।। হামিদ মোহাম্মদ।।
দেশ ডুবছে! আর নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে লাঠালাঠি দেখে আমার একটি গল্প মনে পড়লো্। গল্পটি সিলেট অঞ্চলে মিথ হিসাবে চালু আছে। গল্পটি এরকম- সিলেট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে বেশ কিছু ‘চৌধুরী’ পরিবার রয়েছেন। সিলেটের চৌধুরী পরিবারগুলো আবার গোলাপগঞ্জের। গোলাপগঞ্জের চৌধুরীরা একবার সুনামগঞ্জে বেড়াতে গেলেন। সময় ছিল বর্ষাকাল।থৈথৈ পানি হাওরাঞ্চলে। নৌকায় ভ্রমণ করছেন তারা। নৌকায় ফুটো দিয়ে পানি উঠতে শুরু করে। এক সময় নৌকা ডুবতে শুরু করে। কিন্তু পানি সেচতে রাজী নয়, কারণ তারা ‘চৌধুরী’, ইজ্জত যায়। কেউ পানি সেচলেন না। এতে যা ঘটার তাই ঘটলো। সকলেরই সলিল সমাধি।সত্যমিথ্যা জানি না,তবে মিথগল্প হিসাবে ধরে নিবেন সিলেটের ভাই-বন্ধুরা। আমার প্রতি ক্ষেপবেন না, অনুরোধ।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা তাই।রাজনৈতিক ঢামাঢোলে কেউ চাইতেছেন নির্বাচন যত দ্রুত হবে তত ভালো। আরেক পক্ষ চাইতেছেন- না, সংস্কার হতে হবে প্রথম, তারপর নির্বাচন,তাও আবার গণপরিষদ নিবার্চন। কিন্তু আমজনতা কোনোটাই চাইতেছেন না, চাইতেছেন শান্তিতে দু-মুঠো ভাত খাওয়া, শান্তিতে সন্তান-সন্ততি বেঁচে থাক।
অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, কেউ ভ্রক্ষেপই দিচ্ছেন না এসবে। এই ভোট ও সংস্কার নিয়ে লাঠালাঠির ময়দানে দেশ ডুবতে বসেছে। এটা আবার কিভাবে, অনেকের প্রশ্ন আসতে পারে। প্রথমে বলা গল্পটিকে একটু ঝালিয়ে নিই।
১. একটু ভেবে দেখুন। ভাবনা শুরু ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসার পর। ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই ঘোষণা করলেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানি করতে হলে ৩৭% শুল্ক দিবেন।ভালো কথা, বাংলাদেশের ৬০% ভাগ পোশাক রফতানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। ধফাস করে পড়া ছাড়া এই ঘোষণার মিমাংসা বাংলাদেশের হাতে নেই। আজকেরই দেশ কাঁপানো সংবাদ হলো-‘ক্রয়াদেশ সংকটে ঈদের পর থেকে বন্ধ বহু গার্মেন্টস, বিপর্যস্ত শ্রমিকদের জীবন’। সংবাদে বলা হয় ‘ঈদুল ফিতরের ছুটির পর ক্রয়াদেশের অভাবে বন্ধ রয়েছে অনেক পোশাক কারখানায়। ক্রয়াদেশের অভাব, উৎপাদন ঘাটতি, লে-অফ ঘোষণাসহ নানা কারণে এসব কারখানা চালু করতে পারছেন না কারখানা মালিকরা। এমনকি কারখানা সচল করতে সরকারের কাছ থেকে কোন সহযোগিতাও পাচ্ছেন না তারা।’
২. পরের সংবাদটি আরো ভয়াবহ।‘গার্মেন্টস খাতের সংকট: ১,০০০ কারখানা ঝুঁকিতে, মাসে গচ্চা ২৫০ মিলিয়ন ডলার’। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত—তৈরি পোশাক শিল্প—বর্তমানে গভীর সংকটের মুখোমুখি। মার্কিন বাজারে ৩৭ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার না হলে প্রায় এক হাজার পোশাক কারখানা বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে, এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিল্প মালিকরা। এতে করে খাতটিকে প্রতি মাসে গড়ে ২৫০ মিলিয়ন ডলার শুল্ক দিতে হতে পারে, যা দেশের অর্থনীতি ও রপ্তানি সক্ষমতার জন্য একটি বড় ধাক্কা।
রাজধানীর উত্তরায় জায়ান্ট বিজনেস টাওয়ারে বিজিএমইএ নির্বাচন ২০২৫–২০২৭ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বিজিএমইএর প্রভাবশালী সংগঠন সম্মিলিত পরিষদ তাদের নির্বাচনী অফিস উদ্বোধনকালে গত শনিবার এই শঙ্কা প্রকাশ করেন।
৩. এদিকে, আরেকটি লোমহর্ষক সংবাদ। ‘লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থ এনবিআর: ৯ মাসে ৬৬ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি’। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। জানুয়ারিতে শতাধিক পণ্যে ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানো হলেও রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা।’এই ঘাটতি দেশকে তলানিতে নিয়ে যাবে, সেটা কি ভাবছেন কর্তারা। যারা বা যিনি পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবেন, আবার নির্বাচন দিবেন দিবেন, নাকি সংস্কার করে দেশকে ‘ইস্ত্রি” করে সাদা ধবধবে দেখাবেন, তারা ভাবছেন বন্ধুরা!
