ফেসবুকে দেখছি, নতুন ললিপপ ঘুরছে—‘এপ্রিলের ৯-১০ তারিখ সারা দুনিয়া আমাদেরকে চিনবে অন্যভাবে। সমীহ করা শুরু করবে।’ এই শিরোনামে। কপি-পেস্ট করা লেখায় নিজের মতো করে ছবি জুড়ে পোস্ট হচ্ছে, শেয়ার চলছে।
লেখাটার মূল পয়েন্টগুলো হলো:
• প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৫০ দেশের ২৩০০ ইনভেস্টর আসবে ইন্টারকন্টিনেন্টালে।
• এটা বাংলাদেশ কেন, আশপাশের দেশও কখনো ভাবেনি বা করতে পারেনি।
• ইলন মাস্ক থেকে বিল গেটসও আসবে বা আসার সম্ভাবনা আছে।
• ইলন মাস্কের স্টারলিঙ্ক ইভেন্ট লাইভ ব্রডকাস্ট করবে।
• ইতিমধ্যে সব দেশের বড় বড় জায়ান্ট ইনভেস্টর দেশে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখাচ্ছে।
লেখাটা পড়ে আমি আবেগে আপ্লুত! কিন্তু গত আড়াই দশক ধরে এই ধরনের ইনভেস্টমেন্ট সামিট বা বিজনেস সামিট তো আর কম দেখলাম না। তাই খেয়ালে খিচুড়ি না পাকিয়ে ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখি, এপ্রিলের ৯-১০ তারিখে কী হতে যাচ্ছে। আর দাবিগুলো কতটা সত্য বা যৌক্তিক!
প্রথম দাবি — আংশিক সত্য
এপ্রিলের ৯-১০ নয়, ৭ থেকে ১০ এপ্রিল ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আয়োজিত ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫’। বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বাংলাদেশে এ ধরনের সামিট একেবারে নতুন নয়। শুধু ঢাকায় নয়, দুবাই, লন্ডনেও এ ধরনের প্রোগ্রাম আয়োজন করা হয়েছে বিগত সময়ে। পার্থক্য হলো, এবার বিদেশি বিনিয়োগকারী নয়, এই অনুষ্ঠানের টার্গেট গ্রুপ দেশি ফেসবুক জনতা। আর বিনিয়োগ নয়, টার্গেট লাইক, শেয়ার, কমেন্ট।
দ্বিতীয় দাবি — অতিরঞ্জিত
ভারতের রাজ্যপর্যায়ের এ ধরনের অনুষ্ঠানে এর চেয়ে বেশি রেজিস্ট্রেশন হয়। ভারত বড় দেশ—হতেই পারে। গত ২০২৪ সালের এপ্রিলে ল্যান্ডলক নেপালের তৃতীয় নেপাল ইনভেস্টমেন্ট সামিটে ৫৫টি দেশের বিনিয়োগকারী অংশগ্রহণ করেছিলেন (বাংলাদেশ থেকে ১৩ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন)। আর বঙ্গোপসাগরের ‘একমাত্র অভিভাবক’ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সামিটে আসছে ৫০টি দেশ!
