।। আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন।।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল এই ২৪ বছর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বর্তমানে বাংলাদেশ আঞ্চলিক বৈষম্যের শিকার হয়। পাকিস্তান সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য নীতি, আমদানি-রপ্তানি নীতি, বৈদেশিক সাহায্য নীতি তথা সামগ্রিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার প্রবণতা বরাবর লক্ষণীয় ছিল। ভূখণ্ড-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্য দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রে এক রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য রাষ্ট্রের স্থলাভিষিক্ত হওয়াকে রাষ্ট্রীয় উত্তরাধিকার বলে। ভূখণ্ডের ওপর রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের পরিবর্তন আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন: রাজনৈতিক নিষ্পত্তি, স্বেচ্ছা একত্রীকরণ, ভূখণ্ডের হস্তান্তর, স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বা যুদ্ধ, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কর্তৃক স্বাধীনতা অর্জন ইত্যাদি।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্বাধীনতার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ড অর্জন করেছে এবং বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকার রাষ্ট্রের সব সুবিধা অর্জনের অধিকারী। দ্বিপক্ষীয় পর্যায় এবং জরুরি প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি তুলে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা জরুরি। পাকিস্তানি শিল্পপতিদের পরিত্যক্ত ঘোষিত সম্পত্তির হিসাব এবং পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের পাওনার সমন্বয় করেও এ সমস্যার সহজ সমাধান সম্ভব। পাকিস্তান মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত কাদের মোল্লার ফাঁসিকে এবং মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডের রায়কে কেন্দ্র করে যে অকূটনৈতিকসুলভ আচরণ করছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের কাছে প্রাপ্ত সম্পদের দাবি আবার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপস্থাপিত করা বাংলাদেশ সরকারের জরুরি হয়ে পড়েছে। দেশেও এ ব্যাপারে জনমত গঠন করার জন্য বিভিন্ন সংগঠনের সোচ্চার হতে হবে।
ভূমিকা
বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্পদ বণ্টন বিষয় অমীমাংসিত সমস্যা। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো দেশ বিভক্ত হয়ে পড়লে বা স্বাধীন হলে দেশটির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিও বণ্টন হয়ে থাকে। অবিভক্ত পাকিস্তানের সম্পদের একটি অংশ বাংলাদেশের প্রাপ্য হলেও স্বাধীনতার ৪৩ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও বাংলাদেশ কোনো সম্পদ পাকিস্তানের কাছ থেকে পায়নি। এ ব্যাপারে পাকিস্তানের অনীহার কারণে উচ্চপর্যায়ে কিছু আলোচনা ও কমিটি গঠন ছাড়া কোনো অগ্রগতি হয়নি। অন্যদিকে দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের জোরালো তৎপরতার অভাবে বিষয়টি পাকিস্তান আমলে আনেনি। এর ফলে দুদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যেমন সন্দেহ ও সংশয়মুক্ত হতে পারেনি, অন্যদিকে বাংলাদেশ সম্পদের ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে হয়েছে বঞ্চিত। বর্তমান প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে: প্রথমত, বাংলাদেশের পাকিস্তানের কাছে অর্থ ও সম্পদ দাবির ভিত্তি তুলে ধরা, দ্বিতীয়ত, সম্পদ বণ্টন প্রসঙ্গে প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন উপস্থাপনা এবং তৃতীয়ত, সম্পদ বণ্টন বিষয় দুদেশের মধ্যে এযাবৎ যেসব কূটনৈতিক তৎপরতা ও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা বিশ্লেষণ করা।
