শনিবার রাত ২টা। একদিন পরই ঈদ। চারিদিকে ঘরমুখো মানুষের বাড়ি ফেরার তাড়া কিন্তু মিরপুর-১২ মেট্রো রেল স্টেশনের নিচে রাস্তার পাশে দরজা খুলে বসে ছিলেন রেন্ট এ কারের চালক হৃদয়! অপেক্ষা করছিলেন যাত্রীর জন্য।ট্রিপ পেলেই ছুঁটবেন গন্তব্যে। তবে এই রাতই যে তার জীবনের শেষ রাত হতে যাচ্ছে তা তিনি বুঝতে পারেননি। এদিকে ঘরে দুই সন্তান নিয়ে অপেক্ষায় থাকা স্ত্রী প্রিয়াও জানতেন না একদিন পরেই স্বামীর লাশ নিতে হবে হাসপাতাল থেকে।
রাজধানীর পল্লবী থানা পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তুচ্ছ ঘটনায় ‘ছিনতাইকারী’ অভিযোগ দিয়ে ব্যাপক মারধর করা হয় হৃদয় মিয়াকে। একপর্যায়ে মামলা না দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ওই থানার এসআই আশরাফুল ৪০ হাজার টাকা দাবি করেন স্ত্রী প্রিয়ার কাছে।এরপর দিনভর নির্যাতন এবং কয়েকবার হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয় হৃদয়কে! এদিকে হৃদয়ের এমন কষ্ট দেখে বাধ্য হয়ে ২০ হাজার টাকা জোগাড় করে পুলিশের হাতে তুলে দেন প্রিয়া!কিন্তু তবুও তিনি ফিরে পাননি তার স্বামীকে! লাশ নিতে হয়েছে হাসপাতালের বারান্দা থেকে।
গত ৫ আগস্টের পর পুলিশের আমুল পরিবর্তন হবে এমনটা আশা করা হলেও বেশ কিছু ঘটনায় দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু কর্মকর্তার কারণে বারবার বিতর্কে জড়াচ্ছে এই বাহিনী। এবার এই ঘটনায় স্ত্রী প্রিয়া তার স্বামীকে হত্যার বিচার চেয়েছেন।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে প্রিয়া জানান, স্টেশনের নিচে বসে থাকার সময় হঠাৎ পেছন থেকে আসা একটা প্রাইভেটকার হৃদয়ের গাড়ির দরজা এবং লুকিং গ্লাসে ধাক্কা দিয়ে সামনে চলে যায়। গাড়ির ক্ষতির বিষয়টি টের পেয়ে তিনিও ওই কারটির পেছনে ধাওয়া করেন। একটু সামনে গিয়ে কারটিকে থামিয়ে তার চালকের সাথে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হন। এসময় হঠাৎ ওই কারটির চালক হৃদয় মিয়াকে ‘ছিনতাইকারী’ আখ্যা দিয়ে চিৎকার শুরু করেন। এরপর আশেপাশের লোকজন চলে আসে। পাশে থাকা সেনাবাহিনীর টহল দলও ঘটনাস্থলে আসে। পরে তারা হৃদয় মিয়ার কারটি তল্লাশি করে নগদ কিছু টাকা ও মোবাইল ফোন জব্দ করে হৃদয়কে নিয়ে যায়। এদিকে স্বামীর সাথে যোগাযোগ করতে তার মুঠোফোনে কল করেন স্ত্রী প্রিয়া। এসময় ফোনটি রিসিভ করে সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা তাকে পল্লবী থানায় আসতে বলেন! কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেড় মাসের শিশুকে প্রতিবেশির কোলে রেখে তখনই তিনি চলে যান পল্লবী থানায়। সেখানে স্বামীকে মেঝেতে কাতরাতে দেখেন তিনি। এরপর ওই সেনা কর্মকর্তা ‘ছিনতাইকারী’ সন্দেহে তার স্বামীকে আটক করে ওই থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়ে সেখান থেকে বিদায় নেন।
স্বামীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে প্রিয়া তখন পুলিশ কর্মকর্তাকে তার স্বামীকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, মামলা না দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে থানার এসআই আশরাফুল ৪০ হাজার টাকা দাবি করেন প্রিয়ার কাছে! এর মাঝে আটক হৃদয়কে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে আবার থানায় এনে নির্যাতন করা হয় বলে প্রিয়া দাবি করেন। অবস্থা কিছুটা খারাপ হলে হৃদয়কে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায় পুলিশ। সেখান থেকেও আবার থানায় আনা হয়!রবিবার দিনভর এসব চলতে থাকে। এর ফাঁকে প্রিয়া ২০ হাজার টাকা জোগাড় করে থানার এসআই আশরাফুলের কাছে দেন। এরপর ঈদের দিন সকালে তার স্বামীকে ছেড়ে দেওয়া হবে আশ্বাস দেওয়া হলে প্রিয়া বাড়ি ফিরে যান। কিন্তু হঠাৎ সোমবার ঈদের ভোররাতে থানা থেকে ফোন করে প্রিয়াকে দ্রুত থানায় আসতে বলা হয়।
প্রিয়া বলেন, থানায় গেলে এসআই আশরাফুল আমার কাছে ২০ হাজার টাকা ফেরত দিয়ে বলেন- ‘আপনার আর্থিক অবস্থা ভালো না!আপনার স্বামী কুর্মিটোলা হাসপাতালে আছে। সেখানে গিয়ে তাকে চিকিৎসা করান।’ এটা শুনে আমি কুর্মিটোলা গিয়ে দেখি আমার স্বামী আর বেঁচে নেই। তার লাশ ফেলে রাখা হয়েছে।
হৃদয়ের গাড়িকে আঘাত করা সেই গাড়ির ড্রাইভারকে ও এসআই আশরাফুলকে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।