।। কবির য়াহমদ ।।
দেশে সংবিধান সক্রিয় রয়েছে। তবে সাংবিধানিক পদ ও সংস্থাগুলো অনেকটাই অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী সংবিধান অবমাননা এবং লঙ্ঘনের শাস্তিও নির্ধারিত; সর্বোচ্চ শাস্তি।
সংবিধানের ৭ক অনুচ্ছেদের বলা আছে, ‘‘(১) কোন ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায়- (ক) এই সংবিধান বা ইহার কোন অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে ; কিংবা (খ) এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে- তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে। (২) কোন ব্যক্তি (১) দফায় বর্ণিত- (ক) কোন কার্য করিতে সহযোগিতা বা উস্কানি প্রদান করিলে; কিংবা (খ) কার্য অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করিলে- তাহার এইরূপ কার্যও একই অপরাধ হইবে। (৩) এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে।’’
আমাদের যে সংবিধান তাতে রয়েছে ৯টি সাংবিধানিক পদ ও ৭টি সাংবিধানিক সংস্থা। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো হলো নির্বাহী বিভাগ বা শাসন বিভাগ; আইন বিভাগ; বিচার বিভাগ; নির্বাচন কমিশন; সরকারি কর্ম কমিশন; অ্যার্টনি জেনারেলের কার্যালয়; এবং মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়। আর সাংবিধানিক পদগুলো হলো রাষ্ট্রপতি; প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং উপমন্ত্রী; স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার; সংসদ সদস্যগণ; প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারপতি; অ্যাটর্নি জেনারেল; প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার; সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান; মহাহিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক।
৫ই আগস্টের পর বাংলাদেশের সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। তছনছ হয়ে গেছে সাংবিধানিক পদ ও প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা। কেবল ক্ষমতার কেন্দ্রেই পরিবর্তন আসেনি, জোরপূর্বক বিতাড়িত করা হয়েছে অন্তত ৮টি সাংবিধানিক পদে থাকা ব্যক্তিদের। এখানে ব্যতিক্রম কেবল দেশের প্রথম ব্যক্তি মহামান্য রাষ্ট্রপতি।
রাষ্ট্রপতি সংবিধান অনুযায়ী দেশের শীর্ষ ব্যক্তি। কিন্তু তাকে প্রায় নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। রীতি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী/প্রধান উপদেষ্টা যেকোনো বিদেশ সফরে গেলে সফর সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করতে হয়। এটা অখণ্ডনীয় নিয়ম। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা রাষ্ট্রীয় সেই নিয়ম-রীতিনীতি অবজ্ঞা করে চলেছেন। তিনি কোন সফর শেষে রাষ্ট্রপতিকে সে সম্পর্কে অবহিত করতে দেখা যায়নি।
এখানে অবশ্য প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস একটা বিষয়ে পার পেয়ে যেতে পারেন, কারণ ক্ষমতা গ্রহণের আট মাসেও তিনি বৈশ্বিক বিভিন্ন এনজিও দাওয়াতে বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন সত্য, কিন্তু এর একটাও দ্বিপাক্ষিক সরকারি সফর ছিল না। অনেক আলোচনার চীন সফর ও ব্যাংককে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎও তার রাষ্ট্রীয় সফরের অংশ ছিল না।
মুহাম্মদ ইউনূস যখন আরও অনেক দিন ক্ষমতায় থাকছেন, এবং ভবিষ্যতে কোন সময় কোন দেশে দ্বিপাক্ষিক সরকারি সফর অনুষ্ঠিত হলে তিনি এরপর রাষ্ট্রীয় নিয়ম, রীতিনীতি মানেন কিনা সেটা প্রমাণ হবে।
দেশে বর্তমানে যত সাংবিধানিক পদ রয়েছে তন্মধ্যে কেবল বৈধভাবে আগের পদে বহাল রয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। তিনি এমন এক জায়গায় রয়েছেন যেখানে তিনি স্বেচ্ছায় অথবা বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করতে চাইলেও তার পদত্যাগপত্র গ্রহণের মতো সাংবিধানিক পদ ও প্রতিষ্ঠান শূন্য রয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করতে হলে সেটা করতে হয় স্পিকারের নিকট। কিন্তু জাতীয় সংসদের স্পিকারকেও পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। যদিও পরবর্তীতে স্পিকারের কার্যালয়ের দায়িত্ব আইন উপদেষ্টা নিয়েছেন, তবে এই দায়িত্বগ্রহণে সাংবিধানিক পন্থা অনুসরণের সুযোগ ছিল না।