এক. বাংলাদেশের পাকিস্তানের কাছে অর্থ ও সম্পত্তি দাবির ভিত্তি
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল এই ২৪ বছর বাংলাদেশ বিভিন্ন পর্যায়ে বৈষম্যের শিকার হয়। পাকিস্তান সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য নীতি, আমদানি-রপ্তানি নীতি, বৈদেশিক সাহায্য নীতি তথা সামগ্রিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার প্রবণতা বরাবর লক্ষণীয় ছিল। যে কারণে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দুই অংশের মাথাপিছু আয়, উন্নয়ন-ব্যয়, রাজস্ব খাতে ব্যয়, বৈদেশিক বাণিজ্য, আন্তপ্রাদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক সাহায্যের ক্ষেত্রে বিশাল বৈষম্য গড়ে ওঠে। বৈষম্য নিরসনে সরকারের উদ্যোগের অভাব, পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব পূর্বাঞ্চলের অগ্রগতিকে ব্যাহত করে। যে কারণে স্বাধীন বাংলাদেশ ছিল একটি বিপর্যস্ত ভূখণ্ড। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ। ঢাকায় জাতিসংঘের কার্যক্রম পরিচালনা কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১.২ বিলিয়ন ডলার এবং বাংলাদেশ সরকারের হিসাবে ১২৪৯ কোটি টাকা। (তথ্যসূত্র: তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ, ঢাকা: ১৯৭২, পৃ. ৯৪-৯৫)
এ প্রসঙ্গে ১৯৪৭-১৯৭১ সাল পর্যন্ত কয়েকটি খাতের বৈষম্য তুলে ধরলে দাবিটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথমত, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য পশ্চিম পাকিস্তানের অনুকূলে চূড়ান্ত ও আপেক্ষিকভাবে বেড়ে যায়। ১৯৪৯ সালে দুই অঞ্চলের ব্যবধান ছিল যেখানে ৬৩ টাকা (২১.৯%), তা ২০ বছরের ব্যবধানে ১৯৬৯ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২০২ টাকায় (৬১.০৫)। (তথ্যসূত্র: রেহমান সোবহান, “বাঙালি জাতীয়তাবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি,” দ্রষ্টব্য সিরাজুল ইসলাম, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪-১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড, ঢাকা: এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, ১৯৯৩, পৃ. ৬১৯)
দ্বিতীয়ত, রাজস্ব খাতে আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য নীতি প্রকটভাবে দেখা যায়। ১৯৬৫-৬৬ থেকে ১৯৬৮-৬৯ সাল পর্যন্ত ৭২৮.৫ কোটি টাকা আয় করে খরচের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার থেকে পূর্ব পাকিস্তান রাজস্ব ও উন্নয়ন খাত থেকে বরাদ্দ পায় ১৩৩৬.২ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তান ১৭৮১.৭ কোটি টাকা আয় করে ব্যয়ের জন্য পায় ২৭৬৭.১ কোটি টাকা। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উন্নয়ন খাতে পায় যথাক্রমে ৮৫১.৫ কোটি ও ১১০৭.৬ কোটি টাকা। (তথ্যসূত্র: Rehmen Sobhan, “The Balance Sheet of Disparity,” The Forum, 14 November 1970)। এ ক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহায্য ঘাটতি পূরণ ও বৈদেশিক সাহায্য বণ্টনের ক্ষেত্রেও বৈষম্য লক্ষণীয়।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান ৭৬৪০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি পেলেও পূর্ব পাকিস্তান পেয়েছে ২০২৪ মিলিয়ন ডলার বা ২৬.৬ শতাংশ। (তথ্যসূত্র: Report on Economic Relation Between East and West Pakistan, Karachi : 1961, pp. 48-50)
