গত ১৫ মাসে বাংলাদেশ ভারতের সড়কপথ ব্যবহার করে বিশ্বের ৩৬টি দেশে প্রায় ৫ হাজার ৬৪০ কোটি টাকার তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে ভারতের ভূখণ্ড অতিক্রম করে এসব পণ্য বিদেশে পাঠানো হয়। ডলারে রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ৪৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। গড়ে প্রতি মাসে বাংলাদেশ ৩৬টি দেশে ৩৭৬ কোটি টাকার পোশাক রপ্তানি করেছে।
ব্যবসায়ীদের মতে, এসব পণ্য ট্রাকযোগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে কলকাতার দমদম বিমানবন্দর বা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পাঠানো হতো। কিন্তু সম্প্রতি ভারতের ইউনুস সরকারের আগ্রাসী আচরণ ও ‘সেভেন সিস্টার’ অঞ্চল নিয়ে হুমকির কারণে ভারত এই ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে। এতে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় তৈরি পোশাক রপ্তানি কার্যক্রম অনিশ্চয়তায় পড়েছে।
শিল্প উদ্যোক্তারা জানান, কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহারে ঢাকার চেয়ে প্রতি কেজি পণ্যে ৫০ সেন্ট থেকে ১ ডলার পর্যন্ত খরচ কম হতো। পাশাপাশি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বুকিং জটও এড়ানো যেত। এখন ভারত এই সুবিধা বন্ধ করায় রপ্তানিতে সময় ও ব্যয় দুই-ই বেড়ে যাবে, যা সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার আওতায় প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৪০-৫০ হাজার টন তৈরি পোশাক দিল্লি ও কলকাতা হয়ে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো। রপ্তানিকৃত পণ্যের মধ্যে ছিল নারীদের ব্লাউজ, ব্রিফস, প্যান্টি, স্কার্ট, কোট, প্যান্ট, জামা-কাপড় ছাড়াও কটন, টেক্সটাইল, স্যানিটারি ফাইবার থেকে তৈরি বিভিন্ন ধরনের পোশাক। পুরুষ, নারী ও শিশুর জন্য বিভিন্ন ধরনের তৈরি পোশাকও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এই ট্রান্সশিপমেন্ট ব্যবহারে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানি হতো—সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, চিলি, চীন, কলম্বিয়া, জার্মানি, ডেনমার্ক, স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইতালি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, নেপাল, ফিলিপাইন, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া, রাশিয়া, সুইডেন, তাইওয়ান, যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ আফ্রিকা সহ আরও অনেক দেশে।
২০২০ সালের ২৯ জুন ‘ব্যবসা সহজীকরণ’ নীতির আওতায় ভারত থেকে এই ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা নেয় বাংলাদেশ। এ সুবিধার আওতায় পণ্য বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতের ভূখণ্ড অতিক্রম করে তৃতীয় দেশে যেত। কিন্তু ভারত এই সুবিধা বাতিল করার দিনই বেনাপোলে তৈরি পোশাক খাতের তিনটি প্রতিষ্ঠানের চারটি ট্রাকভর্তি পণ্য আটকে যায়। এই পণ্যগুলোর গন্তব্য ছিল স্পেন। পেট্রাপোল কাস্টমস সেগুলোর প্রবেশাধিকার না দেওয়ায় ট্রাকগুলো বাংলাদেশে ফিরে আসে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রায় ৩৪ হাজার ৯০৯ মেট্রিক টন পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যার বাজারমূল্য ৫ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা এবং ডলারে ৪৬২ মিলিয়ন।
বেনাপোল কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৬২৪টি প্রতিষ্ঠান এই সুবিধা ব্যবহার করে প্রায় ৯৮ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বেনাপোল কাস্টমসের তথ্য অনুসারে, শুধু গত বছরই কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশ ৪৪ হাজার টন পণ্য রপ্তানি করেছে। এখন এই সম্পূর্ণ চাপ এসে পড়বে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ওপর। বিশ্লেষকদের মতে, এর জন্য অতিরিক্ত প্রায় ৭৩০টি ফ্লাইট প্রয়োজন হবে, যা ইউরোপ-আমেরিকা রুটে পরিবহন খরচ ও জট দুই-ই বাড়িয়ে দেবে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, স্পেন ছিল সবচেয়ে বড় চালানপ্রাপক দেশ। কলকাতা বিমানবন্দর হয়ে স্পেনে সবচেয়ে বেশি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। ভারতের এই সিদ্ধান্তের আগের সোমবারও ১১টি চালান কলকাতায় পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু বুধবার থেকে রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এক বড় পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছে। ভারত হয়ে রপ্তানির বিকল্প কার্যকর পথ না থাকলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা কঠিন হয়ে পড়বে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “ভারতের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এই সুবিধা পুনর্বহাল করার প্রচেষ্টা চালানো উচিত।”
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, “ভারতের এই সিদ্ধান্ত দুঃখজনক। এই পথটি ছিল আমাদের জন্য একটি সাশ্রয়ী ও কার্যকর বিকল্প। এখন তা বন্ধ হওয়ায় রপ্তানিতে বিলম্ব এবং খরচ—দুটোই বাড়বে।”