তৃতীয় দাবি — ভিত্তিহীন
ইলন মাস্ক বা বিল গেটসের এই সম্মেলনে উপস্থিত থাকার বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। বিডা চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন ইতিমধ্যে বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। এখন কথা হলো, ইলন মাস্ক-বিল গেটস এলে আমাদের কী লাভ? ইলন মাস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক সম্পর্ক নতুন নয়। স্পেসএক্স-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রথম যোগাযোগ স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে ২০১৮ সালে। মাস্কের বর্তমান আগ্রহের বিষয় স্টারলিঙ্ক (স্যাটেলাইট ইন্টারনেট) আর টেসলার ব্যবসা (ইলেকট্রিক গাড়ি—EV)। বাংলাদেশের অটোমোবাইল মার্কেট জাপানি আর ভারতীয় কোম্পানিগুলো দখল করে আছে। এমনকি চাইনিজ গাড়িগুলোও এখনো দাঁত বসাতে পারেনি। স্পেয়ার পার্টসের কথা বাদ দিলাম, চার্জিং স্টেশন ছাড়া টেসলার ট্রাকগুলো চলবে কীভাবে? লোকে কি পার্কিং সাজিয়ে রাখার জন্য কিনবে? স্টারলিঙ্ক যে পরিমাণে ব্যয়বহুল, কতজন ব্যবহার করতে পারবে, এ নিয়ে সংশয় আছে। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ওয়্যারলেস ব্রডব্যান্ড সেবা ওয়াইম্যাক্স (WiMAX)র কথা? সরকারি বড়বাবু আর বেসরকারি ছোট মহাজন পর্যায় থেকে কী পরিমাণে আওয়াজ তৈরি করা হয়েছিল! দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত নয়, ওয়াইম্যাক্সে কই থেকে কই চলে গেছে! এখনো অনেকের ড্রয়ারের কোণায় ডংল বা মডেম পাওয়া যাবে।
এবার আসি মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের বিষয়ে। বাংলাদেশে সরাসরি কোনো ব্যবসায়িক বিনিয়োগের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ও প্রকাশ্য তথ্য তেমন পাওয়া যায় না, বিশেষ করে তার ব্যক্তিগত বিনিয়োগ ফার্ম ক্যাসকেড ইনভেস্টমেন্টের মাধ্যমে। তবে, বিল গেটস ও তার প্রাক্তন স্ত্রী মেলিন্ডা গেটসের প্রতিষ্ঠিত বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক ও জনকল্যাণমূলক প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। এই বিনিয়োগগুলো মূলত দাতব্য উদ্দেশ্যে, ব্যবসায়িক লাভের জন্য নয়। বিল গেটস ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচিতে সহায়তা প্রদান করেছে। ২০১৯ সালে বিল গেটস বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতে টাইফয়েড ও কলেরার মতো রোগের বিরুদ্ধে নতুন ধরনের ভ্যাকসিন সরবরাহে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এছাড়া, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের টিকাদানের জন্যও সহায়তা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রে (ICDDR,B) অর্থায়ন করেছে। ২০০১ সালে গেটস অ্যাওয়ার্ড ফর গ্লোবাল হেলথ প্রদান করেছে। এমনকি ২০০৫ সালে ঢাকায় এই প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেছিলেন। গেটস ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডার বিকাশে (bKash) বিনিয়োগ করেছে। এটি একটি ইক্যুইটি বিনিয়োগ, যার উদ্দেশ্য ছিল নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য আর্থিক সেবার প্রসার ঘটানো। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে বিল গেটসের সম্পর্ক কয়েক দশকের। দুইবার এ দেশে ঘুরে গেছেন—এত বছরেও তার ক্যাসকেড এ দেশে বিনিয়োগ করেনি। শুধু গেটস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে দাতব্য কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে।
চতুর্থ দাবি — হাস্যকর
স্টারলিংক ইভেন্ট লাইভ ব্রডকাস্ট করবে — এই দাবিটি এমনভাবে উপস্থাপন করা যেন এটিই সবচেয়ে বড় অর্জন! সোশ্যাল মিডিয়ার লাইভ ভিডিও আমাদের জাতির জন্য গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে?
হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না। আবেগী বাংলাদেশিদের এত সহজে বোকা বানানো সম্ভব! স্টারলিঙ্ক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা। এটা ব্যবহার করে সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভ সম্প্রচার করা হবে। ফেসবুকে লাইভ জানা জাতির কাছে এটা কী বিক্রি করা হচ্ছে?
এদের প্রোপাগান্ডা দেখে নাৎসিদের প্রপাগান্ডামন্ত্রী ও প্রচারণা বিশেষজ্ঞ ড. পল জোসেফ গোয়েবলস নিশ্চয় নরকে লজ্জায় মুখ লুকায়।
পঞ্চম দাবি — বাস্তববিবর্জিত
বিশ্বের বড় বড় ইনভেস্টররা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী — কথাটা শোনায় ভালো, কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম।
আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনের সাফল্য শুধু ইভেন্ট আয়োজনের ওপর নয়, দেশের সার্বিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নীতিনির্ধারণী পরিবেশের ওপর নির্ভর করে। জনসংখ্যা ও ভৌগলিক কারণে বাংলাদেশ বরাবরই বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয়। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা এসব ভেস্তে দেয়। গত দেড় দশকে বাংলাদেশ স্থিতিশীল পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। লং টার্ম ফাইন্যান্সিং বা স্ট্র্যাটেজিক ইনভেস্টমেন্ট আসছিল। কিন্তু জুলাই-আগস্টের ষড়যন্ত্র দেশকে অনেকটা উল্টো পথে নিয়ে গেছে। কমনসেন্স দিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করুন—অস্থিতিশীল একটা দেশ, যেখানে উগ্রবাদের উত্থান দৃশ্যমান, সেখানে লাভ তো দূরে থাক, আসলটাই ফেরত পাওয়া কি কঠিন নয়?