অবশ্য এ ঋণের ৬৪৩৯ মিলিয়ন ডলার কাজে লাগানো হয় এবং বাংলাদেশ পায় ১৯৪১ মিলিয়ন ডলার বা ৩০ শতাংশ। (তথ্যসূত্র: M. Nazrul Islam, Pakistan Malaysia, A Comparative Study in National Integration, Dhaka: Academic Publishes, 1990, p.55)
অথচ জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রাপ্ত বৈদেশিক সাহায্যের ৫৬ শতাংশ কিংবা সমবণ্টনের ভিত্তিতে ৫০ শতাংশ ঋণ প্রাপ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। চতুর্থত, পাকিস্তানের বাণিজ্যনীতির মধ্যেও শোষণের বীজ রোপিত ছিল। ১৯৪৭-৭০ সালের মধ্যে মোট রপ্তানির ৫৪.৭ শতাংশ আয় করেছে পূর্ব পাকিস্তান, এর পরিমাণ ছিল ২৫,৫৫৯ মিলিয়ন টাকা অর্থাৎ ৫,৩৭০ মিলিয়ন ডলার (৩১.১ শতাংশ)। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান আয় করেছে ২১,১৩৭ মিলিয়ন টাকা (৪,৪৪০ মিলিয়ন ডলার)। মোট রপ্তানি আয়ের ৪৬,৬৯৬ মিলিয়ন টাকার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান আমদানির জন্য এ সময় বরাদ্দ পেয়েছে মাত্র ২০,০৬৭ মিলিয়ন টাকা অর্থাৎ ৪,২২৬ মিলিয়ন ডলার এবং পশ্চিম পাকিস্তান পেয়েছে ৯,৩১২ মিলিয়ন ডলার। (তথ্যসূত্র: Central Statistical Office, Monthly Foreign Trade Statistics, June 1970, Karachi: Government of Pakistan Press, 1970, p.1)
এ ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ের উদ্বৃত্ত ৪৪২২ কোটি টাকা পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ব্যয় করা হয়। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদের মতে, রপ্তানি আয় থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ হবে ২০০০ মিলিয়ন ডলার। অর্থনৈতিক শোষণের আরও একটি ক্ষেত্র ছিল দুই অঞ্চলের বাণিজ্য। ১৯৪৭-৬৯ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে রপ্তানি হয় ১৭৩৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। অথচ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানি করতে হয় ৩৩০৯ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য। (তথ্যসূত্র: Economic Survey of East Pakistan 1967-70. Dacca: Government of East Pakistan Press, 1969, p.22)
এমনিভাবে দুটি অঞ্চল বাণিজ্যের নামে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিপুল মুনাফা অর্জন ও অর্থ পাচার করে। ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল সরকার-নিয়ন্ত্রিত দৈনিক বাংলা দাবি করে শুধু বৈদেশিক বাণিজ্য খাতে পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের ৫০০০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে।
দুই. রাষ্ট্রীয় উত্তরাধিকার, দায় গ্রহণ ও সম্পদ বণ্টন সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আইন
ভূখণ্ড-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্য দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রে এক রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য রাষ্ট্রের স্থলাভিষিক্ত হওয়াকে রাষ্ট্রীয় উত্তরাধিকার বলে। ভূখণ্ডের ওপর রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের পরিবর্তন আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন: রাজনৈতিক নিষ্পত্তি, স্বেচ্ছা একত্রীকরণ, ভূখণ্ডের হস্তান্তর, স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বা যুদ্ধ, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কর্তৃক স্বাধীনতা অর্জন ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্বাধীনতার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ড অর্জন করেছে এবং বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকার রাষ্ট্রের সব সুবিধা অর্জনের অধিকারী।