সাংবিধানিক পদে একমাত্র বৈধভাবে থাকা রাষ্ট্রপতিকে বর্তমানে একেবারের নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। আমি রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ের ওয়েবসাইট খুঁজে দেখেছি, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন দিবসেও রাষ্ট্রপতির কোন বাণী প্রকাশিত হয় না। অথচ এটা আগে ছিল নিয়মিত ঘটনা। শোনা যায়, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ নাকি একবার বলেছিলেন, ‘মিলাদ ও কবর জিয়ারত ছাড়া তার কোনও কাজ নেই।’ রাষ্ট্রপরিচালনায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাহীন ভূমিকা নিয়ে খেদ থেকে হয়ত তিনি কথাটি বলতে পারেন। তার পরেও সরকারে এক দল আর রাষ্ট্রপতি পদে অন্য দলের মনোনীত ব্যক্তি থাকার সময়েও রাষ্ট্রপতিকে বর্তমানে যেভাবে চলছে সেভাবে অবমূল্যায়ন করতে আমরা অন্তত দেখিনি।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, সাংবিধানিক পদে থাকা ব্যক্তিদের পদত্যাগে বাধ্য করতে যে সকল ঘটনা ঘটেছে গত বছরের আগস্ট পরবর্তী সময়ে, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের পদত্যাগ। গণমাধ্যম সূত্রে আমরা জেনেছিলাম, পদত্যাগপত্রে তিনি লিখেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট বিল্ডিং এবং এর রেকর্ডসমূহ রক্ষা, কোর্ট প্রাঙ্গণ রক্ষা, বিচারপতিদের বাড়িঘর, জাজেজ টাওয়ার রক্ষা, বিচারপতিদের শারীরিক হেনস্তা থেকে রক্ষা করা এবং জেলা জজ কোর্টগুলো, রেকর্ড রুমসমূহ রক্ষার স্বার্থে আমাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হলো।’ এটা যদি সত্যি লিখিত থাকে, তবে ইতিহাসে জোরপূর্বক পদত্যাগ লিপিবদ্ধ হয়ে গেল। এবং এটা সংবিধানের ৭ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রচলিত আইনের সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার মতো অপরাধ কিনা সেটা সময়ই বলে দেবে।
বর্তমানে যারা ক্ষমতাসীন তারা সংবিধানের অধীনে এবং সংবিধান রক্ষার শপথ নিলেও তারা সংবিধানকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে। আট মাসেও এটা তারা করতে পারেনি। এবং পারবে বলেও মনে হচ্ছে না। যে মব সৃষ্টি করে তারা বিভিন্ন সাংবিধানিক পদ ও প্রতিষ্ঠানকে তছনছ করেছে, সে মবের শক্তিও এখন নিঃশেষের পথে। ধারণা করা হচ্ছে, তারা সংবিধান নিয়ে তেমন কিছু করতে পারবে না। আর সংস্কারের নামে কিছু করলে ভবিষ্যতে একইভাবে তাদের সংবিধান অবমাননার দায় তাদের নিতে হবে।
বর্তমানে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্রিয়াশীল দেশে, তার বিভিন্ন সংস্কার উদ্যোগের একটা কমিশনের প্রধান হচ্ছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। এই সরকারের আমলে তিনি নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১১ সালের ২৬ আগস্ট দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ‘সংবিধান না মানাও সংবিধানের প্রতি অবমাননা’ শিরোনামের একটা লেখায় তিনি লিখেছিলেন: ‘সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পাসের পর বেগম খালেদা জিয়া সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। এটি রাজনৈতিক বক্তব্য হলেও নিন্দনীয়। এর মাধ্যমে সংবিধানকে, যা দেশের সর্বোচ্চ আইন, অবমাননা করা হয়েছে।’ বর্তমানে তিনি সরকারের অংশ হয়ে যাওয়ায় সংবিধান ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াসহ বিবিধ অবমাননা নিয়ে প্রকাশ্যে ঘোষণা ও হুমকি সত্ত্বেও তিনি এ-সম্পর্কে কিছু বলছেন না।
বদিউল আলম মজুমদার না হয় সরকারের অংশ হিসেবে চুপটি মেরে বসে আছেন, কিন্তু ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ কি এভাবে চুপ করে বসে থাকবে?
দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় ধরে প্রবল প্রতিপত্তি নিয়ে দেশ শাসন করা আওয়ামী লীগের ৫ই আগস্টের আগে-পরের পরিস্থিতি ও অবস্থান কি এক? ঘণ্টার ব্যবধানে দীর্ঘদিনের প্রতিপত্তি ও সারাদেশে কোটি-কোটি দলীয় ভোটারের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ যদি বর্তমানে মাঠে না দাঁড়াতে পারে, তবে বর্তমানে যারা ক্ষমতাসীন তারা তো আওয়ামী লীগের তুলনায় ক্ষুদ্র কণাবিশেষ। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কি খুব বেশি আশাবাদী হতে পারেন কেউ? ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলেন আর প্যারাসাইকোলজি বলেন, আমি মোটেও আশাবাদী হতে পারছি না!