৪. এরপরের সংবাদটিও আর্থিকখাতে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে-‘আইএমএফের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি এখনো নিশ্চিত নয়: বাংলাদেশ ব্যাংক’। ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ঋণ পাওয়া এখনো শতভাগ নিশ্চিত নয় বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান’। তথ্যমতে-“আইএমএফের শর্তগুলো পূরণে আমরা কিছু ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারিনি,” বলেন আরিফ হোসেন খান। “সবগুলো বিষয় বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে নয়, কিছু শর্ত রাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট।”
তিনি আরও জানান, এবারের সফরে আইএমএফের মূল জোর ছিল রাজস্ব আহরণ বাড়ানো এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করার উপর। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনই বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের উপর ছেড়ে দিতে চায় না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি হলে তখন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
৫. এছাড়া মুদ্রাস্ফীতি চরম অবস্থায় পৌঁছেছে। পাউন্ডএর বিনিমিয় মূল্য আজ ২২ এপ্রিল ১৬৩ টাকা। বুঝেন এবার আমদানি পন্যে এর প্রভাব কী পরিমাণ বিপদজ্জনক। দ্রব্যমূল্য বেড়ে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অতিক্রম করে টলটলায়মান অবস্থা। আমদানি নির্ভর বাংলাদেশের জনজীবন কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সেটা কি সরকার ভাবছে?
৬. আর্থিকখাতের এসব অশনি সংকেতের পাশাপাশি ভারত ইতোমধ্যে বাতিল করে দিয়েছে ভারতকে ব্যবহার করে রফতানির বড় সুবিধা ট্রান্সশিপমেন্ট। আমাদের দেশেও শুধু পোশাক রফতানি হতো ভারতের কলকাতা ও দিল্লী এয়ারপোর্ট দিয়ে। কার্গো অবকাঠামো বাংলাদেশের বিমান বন্দরগুলোতে কম বা অপ্রতুল।যার জন্য কার্গো সিরিয়াল পেতে সময়সাপেক্ষ ছিল। দ্রুত শিপমেন্ট করার জন্য ভারতের দেয়া এই সুবিধা আমাদের জন্য ছিল বিশাল প্রাপ্তি। পত্ত্রিকান্তর প্রকাশ-প্রায় ৩৬টি দেশে ভারতের এ সুবিধা ব্যবহার করে বাংলদেশের পোশাক রফতানি হতো।
৭. এরপর শেয়ার বাজারে কি ঘটছে তা কেউ জানে না। গত৬ এপ্রিল ২০২৫। সকাল থেকেই ঢাকার মতিঝিলে বিরাজ করছে এক অজানা শঙ্কার ছায়া। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সামনে বিনিয়োগকারীদের মুখে চাপা উদ্বেগ স্পষ্ট। আর দুপুর গড়াতেই সেই উদ্বেগ রূপ নেয় হতাশায়। বাজার বন্ধের সময় দেখা যায়—ডিএসইএক্স সূচক নেমে এসেছে ৫২০৫.১৯ পয়েন্টে। মাত্র একদিনেই পতন হয়েছে ১৩.৯৭ শতাংশ—এ যেন এক প্রবল ধাক্কা।এটাই চলছে ক্রমান্বয়ে। ভবিষ্যত কী হবে বিনিয়োগকারিদের কপালই জানে।