রাষ্ট্রীয় উত্তরাধিকার দুটো আন্তর্জাতিক কনভেনশনে বিস্তারিত উল্লেখ আছে। এগুলো হচ্ছে চুক্তি-সংক্রান্ত ১৯৭৮ সালের ২৩ আগস্ট এবং ১৯৮৩ সালের ৭ এপ্রিল প্রণীত ‘ভিয়েনা কনভেনশন’। ১৯৮৩ সালের কনভেনশনের ৪০-৪১ ধারায় দায় সম্পর্কে বলা হয়েছে, যখন কোনো রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের অংশবিশেষ একাধিক রাষ্ট্রের মধ্যে ভাগ হয়ে একাধিক রাষ্ট্রের অংশে পরিণত হয় তখন বিভক্ত রাষ্ট্র বা ভূখণ্ডের ঋণও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের মধ্যে আনুপাতিক হারে ভাগ হবে। সম্পদ বণ্টন সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আইনের সাধারণ নিয়ম হচ্ছে হস্তান্তরিত ভূখণ্ডে অবস্থিত বা হস্তান্তরিত ভূখণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত সব স্থাবর ও অস্থাবর রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি এবং তহবিলের অধিকার উত্তরাধিকারী রাষ্ট্রের ওপর বর্তাবে। এই বিধান সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত এবং প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের মর্যাদা লাভ করেছে।
বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত আন্তর্জাতিক আদালত ও স্থায়ী আন্তর্জাতিক আদালতের সিদ্ধান্ত এবং অভিমতেও অনুরূপ স্বীকৃতি পাওয়া যায়। এমনকি স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি পূর্ববর্তী রাষ্ট্রের সীমানার বাইরে বা বিদেশে অবস্থিত হলেও তা যদি হস্তান্তরিত ভূখণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয় তাহলে তার অধিকার উত্তরাধিকারী রাষ্ট্রের। তাহলে আন্তর্জাতিক আইনের উত্তরাধিকারীর অধিকার এক কথায় এভাবে প্রকাশ করা যায় যা ১৯৭৮ সালের ‘ভিয়েনা কনভেনশনের’ আর্টিক্যাল ২-এ বর্ণিত আছে। এতে বলা হয়েছে, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তার পূর্ববর্তী রাষ্ট্রের তহবিল এবং অস্থাবরসহ সব বিষয়ে সম্পত্তিতে হিস্যার অধিকারী। (তথ্যসূত্র: H. O. Agarwal, Intenational Law, Allahabad : Allahabad Law Agency, 1987, p. 146)
আন্তর্জাতিক আইনের এসব ধারার ভিত্তিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে সঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রা, স্থাবর সম্পত্তি, বিমান (পিআইএ), ব্যাংক-বিমা, রেলওয়ে, শিল্পসহ অন্যান্য খাতে অর্থ দাবি করতে পারে। এমনকি ১৯৭১ সালের আগে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের অনেক সম্পত্তি বিদেশের মাটিতে ছিল, যেমন দূতাবাসের ভবন বা ভবন স্থানে অনেক অস্থাবর সম্পত্তি ছিল। আন্তর্জাতিক আইনের ওই কনভেনশনের ১৭-১৮ ধারায় বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে এই সম্পদ পাওয়ার অধিকারী। এ ক্ষেত্রে আইনে পূর্ববর্তী বা সাবেক রাষ্ট্রের ঋণের দায় গ্রহণও জরুরি। (তথ্যসূত্র: ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় এমনি একটি চুক্তি হয়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দুটি দেশের সম্পদ বণ্টনের জন্য গভর্নর আর. জি. কেসিকে পার্টিশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান করা হয়। যদিও এই অর্থ বণ্টনে দুটি দেশই কৌশলের আশ্রয় নেয়। তাই দেখা যায় যে, সম্পদ বণ্টনে আন্তর্জাতিক আইন থাকলেও তা উদ্ধার অত্যন্ত জটিল। এ সম্পর্কিত আলোচনা জন্য দ্রষ্টব্য V.B. Kulkarni, Pakistan, Its Origin and Relation with India, Dhaka: Academic Publishers, p. 108. AviI `ËÓ¡eÅ Lok Sobha Debath, Vol-32, 1973, p. 57)
