যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পাল্টা শুল্কারোপের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে তৈরি হয়েছে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গত ২রা এপ্রিল দেওয়া ঘোষণার পরপরই বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিকারকদের চলমান ক্রয়াদেশ স্থগিত এবং কিছু ক্ষেত্রে বাতিল করার ঘটনা ঘটেছে।
ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টায় ঘোষণা আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মার্কিন ক্রেতারা বাংলাদেশি সরবরাহকারীদের কাছে ই-মেইল পাঠিয়ে নতুন উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রাখতে অনুরোধ জানান।
এসব বার্তায় বলা হয়, নতুন শুল্কের প্রভাব মূল্যায়ন করা হচ্ছে; পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নতুন উৎপাদন না শুরু করার অনুরোধ জানানো হয়।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। দুই দেশের মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০.৫ বিলিয়ন ডলারে, যার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি ৮ বিলিয়নের বেশি এবং তার ৮৭ শতাংশই তৈরি পোশাক পণ্য।
বিশ্বখ্যাত মার্কিন খুচরা বিক্রেতা ওয়ালমার্ট ও গ্যাপ ইতিমধ্যে কিছু কারখানাকে জানিয়ে দিয়েছে, তাদের সরবরাহকৃত পণ্যে বাড়তি শুল্ক ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে এবং সেই খরচ উৎপাদকদেরই বহন করতে হতে পারে। ক্রেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় অনেক পোশাক প্রস্তুতকারক এই প্রসঙ্গে মুখ খুলতে চাইছেন না।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ড. রুবানা হক জানান, “কোনো কোনো ক্রেতা উৎপাদন স্থগিত রাখতে বলেছে, আবার কেউ কেউ ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে। এমনকি শুল্কজনিত কারণে কিছু ব্র্যান্ড মূল্য ট্যাগ পরিবর্তনের জন্য শিপমেন্ট পিছিয়ে দিতে বলছে।”
বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, “যে কনসাইনমেন্টগুলো এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পথে রয়েছে কিংবা আলোচনা পর্যায়ে আছে, সেগুলো নিয়ে উদ্বেগ সবচেয়ে বেশি। অনেক ক্রেতা ডিসকাউন্ট দাবি করতে পারেন বা দাম কমাতে চাপ দিতে পারেন।”
যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেলস (OTEXA)-এর তথ্যমতে, ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে ৭.২৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক আমদানি করেছে, যা ২০২৪ সালে বেড়ে ৭.৩৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসেই আমদানি হয়েছে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬.৬৪ শতাংশ বেশি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ সাধারণত মৌলিক ও কম মূল্যের পোশাক রপ্তানি করে। এসব পণ্য অত্যন্ত মূল্য সংবেদনশীল হওয়ায় দাম বাড়লে বিক্রিতে প্রভাব পড়বে, যা আমেরিকান ক্রেতাদের জন্যও ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে এতে প্রতিযোগিতা আরও বেড়ে যাবে, আর সেই চাপ গিয়ে পড়বে সরাসরি প্রস্তুতকারকদের ওপর।
পোশাক ছাড়াও অন্য পণ্য ঝুঁকিতে
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) জানায়, পোশাক ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ থেকে যেসব পণ্য রপ্তানি হয় তার মধ্যে রয়েছে হেডগিয়ার, জুতা, চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ, মাছ, আসবাবপত্র ও পালকের তৈরি পণ্য। ফলে এই শুল্ক কাঠামোর প্রভাব বিস্তৃত হতে পারে অন্য খাতেও।
ভবিষ্যৎ কী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কিন ক্রেতারা যদি বাড়তি শুল্কের বোঝা সরাসরি উৎপাদকদের ওপর চাপিয়ে দেয়, তবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের শিল্প খাত। শুল্ক কার্যকর হওয়ায় কনসাইনমেন্ট স্থগিত, মূল্য পুনর্মূল্যায়ন এবং চুক্তি বাতিল—সব কিছু মিলিয়ে পোশাক শিল্প এখন চরম এক অনিশ্চয়তার মুখে।
সরকার, রপ্তানিকারক এবং খাতসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর এখন সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণ কঠিন বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।