে মেরেছে, যারা কোটার দাবিকে একদফা দাবীতে রূপান্তরিত করেছে, যারা জেনেশুনে বাংলাদেশকে পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চেয়েছে।
লালবদর তারা যারা ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানে লজ্জিত হয় না।
লালবদর তারা যারা মনে করে সমাজে একাকী চলা নারী বা শিশুদের ধর্ষণ করা যায়।
লালবদর তারা যারা মনে করে মাদ্রাসার বালকদের হুজুর দ্বারা বলাৎকার ঈমান রক্ষার অংশ।
লালবদর তারা যারা মনে করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভুল ছিল।
লালবদর তারা যারা বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক মানে না।
লালবদর তারা যারা ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকে ২০২৪ এর ষড়যন্ত্রের সাথে তুলনা করে।
লালবদর তারা যারা সারা দেশের মুক্তিযুদ্ধের সকল নিদর্শন ধ্বংস করে ফেলছে।
লালবদর তারা যারা জয় বাংলা স্লোগানকে ভয় পায়।
তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে আমরা কাকে লালবদর বলছি। আমি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের ও আওয়ামী লীগের ভাই বোনদের বলতে চাই, আপনারা নিশ্চিত করবেন কেবল ছাত্রহত্যার শোকে যারা ৩০ জুলাই তাদের প্রোফাইল লাল করেছিল – তাদের লালবদর বলবেন না। সাথে সাথে সাধারণ মানুষ যারা ফ্যাসিবাদ কী তা জানতেন না, তাদের বলতে চাই বিগত সরকারকে ফ্যাসিস্ট বলবেন না। ফ্যাসিজম অনেক গভীর বিষয়, এর সাথে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সংশ্লিষ্টতা সামান্যই। স্বৈরাচার বলতে পারেন চাইলে, সেটা আপনার সুখের জন্য – কিন্তু ফ্যাসিস্ট বললে আপনার জ্ঞানহীনতাই কেবল প্রমাণ পাবে।
আশা করছি এই লেখার পর থেকে ‘ফ্যাসিস্ট’ এবং ‘লালবদর’ বিষয়ে সবার অনেক দ্বিধা দূর হবে এবং অন্ধ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, যুক্তির আলোকে এই শব্দগুলোর ব্যবহার করবেন। এপ্রিল ১, ২০২৫, ড. শামীম আহমেদ, ওন্টারিও, কানাডা