আন্তর্জাতিক আইনে যেহেতু নতুন রাষ্ট্রকে উত্তরাধিকার রাষ্ট্র হিসেবে দেখা হয়, তাই বাংলাদেশের মতো যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রের জন্য এ ধরনের সম্পদের পরিমাণ নির্ধারণ ও বণ্টনের জন্য একটি চুক্তি সম্পাদন করা জরুরি।
অবশ্য পাকিস্তান আমলে নেওয়া ঋণের মধ্যে বাংলাদেশ ১৯৭৮ সালের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সমাপ্ত প্রকল্পের মোট ৫০৬.৭৬১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১৩.৪৮৫ মিলিয়ন ডলারের দায় গ্রহণ করে। (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের বিতর্ক খণ্ড ২, সংখ্যা ১৪, ৮ জুন ১৯৭৯, পৃ. ৮৫৭-৮৬৩)
এ ছাড়া চলমান প্রকল্পের ১৪৫.৮৬ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১৩৬.১২১ মিলিয়ন ডলারের দায়ও বাংলাদেশ গ্রহণ করে। পাকিস্তান এত দিনের দাবি বৈদেশিক ঋণের এক-তৃতীয়াংশ পূর্ব পাকিস্তানের ব্যয়ের যে হিসাব দেখানো হতো বাংলাদেশের ঋণের দায় গ্রহণের ফলে বৈদেশিক ঋণ-সংক্রান্ত দুদেশের টানাপোড়েনের অবসান ঘটে। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান বাংলাদেশের ওপর ঋণ চাপিয়ে দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যত তৎপর ছিল বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে সম্পদ প্রাপ্তির ব্যাপারে ততটা তৎপরতা দেখায়নি।
তিন. সম্পদ বণ্টন বিষয়ে গৃহীত উদ্যোগ ও কূটনৈতিক তৎপরতা, ১৯৭২-২০১৫
স্বাধীনতার পর সম্পদ বণ্টনের বিষয়টি বাংলাদেশ বিক্ষিপ্তভাবে উত্থাপন করলেও ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানের স্বীকৃতির পর বাংলাদেশ এ ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়। মূলত বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি আদায়সহ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন ও বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্তির স্বার্থে সেই সঙ্গে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অপপ্রচার খণ্ডনে ব্যস্ত থাকায় এত দিন বাংলাদেশ এ বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়নি। ১৯৭৪ সালের জুন মাসের মধ্যেই পাকিস্তান আমলে নেওয়া ঋণ পরিশোধে বিশ্বব্যাংক ও দাতাদেশগুলোর নির্ণীত ফর্মুলার ভিত্তিতে বাংলাদেশ সমঝোতায় পৌঁছালে তার পক্ষ থেকে সম্পদ বণ্টনের ব্যাপারটি আরও গুরুত্ব পায়। সম্পদ বণ্টনের ব্যাপারে বাংলাদেশ গুরুত্ব দেওয়ার পর থেকে পাকিস্তান অত্যধিক সতর্কতা অবলম্বন করে।
পাকিস্তান সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশের কাছে সম্পদ বণ্টনের জোরালো দাবি না করলেও স্বাধীনতার পর অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকেই পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা (স্বাধীনতার আগে যাদের বাংলাদেশে ব্যবসা ছিল) সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের কাছে সম্পদ দাবি করতে থাকে। এভাবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করে পাকিস্তান আগাম প্রতিষেধক নেয়, যাতে করে বাংলাদেশ সম্পদ বণ্টনে কোনো রকম জোরালো দাবি না করতে পারে। অবশ্য বাংলাদেশের দাবি আন্তর্জাতিক আইনে যতটা জোরালো ছিল তার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের দাবি টেকানো ছিল কষ্টকর। তাই সম্পদ বণ্টনে পাকিস্তান সরকার কার্যত মৌনভাব অবলম্বনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে নিষ্ক্রিয় রাখার নীতি গ্রহণ করে।
