।। আফজাল হোসেন।।
দূর্বল সবলের পার্থক্য থাকতে হয়। মন্দ ভালো, জ্ঞানী ও অজ্ঞান একাকার হয়ে গেলে জগতবাস গৌরবের, উত্তেজনাপূর্ণ ও আনন্দমুখর থাকে না।
অফিসের কাজে কর্মে দূর্বল মানুষেরা নিজেদের যোগ্যতার ঘাটতি বিষয়ে ভালো করেই অবগত। অবগত বলে কি এরা নিজেদের গড়ে নিতে চায়? চায় না কারণ- অন্য আর একদিকে তারা নিজেদেরকে বেশ শক্তিশালী ভাবে।
তারা ছোটবেলা থেকেই দেখেছে, জানে- মাঠে দুই প্রকারের খেলোয়াড় থাকে। মেরে খেলে কেউ কেউ এবং অনেকে খেলে থাকে যোগ্যতা, বিশেষত্ব দিয়ে। যাদের ভালো খেলার যোগ্যতা থাকে, তাদের ভালো খেলোয়াড়দের সাথে খেলা নিয়ে মাথাব্যাথা থাকে না। সবাই ডরায়- মেরে খেলে যারা, তাদেরকে। কারণ মন্দ মানেই বিপদজনক।
প্রানী পশু পাখিদের নিয়ে একটা তথ্যচিত্র দেখে জেনেছি- জগত শুধু শক্তিমান প্রানীদের রাজত্ব করবার জায়গা নয়, দূর্বলদেরও টিকে থাকার শক্তি বা বিশেষত্ব আছে। সেখানে দেখেছি, ঈগল বড় পাখি। তার ডানায় প্রবল শক্তি থাকা সত্বেও দূর্বল ঘুঘু, কবুতর জাতীয় পাখিদের তারা তাড়া করে সবসময় ধরতে পারে না। পারে না তার কারণ- ঘুঘু, কবুতরেরা উড়তে উড়তে হঠাৎ ডানা গুটিয়ে টুপ করে নিচের দিকে নেমে যেতে পারে। ঈগল মহাশক্তিমান কিন্তু হঠাৎ বিশাল ডানা গুটিয়ে ফেলে নিচে নেমে পড়ার সাধ্য তাদের দেয়া হয়নি।
চিতা অত্যন্ত দ্রুতবেগে দৌঁড়াতে পারে। হরিনদের গতি তাদের তুলনায় সামান্য কম, কিন্তু চিতা অধিকাংশ সময়ে হরিনকে তাড়িয়ে ধরতে পারে না। না পারার কারণ, হরিনদের দেয়া হয়েছে একটা বিশেষ সাধ্য। হরিন দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হঠাৎ করে বাঁক নিয়ে একই গতিতে দিক পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। দ্রুত গতির চিতার সে সাধ্য নেই। তার থামতে গেলে সময় লাগে, দিক পরিবর্তন করে দৌঁড়াতেও সময় লাগে- অতএব বেশীরভাগ সময়ে তাকে তাকিয়ে দেখতে হয়, শিকার ফসকে গেছে।
জগতে প্রানীর টিকে থাকা আর মানুষের টিকে থাকার পদ্ধতি একরকমের হওয়ার কথা নয়। বলা হয়ে থাকে, মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। তাদের সকল বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্বদান করা হয়েছে। শুধু দু একটি উপায় বা শক্তির উপর ভরসা করে মানুষদের বাঁচতে বা টিকতে হয় না।
তাদের জন্য জগতে রয়েছে অসংখ্য উপায়। উপার্জন করা, খাওয়া পরার জন্য, অর্জন করা বা টিকে থাকার জন্য নিজেরা বহু উপায় বের করে নিতে পারে তারা। এখানেই শ্রেষ্ঠত্ব, এটাই বিশেষত্ব মানুষের।
বিশেষত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে মানুষ কতটুকু সচেতন? যে মন্দ- সে জানে, মন্দ হওয়া অযোগ্যতা নয়। মনুষ্যসমাজে মন্দকান্ড করে বাহবা পাওয়া যায়।
অফিসের কর্তাব্যক্তিরা জ্ঞানে বুদ্ধিতে বিশেষ বলেই তারা কর্তার আসনে আসীন কিন্তু চাঁদের কলঙ্কের মতো তাদেরও দূর্বলতা থাকে। তারা প্রশংসা, তোষামোদ পছন্দ করে এবং কানকথাও বিশ্বাস করে খুব। অযোগ্যদের জোর সেখানেই।
তারা উঠতে বসতে স্যারদের সামনে হাত কচলাতে পারে, হে হে হেসে জনাবদের ভূয়সী প্রশংসা এবং যখন খুশী তখন দিলখুলে যে কারও নিন্দা করতে দারুণভাবে সক্ষম।
বহু কর্তাদের পছন্দ দূর্বলচিত্তের মানুষ। কারণ, তাদেরকে হুকুমের দাস ভাবা যায়। এটা কি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠদের গুন? স্বার্থে মিললে মানুষ ভালো খারাপের মধ্যে খারাপকেই বেছে নেয়। তা কি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠের উদাহরণ?
মানুষ নিঃস্বার্থ নয় বলে দোষকেও গুন বলে ভেবে বসতে পারে- করেও। দোষীর প্রশংসায় গলে গিয়ে প্রকৃত গুনীর সাথে অবিবেচকের মতো আচরণও করতে পারে। কোনটাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব নয়।
ভুল মানুষকে স্বার্থের চক্করে বিশেষ বানানোর স্বভাব, সংস্কৃতি শুধু অফিস পাড়াতে রয়েছে, তা নয়। সমাজ, সংসারের পরতে পরতে রয়েছে। রাজনীতিও এই মন্দসংস্কৃতি থেকে মুক্ত নয়।
আমরা দেখি, ঠিকদের কাছ থেকে মই কেড়ে নেয়া হয় আর অযোগ্য, ভুল মানুষদের দিকে সে মই পুরষ্কার হিসাবে বাড়িয়ে দেয়া হয়- ওঠো হে, উপরে ওঠো। এইরকম উদ্ভট কান্ড কীর্তি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠরা নির্দ্বিধায় নিত্যই করে এবং করে নিজেদেরকে বাহাদূর ভাবে।
প্রানী পশু ও পাখিরা পৃথিবীকে নিয়মের পৃথিবী বলে জানে। মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বানানো হয়েছে- তারা খুবই উল্টো। প্রতি পদে, ভাবনায়, কর্মকান্ডে এ পৃথিবীকে বানাতে চায়, অনিয়মের পৃথিবী।
কাক কাকের মাংস খায় না। মানুষ সর্বগ্রাসী- দরকার পড়লে নিজের বা পরের মাংস শুধু নয়, মানুষের বিশ্বাস, ধর্ম, সংস্কৃতি- সবই সানন্দে চিবিয়ে খেতে পারে।
লেখক: অভিনয় শিল্পী।