।। হাসান মোরশেদ ।।
এই প্রসঙ্গ খুবই স্পর্শকাতর। যথেষ্ট জানা না থাকলে বলা সমীচীন নয়। মিয়ানমারের রাখাইনে আরাকান আর্মির সাফল্যের প্রেক্ষিতে অনেকেই ‘স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্র’ এবং কথিত ‘স্বাধীন খ্রিষ্টান রাষ্ট্র’কে এক ভাবছেন। প্রকৃত অর্থে এই দুটি আলাদা প্রকল্প। নীচের লেখাটি স্রেফ এই প্রসঙ্গে।
#প্রকল্প এক( স্বাধীন খ্রিষ্টান রাষ্ট্র)#: মিয়ানমারের চিন প্রভিন্স, ভারতের মিজোরাম রাজ্য এবং বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছু জনগোষ্ঠী আছেন যারা নিজেদের একটি নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষ বলে দাবী করেন। এরা বেশ কয়েকটি আলাদা ট্রাইব যেমন মিজো, কুকি, বম, মার, পাইতে, লাই। কিন্তু তাঁদের সম্মিলিত জন পরিচয় ❝জো❞। এঁদের ভাষা তিব্বতি-বার্মা পরিবারের। এঁরা সবাই ধর্মে খ্রিষ্টান।
এঁরা মনে করেন- বৃটিশ কলোনিয়াল ভাগাভাগি তাঁদেরকে তিন রাষ্ট্রে বিচ্ছিন্ন করেছে। ১৯৬৬ সাল থেকে মিজোরামে এরা স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবীতে ভারতের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই শুরু করেছিলেন। পাকিস্তান সরকার এদেরকে সমর্থন করতো। সরকারের সমর্থনে রাঙ্গামাটিতে এদের প্রবাসী সরকারের রাজধানী গঠিত হয়, এখান থেকে তারা সশস্ত্র লড়াই করতো। রাঙ্গামাটির চাকমা আর মিজো আলাদা জনগোষ্ঠী হলেও চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় এঁদের স্থানীয় অভিভাবকের মতো ছিলো। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সশস্ত্র মিজো’রা মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে পাকিস্তান আর্মির সহযোগী হয়। মুক্তিযুদ্ধের চুড়ান্ত পর্যায়ে ভারতীয় জেনারেল উবানের নেতৃত্বে তিব্বতী গেরিলা (এসএফএফ) এবং বাংলাদেশের গেরিলা( বিএলএফ) মিলে পাকিস্তান আর্মি ও মিজো গেরিলাদের উৎখাত করে রাঙ্গামাটিতে বাংলাদেশের পতাকা উড়ায়।
মিয়ানমারের চিন প্রদেশের ‘জো’ রা অনেকদিন থেকে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করছে, মিজোরামে জো’রা প্রাদেশিক ক্ষমতায় আছে, বাংলাদেশে জো’রা সাম্প্রতিক বছরে সশস্ত্র গোপন তৎপরতা শুরু করে। যারা এসব বিষয় খেয়াল রাখেন তারা জানবেন- গত দুবছর থেকে মনিপুরে মৈতেয়ী ও কুকিদের মধ্যে ব্যাপক সংঘাত চলছে। কুকিরা সেখানে সংখ্যালঘু হলেও জো হিসেবে মিজোরাম এবং মিয়ানমারের চিন থেকে তারা ব্যাপক সমর্থন পায়।
এই তিন রাষ্ট্রে ছড়ানো জো জনগোষ্ঠী যারা ধর্মে খ্রিষ্টান তাদের সম্মিলিতভাবে একটি রাষ্ট্র নির্মানের প্রকাশ্য বাসনা আছে। গত সেপ্টেম্বরে মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে এক সেমিনারে বলেছেন- ❝বৃটিশরা জো’দের তিন রাষ্ট্রে ছড়িয়ে দিয়েছে, সুযোগ পেলে তারা ঐক্যবদ্ধ হবেন।❞
শেখ হাসিনা এই খ্রিষ্টান রাষ্ট্র প্রকল্পটির কথা বলেছিলেন।
এখানে সংকট হলো- চিন, মিজোরাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম মিলে যে প্রকল্প তা ল্যান্ডলকড। ল্যান্ডলকড নতুন প্রকল্পে অভিভাবক পরাশক্তিদের খুব লাভ নেই৷ সে ক্ষেত্রে সীমানা আরো নীচে নেমে কক্সবাজার পর্যন্ত আসলে ক্ষতি কী?
প্রশ্ন হতে পারে, এই প্রকল্প বাসনা কতোটুকু বাস্তবসম্মত? আমার ব্যক্তিগত ধারনা এটি সুদুর পরাহত। কারন এখানে ৩টি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব জড়িত। ভারতের জো’রা এখন সশস্ত্র কার্যক্রমে নেই, মিয়ানমারের চিন প্রভিন্সে এবং বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র কার্যক্রম চালু থাকলেও খুব নিয়ন্ত্রনহীন নয়।
তবে, ‘খ্রিষ্টান রাষ্ট্র’ প্রকল্প ধারনাটি চালু আছে। এটি ভিত্তিহীন নয়।
#প্রকল্প দুই(স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্র)#: এটি নিয়ে ইতোমধ্যে অনেকেই অনেক কিছু জানেন। আমার বেশী বলার দরকার নেই। শুধু বলি- আরাকানের রাখাইনরা হচ্ছেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বাংলাদেশের কক্সবাজার ও পটুয়াখালীতে রাখাইন জনগোষ্ঠী আছেন। তবে রাখাইনের সীমান্তবর্তী বান্দরবানের বাংলাদেশী মারমা জনগোষ্ঠীও ভাষা, নৃতাত্বিক ও ধর্মীয় পরিচয়ে রাখাইনদের সাথে সম্পৃক্ত।
এটি ল্যান্ডলকড নয়। বরং চীনের বিনিয়োগে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর, ভারতের অর্থায়নে আরেকটি সমুদ্র বন্দর রয়েছে। মুলত: এই দুটি বন্দর দখলে নিতে পারলেই পুরো রাজ্য আরাকান আর্মির দখলে চলে যায়। নিজেদের বিনিয়োগে নির্মিত বন্দর এবং বন্দর সংশ্লিষ্ট স্বার্থ রক্ষার জন্য ভারত ও চীন পতনোম্মুখ বার্মিজ সামরিক জান্তা নাকি প্রায় ক্ষমতাসীন আরাকান আর্মির সাথে যুক্ত হচ্ছে সেটা লক্ষনীয়। যেমন লক্ষনীয় বাংলাদেশের ভূমিকা। স্বাধীন আরাকান/ রাখাইন রাষ্ট্র এখন দূর ভবিষ্যতের প্রকল্প নয়, এটি অচিরেই বাস্তব হবার সম্ভাবনা প্রকট।।
সচেতন নাগরিক হিসেবে আপাতত: দায়িত্ব হচ্ছে ব্যাপারগুলো সম্পর্কে যতো বেশী সম্ভব জানা, বুঝা। সময় স্থির করবে কর্তব্য।