তবে এটা ঠিক, পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক অবাঙালিরা যুদ্ধের সময় এবং স্বাধীনতার প্রাক্কালে তাদের সম্পত্তি ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান রেখেই বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যায়। বাংলাদেশ সরকার তাদের সম্পত্তি প্রথমে পরিত্যক্ত এবং পরে জাতীয়করণ করে সরকারের অধীনে নিয়ে আসে। স্বাধীনতার পরপর ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষে করাচিতে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক রিসার্চ ঢাকা ও করাচির স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানির হিসাবের ওপর ভিত্তি করে একটি সমীক্ষা চালায়। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে এই সমীক্ষার ভিত্তিতে প্রকাশিত রিপোর্টে ব্যবসায়ীরা দাবি করেন যে বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের ২১০ কোটি রুপির সম্পত্তি ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এর মধ্যে ৯৮ কোটি রুপি পাট শিল্প, ২৫ কোটি রুপি কাগজ ও বোর্ড শিল্প, ২২ কোটি রুপি বিদ্যুৎ ও তেল, ২০ কোটি রুপি রেয়ন ও সিনথেটিক এবং ১৭ কোটি রুপি সুতা বয়ন খাতে। অবশ্য এই হিসাবে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানিদের পাওনার একটি ভিন্ন খতিয়ান এই সমীক্ষায় তুলে ধরা হয়। দেখা যায় যে ৪৯৮৩.৮৫ লাখ রুপি বেসরকারি মালিকানাধীন ব্যবসা ও শিল্পের দাবির সঙ্গে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ২১০ কোটি রুপির সম্পদ যোগ করলে মোট দাবির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫১৯৩.৮৫ কোটি রুপি। (তথ্যসূত্র: Hindustan Standard, 27 June 1974)
এই সমীক্ষাটি সরকারি পর্যায়ে সম্পন্ন না হলেও এর পেছনে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। সরকারের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের দাবির বিপরীতে এ রকম একটি আগাম প্রতিষেধক নিয়ে রাখা। বাংলাদেশ ১৯৭২ সালের শেষদিক থেকে অস্পষ্টভাবে পাকিস্তানের কাছে পাওনা সম্পদের দাবির বিষয়টি উত্থাপন করতে শুরু করে। অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে যেকোনো দেশকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক লেনদেনে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দেন। (তথ্যসূত্র: Pakistan Horizon, Vol. XXV, No. 4, 1972, p. 86)
অবশ্য এখানে অর্থনৈতিক লেনদেন বলতে তিনি সম্পদ বণ্টনকে বুঝিয়েছেন কি না সেটা স্পষ্ট নয়। তাঁর ওই বক্তব্যের ভেতর দিয়ে এ সময় বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদেশগুলোর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ওপর ঋণের দায় চাপানোর পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ের নিষ্পত্তিরও তিনি ইঙ্গিত দিয়ে থাকতে পারেন। অবশ্য বাংলাদেশ স্বীকৃতিসহ বিহারিদের প্রত্যাবাসন, পাকিস্তান থেকে বাঙালিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে যতটুকু সোচ্চার ছিল, সম্পদ বণ্টনের দাবিতে ততটা ছিল না। হয়তো এ লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য ইচ্ছেকৃতভাবেই বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছে।
অবশ্য ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে জাপান সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের এ সম্পর্কে বলেন, ‘ভুট্টো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বিলম্ব করছেন এ কারণে যে স্বীকৃতি দিলে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তিনি বাংলাদেশকে সম্পদের অংশ দিতে বাধ্য হবেন। পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশের সব সম্পদ নষ্ট করে দিয়েছে। আমাদের কোনো জাহাজ ও বিমান পর্যন্ত রেখে যায়নি। তাদের উচিত দ্রুত স্বীকৃতি ও আমাদের প্রাপ্য সম্পদ ফেরত দেওয়া। আমি আন্তর্জাতিক আইনে ন্যায়সংগত প্রাপ্য ছাড়া পাকিস্তানের কাছ থেকে আর কিছুই চাই না।’(তথ্যসূত্র: Asian Recorder, Vol, XIX, No. 51, 1973, p. 11749)
