টাইটানিক সিনেমার সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি কে? অনেকের নাম তালিকায় উঁকি দিতে পারে। এই তালিকায় সবচেয়ে উপরের দিকে থাকে রোজ। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে, ঠাণ্ডা জলে বরফ হওয়া থেকে যে বেঁচে গিয়েছিল, দীর্ঘ একটা জীবন উপহার পেয়ে। আমি একটা গল্প জানি, যে গল্পে বক্তা জানান- টাইটানিক সিনেমার সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি রোজ নন। তালিকায় থাকা কেউ নন। সৌভাগ্যবান হচ্ছেন ওই ব্যক্তি যিনি টাইটানিক ছাড়ার আগমুহূর্তে জ্যাকের কাছে কার্ড খেলায় হেরে গিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে হেরে যাওয়াই জীবনের সবচেয়ে বড়ো জয়।
মোটিভেশন হিসেবে গল্পটা চমৎকার। কিন্তু অন্দর ফাঁপা। মানুষ অমর হয় না। অমরত্বও তেতো হয়। আমার কাছে তখনও মনে হয়েছিল এবং এখনও মনে হয়, টাইটানিকের সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষটি জ্যাক। যে ক্ষণিক সময়েই চূড়ান্ত ভালোবাসা উপহার পেয়েছিল যেটা আজীবন বেঁচে থেকেও পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ক্ষনিক সময় পেয়েছিল সে রোজকে। ছুঁয়েছে। হেঁটেছে। হেসেছে খিল খিল। ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছে গভীর আবেগে।
টাইটানিক যখন ডুবতে শুরু করে তখন জ্যাক আটকা পড়ে ছিল নিচে কোথাও। হাত বাঁধা ছিল তার। পায়ের কাছে পানি এসে পৌঁছুতে শুরু করেছিল যখন, ওই শূন্য করিডোর শূন্য ঘরের বাইরে একটা মানুষের আওয়াজই শুনতে পেয়েছিল সে। ওটা রোজ। সবাইকে পেছনে ফেলে সদ্য ডুবতে শুরু করা জাহাজে একাই খুঁজতে নেমেছিল এক যুবতী তাকে। যার সঙ্গে তার পরিচয়ের তখনও দু’টো দিন পার হয়নি পুরো।
জ্যাক টাইটানিকের সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষ। কেননা লাইফবোটে করে স্বাচ্ছন্দ্যে বেঁচে যাওয়ার দারুণ সুযোগ পেয়েও এক যুবতী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বোট থেকে জাহাজে, তার জন্য। স্বর্গ থেকে স্বেচ্ছায় নরকে ঝাঁপ দেওয়া যাকে বলে। হাত ধরে একসঙ্গে ছিল টাইটানিক ডোবার পরও, ওই জলে ভাসা কাঠের টুকরার উপরও। এমনকি মৃত্যুর পরও। বরফে শক্ত হয়ে আঙুলের ফাঁকে আঙুল আটকে যাওয়া জ্যাকের হাতে রোজ শেষবারের মতোন চুমু খায়। তারপর ছাড়ে জলের অতলে। শরীরখানা ছাড়ে শুধু, স্মৃতিতে রেখে দেয় আজীবন। তাই কয়েক মিনিট আগে দেখা হওয়া মানুষের চেহারা ভুলে যাওয়া রোজ বয়স একশো পার হওয়ার পরও চোখ বুজে অনায়াসে স্মৃতিচারণ করতে পারেন জ্যাকের। ভেঙে চুর্ণ করা জাহাজের একপাশ গেঁথে পাশ কাটা আইসবার্গ সাক্ষী রেখে খাওয়া এক অনবদ্য চুমুর স্পর্শ পান তখনও। স্পর্শ পান জাহাজের সম্মুখে রক্তাক্ত সূর্য সাক্ষী রেখে পাখির মতোন মেলে রাখা দুই হাতের আঙুল। পাশ কেটে যাওয়া বাতাস। শরীরের গন্ধ।
কার্ড খেলায় হেরে গিয়ে না, আজীবন বেঁচে থেকেও না, শুধু ক্ষনিক মুহূর্ত হাতের আঙুলে আঙুল আটকেও অমর হওয়া যায়। হওয়া যায় পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষ।
কার্ড খেলায় যে হেরেছিল, সে হয়তো বেঁচেছিল দেড়-দুইশো বৎসর। কিংবা ধরা যাক তারও বেশী। পেয়েছিল একটা দীর্ঘ জীবন, অজস্র স্বর্নমুদ্রা, প্রাসাদ, রমণী, ক্ষমতা। তারপরও অতটা সৌভাগ্যবান সে নয়, যতটা জ্যাক। জ্যাক পেয়েছিল তোলপাড় করা অকৃত্রিম প্রেম। পেয়েছিল রোজকে। কোনোরকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই হাসি মুখে যে মেয়েটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল জলে হার্ট অফ দ্য ওশ্যান। কারণ, তার কাছে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান হীরা। বাকিসব তুচ্ছ। ওই হীরাটি খোদ জ্যাক নিজে। পৃথিবীর নিকট ওই জাহাজে জ্যাকের কোনো অস্তিত্ব নেই। নাম নেই কোনো তার। তার অস্তিত্ব একটা হাতে আঁকা ছবি নয়, ধার করে পরা দামী পোশাক নয়, মূল্যবান রত্নও নয় কোনো। বরং একটা গল্প, একটু স্মৃতিচারণ। একশো বৎসরেও যে স্মৃতিতে ধুলো জমেনি একফোঁটা। মানুষ বেঁচে থাকে ওভাবে।
ইকবাল-এর একটা চমৎকার উক্তি আছে। জর্জ এলিয়েটও একই কথা বলেছেন। আবার কোকো নামের একটা অ্যানিমেটেড সিনেমায় যার প্রচণ্ড সুন্দর উপস্থাপন দেখেছি আমি। ওটা হচ্ছে- মানুষ তখনই মরে যায়, যখন তাকে মনে করার কেউ থাকে না আর।