
।।কবির য়াহমদ।।
লন্ডনে এক আওয়ামী লীগ নেতার পারিবারিক অনুষ্ঠানে সদ্য-সাবেক চার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতি নিয়ে গেল-গেল রব ওঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এটা নিয়ে ইতিবাচক কোন কিছু দেখিনি ফেসবুকে, যতখানি আলোচনা তার সব নেতিবাচক।
আমি নিজেও তৃতীয়পক্ষীয় একটা মতামত দিয়েছিলাম এভাবে: ‘‘দৈনিক যুগান্তর ফটোকার্ডে লিখল: প্রথমবার একসঙ্গে আ.লীগের সাবেক চার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর ভুরিভোজ: কর্মীদের উষ্মা।’ যুগান্তর কর্মীদের কথা লিখেছে। এদিকে, সাধারণ জনতা হিসেবে আমি ভেবেছিলাম নাওয়াখাওয়া ছেড়ে আওয়ামী লীগের সাবেকরা সন্ন্যাস জীবন বেছে নিয়েছে। তাদের অনশন করাই তো কথা ছিল।’’
আমার ফেসবুক স্ট্যাটাসটা স্যাটায়ারধর্মী ছিল। বলতে চেয়েছিলাম ক্ষমতাহারা হয়ে গেলে বা এরচেয়ে বেশি কোন শোকের ঘটনা ঘটলে কি মানুষ সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে একাকী হয়ে যেতে হয়? আমার ধারণা, অনেকেই স্যাটায়ারকে স্যাটায়ার হিসেবে দেখেননি।
অনেকগুলো পত্রিকা যে নিউজ করেছে সেখানে বিভক্তির ভেদরেখা এঁকে দেওয়ার প্রচ্ছন্ন একটা ইঙ্গিত ছিল। অনেকের ইঙ্গিত ছিল দেখো তোমাদের নেতা কত সুখে? লন্ডনে সুখের জীবন যাপন করছেন। কিছুদিন আগে প্রথম আলো বিদেশে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিলাসী জীবন নিয়ে একটা প্রতিবেদন করেছিল। সে প্রতিবেদনেও প্রচ্ছন্ন একটা ইঙ্গিত ছিল, বিভক্তির ভেদরেখা শক্তিশালী করার রসদ ছিল।
সাবেক প্রতিপত্তিশীল আওয়ামী লীগ নেতারা এখন এনসিপির খুচরা নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর মতো শক্তি রাখেন না বলে প্রথম আলোকে প্রতিবেদনের সংশোধনী দিতে হয়নি, ভেতরের অংশও পরিবর্তন করতে হয়নি। অবশ্য আওয়ামী লীগ নেতারা হাসনাতের মতো হুমকির স্বরে কিছু বলেনওনি।
যে চার নেতাকে নিয়ে এখন এত আলোচনা তারা হচ্ছেন: হাছান মাহমুদ, আবদুর রহমান, শফিকুর রহমান চৌধুরী ও খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তারা গত ২০ এপ্রিল লন্ডনের ওটু এলাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অনুষ্ঠিত যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুকের ছেলের বিয়েতে গিয়েছিলেন। তারা কেবল এই একটা বিয়ের অনুষ্ঠানেই যাননি, এরআগে এ-মাসের শুরুতে যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগের সভাপতি সুলতান শরীফকে দেখতে হাসপাতালেও গিয়েছিলেন। এরওআগে রমজান মাসে ইফতার পার্টিতে অন্যদের সঙ্গে দেখা গিয়েছিল সিলেটের সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীসহ সাবেক মন্ত্রী মো. আবদুর রহমান,খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী ও সাবেক এমপি হাবিবুর রহমান হাবিবকেও।
আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপি-মেয়রদের লন্ডনে বা বিদেশের কোথায় দেখা গেলে আপত্তির কী? তাদের বেশিরভাগই আছেন দেশের বাইরে, এটা জানা কথা আমাদের। ওসব জায়গায় সামাজিক-রাজনৈতিক কোন অনুষ্ঠানে দেখা গেলে, এটাকে নেতিবাচকভাবে না দেখে, বরং ইতিবাচকভাবেই দেখতে পারে দলটির নেতাকর্মীরা।
বিদেশে শীতের পোশাকে অথবা পরিপাটি সাজে কোন নেতাকে দেখা গেলে তারা সুখে আছেন এমন ভাবার কোন কারণ নাই। তাদের বেশিরভাগই বিদেশের কোন দেশের নাগরিক নন। এমপির নির্বাচন করতে শফিকুর রহমান চৌধুরী ও হাবিবুর রহমান হাবিব আগেই যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব ছেড়েছেন বলে আমরা জানি। আর হাছান মাহমুদ, আবদুর রহমান, খালিদ মাহমুদের কেউ বিদেশের কোন দেশের নাগরিক বলেও কোন তথ্য নেই। এখন তারা ওসব দেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ট্যাটাসধারী বলেই ধারণা। বিদেশের কোন দেশের নাগরিক হলে তারা কেউ মন্ত্রিত্ব পেতেন না।
বাংলাদেশে সরকারি প্রতিহিংসা থেকে বাঁচতে জনাব তারেক রহমান যেমন লন্ডনে আশ্রিত, ঠিক একইভাবে আওয়ামী লীগ নেতারাও এখন লন্ডনে আশ্রিত। নয় কি!
