ঢাকা, ১০ এপ্রিল: ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে মুজিবনগর সরকারের গঠন ঘটে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করার পরে পাকিস্থানি স্বৈরাশকরা ক্ষমতা অর্পন না করার ফলে সৃষ্ট সায়ত্ত্বশাসনের আন্দোলোন ৭ই মার্চ ১৯৭১ এর পরে স্বাধিকার আন্দোলনে রুপলাভ করে। এই অস্থায়ী সরকারটি পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে স্বীকৃতি এবং সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য গঠিত হয়েছিল।
গঠনের প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োজন:
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করার পর, বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র লড়াইয়ে নামে। বঙ্গবন্ধু রেডিও বার্তায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দদের নির্দেশ দেন নিরাপদ স্থানে গিয়ে সংগঠিত হওয়ার। তখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে একটি সংগঠিত প্রতিরোধ গঠন করতে বাধ্য হন।
তবে, স্বাধীনতা ঘোষণা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন লাভের জন্য একটি আনুষ্ঠানিক সরকারের প্রয়োজন ছিল। এই প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য ১০ই এপ্রিল, ১৯৭১-এ বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা মেঘালয়ের বাইরে একটি গোপন স্থানে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। এই সরকারের নামকরণ করা হয় “বাংলাদেশের জনগণের সরকার” (Government of the People’s Republic of Bangladesh)। ১৭ই এপ্রিল এই সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমান মুজিবনগর) শপথ গ্রহণ করেন, যারা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ভোটে জয়লাভ করেছিল।
মুজিবনগর সরকারের গঠনের প্রধান প্রাসঙ্গিকতা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে আন্তর্জাতিকভাবে বৈধতা দেওয়া। এটি পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে একটি কানূনী এবং রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে কাজ করেছিল, যা বিশ্বের সম্মুখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করেছিল। এছাড়া, এই সরকার মুক্তিযুদ্ধের সামরিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রমগুলো সামঞ্জস্য করতে এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য ও স্বীকৃতি লাভ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
মুজিবনগর সরকারের প্রধান নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি তখন পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি ছিলেন। তবে, তাঁর অনুপস্থিতিতে তাকেই রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে সরকারের দায়িত্ব পালন করেন তাজউদ্দিন আহমদ, যিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম (উপ রাষ্ট্রপতি), ক্যাপ্টেন মনসুর আলী (অর্থ ও বাণিজ্য), মোহাম্মদ কামরুজ্জামান (স্বরাষ্ট্র)। ১১ এপ্রিল এম এ জি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে মন্ত্রিপরিষদ গঠনের ঘোষণা দিয়ে ভাষণ প্রদান করেন।
মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রম ও সিদ্ধান্ত:
স্বাধীনতা ঘোষণা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছে স্বীকৃতি চেয়েছিল। ইন্ডিয়া প্রথম দেশ হিসেবে এই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়, যা পরবর্তীকালে অন্যান্য দেশেরও সমর্থন আকর্ষণ করে।
মুক্তিবাহিনীর সংগঠন: সরকার মুক্তিবাহিনীকে সংগঠিত করতে এবং তাদের সামরিক কার্যকলাপ পরিচালনা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি সশস্ত্র লড়াইয়ের জন্য অর্থ, অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে।
শরণার্থী সমস্যা সমাধান: পাকিস্তানি আক্রমণের ফলে লক্ষ লক্ষ বাঙালি ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। মুজিবনগর সরকার এই শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য আকর্ষণ করে এবং তাদের পুনর্বাসনের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
রাষ্ট্রীয় প্রশাসন গঠন: যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতেও সরকার দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু রাখার চেষ্টা করে। এটি মুক্ত এলাকায় ন্যায়বিচার, শিক্ষা, ও স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের জন্য উদ্যোগ নেয়।
আন্তর্জাতিক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক: সরকার বিশেষ করে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সমঝোতা ও বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক স্থাপন করে, যা মুক্তিযুদ্ধের সফলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি অবিস্মরণীয় অধ্যায়। এটি না কেবল স্বাধীনতা সংগ্রামকে সংগঠিত করেছিল, বরং বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে স্থাপন করেছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে, যা মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্তের ফলাফল ছিল। এই ঐতিহাসিক ঘটনা আজও বাঙালি জাতির গৌরব এবং সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।