অবশ্য ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের স্বীকৃতি লাভের পর বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সচেতন হয়। এত দিন পাকিস্তানের স্বীকৃতির ব্যাপারটিকে সামনে রেখে এ বিষয়ে তেমন জোর না দিলেও এ পর্যায়ে এসে বাংলাদেশ বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে। এ বছর ৬ মার্চ অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, পাকিস্তানের স্বীকৃতি তার কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব সম্পত্তির হিস্যা আদায়ের পথ প্রশস্ত করেছে। (তথ্যসূত্র: দৈনিক বাংলা, ৭ মার্চ ১৯৭৪)
৫-৯ এপ্রিল দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তান আলোচনায় বসে। সম্পদ বণ্টন ইস্যুটি বৈঠকে উপস্থাপিত হবে, বৈঠকের প্রাক্কালে এমন ধারণা বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে বেশ আলোচিত হয়। এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন দিল্লি যাওয়ার প্রাক্কালে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারে, এ সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেন। বৈঠকের দুই দিন আগে সরকার-নিয়ন্ত্রিত দৈনিক বাংলা পত্রিকায় বাংলাদেশের প্রাপ্য সম্পদের ওপর বিস্তারিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, শুধু বৈদেশিক বাণিজ্য খাতে পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনার পরিমাণ ৫০০০ কোটি টাকা। এতে বলা হয়, ১৯৭০ সালের কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে পাকিস্তান সৃষ্টির পর (১৯৪৭) থেকে ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত তৎকালীন পাকিস্তান বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ২৪৪৬ কোটি ১১ লাখ ৮ হাজার টাকা অর্জন করে। অন্যদিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অর্জন করে ২৮৫৮ কোটি ৭২ লাখ টাকা।
এর থেকে দেখা যায়, এ সময় পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পূর্ব পাকিস্তান আমদানি করে ৪১২ কোটি ৯৫ লাখ ৪৬ হাজার টাকা বেশি অর্জন করেছে। অথচ ওই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান আমদানি করে ৪৮৬১ কোটি ৬৩ লাখ ৫ হাজার টাকার পণ্য। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আমদানি করা হয় মাত্র ২৩৩৫ কোটি ৩৯ লাখ ৫১ হাজার টাকার পণ্য। সুতরাং বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমতার ভিত্তিতে হিসাব করা হলে বৈদেশিক বাণিজ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ২৯৩৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া উচিত ছিল। এটা শুধু বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পাওনার পরিমাণ। স্বাধীনতার পর মুদ্রামানের ৬৪ শতাংশ হ্রাসের কারণে ১৯৭৪ সালে সেটা দাঁড়ায় ৫০০০ কোটি টাকা। এ হিসাবের সঙ্গে দুটি দেশের উন্নয়ন-ব্যয়সহ মুক্তিযুদ্ধকালীন ক্ষয়ক্ষতি ধরা হলে পাওনা আরও বেড়ে যায়। (তথ্যসূত্র: দৈনিক বাংলা, ৪ এপ্রিল ১৯৭৪)
ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে শুধু ত্রিমুখী প্রত্যাবাসনকে প্রাধান্য দেওয়ায় শেষত সম্পদ বণ্টন ইস্যুটি আর উত্থাপিত হয়নি। তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পরিষ্কার জানিয়ে দেন যে দুটি দেশের স্বাভাবিক সম্পর্ক অমীমাংসিত বিষয় যেমন বিহারিদের প্রত্যাবাসন ও সম্পদ বণ্টনের ব্যাপারে পাকিস্তানের ইতিবাচক উদ্যোগের ওপরই নির্ভরশীল। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁকে আশ্বাস দেন যে দুটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর এ বিষয় একটি সমাধানে পৌঁছা সম্ভব হবে। তাঁর এই বক্তব্যে ভুট্টোর আসন্ন ঢাকা সফরে এ বিষয়ে মীমাংসায় উপনীত হওয়ার যথেষ্ট ইঙ্গিত ছিল। তবে দৈনিক বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত এই প্রতিবেদনের পর সরকারি ও বেসরকারি মহলে এ বিষয় আলোচনা হতে থাকে।
বাংলাদেশে তখন ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকট চলছিল এবং বাংলাদেশ সরকার তার প্রাপ্য সম্পদের অন্তত কিছু অংশ লাভের মাধ্যমে যেন সংকট থেকে উত্তরণের কথাই ভাবছিল। যদিও এই দাবি তোলা যত সহজ ছিল তার অর্জন ছিল তার চেয়ে বহুগুণে কঠিন। ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসেই পাকিস্তানের কোনো কোনো মহল ও গণমাধ্যম থেকে বাংলাদেশের কাছে পাল্টা সম্পদ দাবি করা হয়। উর্দু পত্রিকা নওয়া-ই-ওয়াক্ত ১৯ এপ্রিল এক প্রতিবেদনে দাবি করে, শুধু বিহারিদের বাংলাদেশে ৫৫০০ কোটি রুপি সম্পদ রয়েছে এবং বাংলাদেশের উচিত পাকিস্তানকে ওই অর্থ ফেরত দেওয়া। (তথ্যসূত্র: POT Pakistan Series, Vol. 11, Part 46, 24 April, 1974, p. 265)
এই প্রতিবেদনের হিসাব থেকে বুঝতে কঠিন হয় না যে বাংলাদেশের ৫০০০ কোটি টাকার দাবির বিপরীতে ৫৫০০ কোটি রুপির পাল্টা দাবির উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের সম্পদ দাবির ভিত্তিকে দুর্বল করা। এ মাসের শেষদিকে অবশ্য পাকিস্তানের পত্রিকাগুলো আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে দাবি করে বাংলাদেশে অবাঙালি ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও বিহারিরা অন্তত ৩০০ মিলিয়ন ডলার সম্পদ ফেলে এসেছে। (তথ্যসূত্র: Economist, 27 April, 1974)
অবশ্য কিসের ভিত্তিতে এই হিসাব করা হয়েছে, তার কোনো উল্লেখ করা হয়নি। মে মাসে পাকিস্তানি ব্যবসায়ী সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তানি ব্যবসায়ী সমিতি’ করাচি স্টক এক্সচেঞ্জ ট্রেডিং হলের এক সভায় অনতিবিলম্বে বাংলাদেশে তাদের ফেলে আসা ৪০০-৫০০ কোটি রুপির সম্পদ উদ্ধারে সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করে। (তথ্যসূত্র: Morning Weekly (Karachi), 19 May 1974)
এপ্রিল মাসে দৈনিক বাংলায় প্রতিবেদন প্রকাশের পর পাকিস্তানের পত্রপত্রিকা ও ব্যবসায়ীদের সম্পদ দাবির অতি-উৎসাহী মনোভাবের পেছনে বাংলাদেশের ন্যায্য দাবিকে দুর্বল করে দেওয়াই যে উদ্দেশ্য ছিল সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়। পাকিস্তানের এই উদ্যোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশ ভুট্টোর ঢাকা সফরকালে ১৯৭৪ সালের জুন মাসে প্রথম আনুষ্ঠানিভাবে সম্পদের হিস্যা দাবি করে। তাঁর সফরের প্রাক্কালে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পরিকল্পনা কমিশন ১৯৭১ সালের পাকিস্তান সরকারের পরিসংখ্যানকেই বিবেচনায় রাখে এবং সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে চারটি নীতি নির্ধারণ করে। এগুলো হলো:
১. জনসংখ্যা নীতি: এই নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ ৫৬ শতাংশ সম্পদ দাবি করতে পারে, ২. সমতার নীতি: এই নীতিতে বাংলাদেশ ৫০ শতাংশ দাবি করতে পারে, ৩. বৈদেশিক মুদ্রানীতি: তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কর্তৃক অর্জিত মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ভিত্তিতে ৫৪ শতাংশ সম্পদের দাবি করতে পারে, ৪. সমগ্র দেশের সম্পদের অনুপাতের নীতি: এই নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ ৪৪ শতাংশ সম্পদ দাবি করতে পারে।