অদ্ভুত সরকারের আলিফ লায়লার আরেকটা গল্প
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের শক্ত আইনি ভিত্তি নেই। আমাদের দেশের সংবিধানে এ ধরনের অদ্ভুত সরকারব্যবস্থা নেই। সংবিধান স্থগিতও করা হয়নি। এই সরকারের বৈধতা বিবেচনা করতে হচ্ছে ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র ওপর। কোনো ইনভেস্টর আছে, যে সরকারের আইনি ভিত্তি দুর্বল, তাদের সঙ্গে চুক্তি করবে? অনেক দেশের বিনিয়োগ নীতিমালায় উল্লেখ আছে—“অবৈধ বা বিতর্কিত সরকার” কর্তৃক স্বাক্ষরিত বিনিয়োগ চুক্তি “বাধ্যতামূলক নয়”।
বর্তমানে বাংলাদেশে রিজার্ভ সংকট, ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম ও রেমিট্যান্স হ্রাস বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করছে। অনেকে টাকা ঢুকিয়ে আবার রিপ্যাট্রিয়েশন করতে পারবে কি না, সে নিয়েও সন্দিহান। তাহলে?
আলিফ লায়লার গল্প মনে আছে? গর্দান বাঁচাবার জন্য পারস্যের সম্রাট শাহরিয়ারকে তাঁর নববধূ উজিরকন্যা শাহরাজাদ প্রতিদিন একটা গল্প শুনিয়ে এক হাজার এক রাত (মাঝে অবশ্য সন্তান জন্মদানের জন্য কয়েক রাতের বিরতি ছিল) পার করে দিয়ে ছিলেন। ইউনূসশাহী এই ভাবে গল্প শুনিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্ট করছে।
জনগণের টাকায় জনগণকে ভেলকি
একবারের সামিটে এসে বিনিয়োগকারীরা মূলত বাজার পর্যালোচনা করবে। কিন্তু তারা সিদ্ধান্ত নেয় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আইনের শাসনের ভিত্তিতে। সামিটের মাধ্যমে কোনো সরাসরি বিনিয়োগ না এলেও মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়ে যেতে পারে। আসলে জনগণের ট্যাক্সের টাকার অপচয়ের উদাহরণ হয়ে থাকবে এই সম্মেলন। কীভাবে? আসুন, একটা অনুমানিক হিসাব করি:
• সামিট আয়োজন (ভেন্যু, নিরাপত্তা, লজিস্টিক): ২০-৫০ কোটি টাকা (ইন্টারকন্টিনেন্টাল, ভিভিআইপি নিরাপত্তা, ট্রান্সপোর্ট ইত্যাদি)
• বিদেশি অতিথিদের হসপিটালিটি: ১০-৩০ কোটি টাকা (ফ্লাইট, হোটেল, ভ্রমণ, গিফট, ভিসা ইত্যাদি)
• মিডিয়া ও ব্র্যান্ডিং: ৫-১৫ কোটি টাকা (লাইভ ব্রডকাস্ট, প্রমোশন, ডকুমেন্টারি ইত্যাদি)
• সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খরচ: ৫-১০ কোটি টাকা (অতিরিক্ত বোনাস, ভাতা, ট্যুর ইত্যাদি)
সর্বমোট: প্রায় ৫০-১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় হতে পারে, যার ফলাফল শূন্য হওয়ার সম্ভাবনা ১০০%। আর যদি বোকা বাংলাদেশিদের এই ভেলকি দেখিয়ে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে রাখা যায়, তাহলে সফল!
রাজনৈতিক শৃঙ্খলা, আইনের শাসন এবং গণতান্ত্রিক বৈধতা না থাকলে—১০০ দেশের ১০,০০০ ইনভেস্টর এলেও কেউ স্থায়ীভাবে বিনিয়োগ করবে না।
এখন দেখুন! আপনারা যা ভালো মনে করেন।
#ATeam 20250411