৮. এরপর দ্বিতীয়টি হলো ভারত থেকে অল্পমূল্যে তুলা আমদানি হতো। সুতা প্রস্তুতে এ তুলা ব্যবহার হতো। এতে দাম কম রাখা সম্ভব হতো। গার্মেন্টস শিল্পে এ তুলা থেকে উতপাদিত সুতা ব্যবহার করে বিপুল মুনাফা অর্জন ছিল ভারতের দেয়া এই তুলা আমদানির সুযোগে।
৯. সব শেষে ভারত স্থগিত করলো ‘সেভেন সিস্টার্সে রেল যোগাযোগ স্থাপন’। এতোদিন গল্প শুনে আসছিলাম, ভারতকে সেভেনসিম্টাসেৃ যাওয়ার জন্য করিডর দিতে রেল ও সড়কপথ উন্মুক্ত করে দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। যেটি ‘সারভৌমত্ব বিরোধী’। এখন বিভিন্ন গণমাধ্যম বলছে, এতে বাংলাদেশই বেশি উপকৃত হতো।কেননা, বাংলাদেশের পণ্য উত্তরপূর্ব ভারতে রফতানি করে বিপুল অর্থ উপার্জন ছিল বড় প্রাপ্তি। উদাহরণ দিয়ে একটি পত্রিকা লিখেছে, শুধু ‘প্রাণ’ নামক শিল্প প্রতিষ্ঠান তাদের উতপাদিত পণ্য সেভেনসিস্টার্সে রফতানি করে এযাবত বিপুল ব্যবসা করেছে। ভারতের মূল ভুখন্ডে উতপাদিত বেশিল ভাগ পন্য বাংলাদশের পন্যের চেয়ে বেশি মূল্যের। এতে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের পন্যের বাজার সৃষ্টি ছিল অভাবনীয়।এতে ক্ষতি হলো কার মশায়?
১০.অপরদিকে, পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়া রাজনৈতিক চালবাজি, সেটার কোনো কার্যকারিতা যে কেমন তা হয়তো একটি মহল আগুন নিয়ে খেলা বা আগুনে ‘তা’ দেয়ার মতো কোনো বিষয় হয়ে কখন দাঁড়াবে কে জানে?
১১.শোনা যাচ্ছে, ইউনুস সাবের সেভেনস্টিার্স নিয়ে হুমকি,যা ক্ষমতাগ্রহণের আগেই দিয়েছিলেন, তার প্রতিফল এসব। এদিকে, আরো শোনা যাচ্ছে, রাখাইনরাজ্য প্রতিষ্ঠায় বিদেশী বড় শক্তিধররা নাকি বাংলাদেশকে ব্যবহারের ‘তাবিজাদি’ দেয়া শুরু করেছে। কোন ‘জাদু মন্ত্রণা’য় বাংলাদেশ মিয়ানমারের অস্থিরতায় ঘি ঢালবে কার সুবিধায়, সেটি এখন আর্ন্তজাতিকমহলে আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। ভূ-রাজনীতি বড় কঠিন জিনিস,চীন আর যুক্তরাষ্ট্র কী চায় বাংলাদেশের কাছে,সেটা নিয়ে নানা ধুম্রজাল রয়েছে।
এই সব দুর্দিনের দিনে সিলেটের ‘চৌধুরী’দের নৌকা ডুবে সলিল সমাধি’র যে গল্পটিই সত্য হতে চলেছে।যদিও গল্পটির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের ডুবে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন একেবারেই অবান্তর। উপরোক্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের আর্থিক ও আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যেমন প্রকট, তেমনি আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্রে কম আশংকার নয়। এই শংকাকে আমলে না এনে, শুধু লাঠালাঠিই করবেন ভাই বোনেরা। দেশ যে সত্যি সত্যি ডুবতে যাচ্ছে, সেটা কি লক্ষ্য করছেন? যা ঘটছে-এই নির্বাচন আর সংস্কারের লাঠালিাঠির কুরুক্ষেত্রে! ভাববার বিষয় বৈকি।