বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগজনক পূর্বাভাস প্রকাশিত হয়েছে। চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৩.৩ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক, যা আগের ৪ শতাংশের পূর্বাভাসের চেয়েও কম।
উল্লেখ্য, কোভিড-১৯ মহামারির সময়েও বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে ছিল এবং সে সময় ভারতের প্রবৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এই পতনের জন্য রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিনিয়োগে মন্দা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতাকে দায়ী করা হচ্ছে।
গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ৬ থেকে ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি বজায় রেখে বিশ্বের দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর একটি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। এমনকি ২০২০-২১ সালে কোভিড মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি অসাধারণ স্থিতিশীলতা দেখিয়েছিল। সে সময় ভারতের অর্থনীতি মন্দার মুখে পড়লেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ঈর্ষণীয়।
কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অবরোধ, ছাত্র-শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সমাজের অস্থিরতা, লুটতরাজ, বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা এবং ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তার কারণে অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ‘সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেট: ট্যাক্সিং টাইমস’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেসরকারি ও সরকারি বিনিয়োগে তীব্র পতন এই মন্দার প্রধান কারণ।
অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ব্যর্থতা এই সংকটের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বছরে মাত্র ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা গত তিন দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি, আমদানি নিষেধাজ্ঞা এবং শক্তির ঘাটতি শিল্প উৎপাদনকে বাধাগ্রস্ত করেছে। অর্থনীতিবিদ ড মামুন বলেন, “কোভিড সংকটের সময়ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিগত ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশকে পিছিয়ে দিচ্ছে।”
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২৬ অর্থবছরে ৫.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির দিকে ফিরতে পারে, তবে তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং কাঠামোগত সংস্কারের ওপর।
বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ৯.৭ শতাংশের কাছাকাছি, যা জনজীবনে ব্যয় বাড়াচ্ছে। বৈশ্বিক বাণিজ্যে বাধা, উচ্চ আমদানি খরচ এবং দেশীয় নীতিগত অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রাইসার বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতি কোভিড সংকটে দৃঢ়তা দেখিয়েছিল, কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক সংকট এবং সংস্কারের অভাব এর সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করছে।”
কোভিড সংকটে বাংলাদেশের সাফল্য
২০২০-২১ অর্থবছরে কোভিড মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশের ওপরে, যখন ভারতের অর্থনীতি ৫.৮ শতাংশ সংকুচিত হয়েছিল। রপ্তানি, রেমিট্যান্স এবং কৃষি খাতের শক্তিশালী অবদানের কারণে বাংলাদেশ সে সময় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়। কিন্তু বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিগত দুর্বলতা এই অর্জনকে বিপন্ন করছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো এবং বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে কাজ করছি।”
তবে, অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়া অর্থনীতি আরও চাপের মুখে পড়বে।
বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০২৫ সালে ৫.৮ শতাংশে নেমে আসবে। ভারতের প্রবৃদ্ধি ৬.৩ শতাংশ, পাকিস্তানের ৩.১ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কার ৩.১ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের এই নিম্ন প্রবৃদ্ধি অঞ্চলের অন্যান্য দেশের তুলনায় দুর্বল অবস্থান নির্দেশ করে।
ঢাকার তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী মো. আলমগীর বলেন, “কোভিডের সময়ও আমরা ব্যবসা চালিয়েছি, কিন্তু এখন ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না, গ্রাহক কমে গেছে।”
নারী উদ্যোক্তা ফারজানা এইচ. হোসেন বলেন, “কোভিডে দেশ এগিয়েছিল, কিন্তু এখন চাকরির বাজার খারাপ, আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।”
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ব্যবসাবান্ধব নীতি এবং কাঠামোগত সংস্কার জরুরি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আর্থিক খাতে সংস্কার, কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বিনিয়োগের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের বর্তমান ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে না পারলে, কোভিড সংকটে অর্জিত অর্থনৈতিক শক্তি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জনগণ এখন এমন একটি সরকারের অপেক্ষায়, যারা অর্থনীতিকে পুনরায় ৬-৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পথে ফিরিয়ে আনতে পারবে।