অদ্য যারা সামাজিক অনুষ্ঠানে সদ্য-সাবেক চার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতি দেখে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন, তারা বরং জনপরিসরে তাদেরকে দেখে আশাবাদী হতেই পারেন। তারা ভাবতে পারেন, তাদের নেতারা বিদেশে থাকলেও একেবারে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েননি। সামাজিক অনুষ্ঠানে তারা উপস্থিত হচ্ছেন, এর অর্থ হচ্ছে তারা আগের ফর্মে ফিরে আসার অপেক্ষায় রয়েছেন।
সরকারের বাইরে চলে যাওয়ায় আওয়ামী লীগই বর্তমানে বাংলাদেশে বিরোধীদল। তাদেরকে নিয়ে সরকার যে পরিকল্পনা করুক না কেন, বিরোধীদল হিসেবে আওয়ামী লীগ কেমন সেটা তো জানে পাকিস্তানিরা।
একাত্তরের আগে থেকে প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতারা কতখানি কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে, সে সাক্ষ্য দেয় ইতিহাস। আওয়ামী লীগ এখন একাত্তরপূর্ব এবং পঁচাত্তর-পরবর্তী অবস্থায় নিপতিত। এমন অবস্থায় বিদেশের জনপরিসরেও যদি কোন আওয়ামী লীগ নেতাকে দেখা যায়, তবে এটাকে দেশে থাকা দলটির নেতাকর্মীদের ইতিবাচক রূপে দেখতে পারে।
ধারণা করছি, আগস্ট-পরবর্তীতে উল্লেখের মতো কয়েক হাজার আওয়ামী লীগ নেতা দেশ ছেড়েছেন। সবাইকে এখনও দেখা যাচ্ছে না। যাদের দেখা যাচ্ছে তারা যদি সমালোচনার মুখে পড়েন, তাহলে লুকিয়ে থাকা অন্যরা কীভাবে বের হবেন?
দলের মধ্যে শুদ্ধি একটি অভিযান পরিচালনার দাবি দেশে থাকা অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর। ধারণা করছি, এটা হবে। তবে এখনই হবে বলেও মনে হচ্ছে না। কারণ এখন প্রথমে সংঘবদ্ধ হওয়া তাদের টার্গেট। ভয়ে এখনও যারা মুখ লুকিয়ে, তারা যদি আরও কিছুদিন লুকিয়ে থাকেন, তবে এমনিতেই বাদ পড়ে যাবেন। যারা বাইরে বেরুবেন, তারাও যে টিকে থাকবেন, এমন না। তবে টিকে থাকবেন তারা বেরিয়ে এসে সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার কাজ শুরু করে দেবেন।
লন্ডনে যে চার সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে জনপরিসরে দেখা গেছে, তাদের সমালোচনা না করে বরং তাদের পাশে দাঁড়ান। সামাজিক অনুষ্ঠানে তাদের উপস্থিতি প্রমাণ করে তারা হতাশায় ভেঙে পড়েননি। তাদের সঙ্গে লুকিয়ে থাকা অন্যদের তুলনা করুন; উত্তর পেয়ে যাবেন। আপনারা তো দৃঢ় মনোবলের নেতাই চান। যারা লুকিয়ে তারা কাপুরুষ কিনা বরং সে প্রশ্নই করতে পারেন!
আট মাসেও আওয়ামী লীগের যে সকল নেতা দেশের বাইরে থেকেও জনপরিসরে আসার সাহস দেখাতে পারেননি, তাদের নিয়ে প্রশ্ন তুলুন। যারা বাইরে আসছে, তাদেরকে আরও উৎসাহ দিয়ে বলুন: টিকিট অ্যাভেইলেবল…!
বিদেশ মানেই বিলাসী জীবন নয়। পেট বাঁচাতে, প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছাড়ে মানুষ। টিকে থাকার জীবন ওটা, বেঁচে থাকার জীবন ওটা। সংগ্রাম আর পলাতক জীবনে সুখ থাকে না; তবু সমূহ অভিনয় করতে হয়।
সুখ বলছি যা, তারা উত্তরে হয়ত বলছে ‘কী সুখে আছি কইতাম না…!’ বাইরে ঝড়, তাই আওয়াজটা ঠিকঠাক কানে আসছে না। এদিকে,
মিছিলে যখন লোক বাড়ছে আওয়ামী লীগের, দেশে-বিদেশে জনপরিসরে উপস্থিতিও দেখা যাচ্ছে-জোরালো আলোচনার শুরু তখন কিনা…!
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।