।। সাইফুর রহমান মিশু।।
কয়টা সিরিয়াস কথা বলি।মহাজন কি আসলেই দেশ চালাতে পারছে না, নাকি চাইছে না! মহাজনের ভক্তরা এই যে তাকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার কথা বলছে- এটা আদতে মহাজনই তাদের মুখে একথা তুলে দিয়েছে।
শয়তান যখন মেধাবী হয়, কূটবুদ্ধির চূড়ান্ত সে প্রয়োগ করতে পারে। তার আশেপাশের ও ভক্তদের মনে হবে, আহা কী সহজ সরল মানুষ- দিনরাত দেশের জন্য খেটে যাচ্ছে। আসলেই কি তাই?
তার নিজ প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যতীত গত প্রায় নয় মাসে ঠিক কী কাজ সে করেছে? ঠিক কোন সিদ্ধান্তটি তার দেশের উপকারে এসেছে?
একজন মানুষ দেশের জন্য ভাবলে সেটার জন্য ক্ষমতার প্রয়োজন হয় না। মহাজন ক্ষমতা নেয়ার আগে এই দেশের কোন বিপদ, দুর্যোগে তাকে পাওয়া গেছে? ন্যূনতম একটি বিবৃতি সে কখনো দেশের জন্য দিয়েছে?
যে ৭৪-এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে বিনিয়োগ সম্মেলনে কান্নার অভিনয় করলো, সে সময় তার বয়স কত ছিল? কী করেছিল সে সময় দেশের জন্য? এরপর একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ গেছে দেশের উপর দিয়ে- বন্যা, সিডরসহ নানা বিপর্যয়ে মহাজন ঠিক কী উদ্যোগটা নিয়েছিল?
অতীতের কথা বাদ দিলেও গত পৌনে নয় মাসে দেশের যে পরিমাণ শিল্প কারখানা বন্ধ হয়েছে, যে পরিমাণ মানুষ বেকার হয়েছে তারা অভাবের তাড়নায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এই মানুষগুলোর কর্মসংস্থানের জন্য কোন উদ্যোগটা নিয়েছে ও সফল হয়েছে?
নিজের কর মওকুফ, শ্রম আইনে সাজা মওকুফ, সরকারি সর্বোচ্চ পদে বসে নিজ প্রতিষ্ঠানের নামে একের পর এক সুবিধা আদায় করতে কিন্তু সময় নেয়নি। সেসকল সুবিধার তালিকা এতোটাই দীর্ঘ যে তার সরকারের অন্যরাও তাই দুর্নীতির সাথে যুক্ত হয়েছে। সেসবের পরিমাণও এতো বেশি যে কোনভাবেই আর চেপে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
গত জুলাইতে বাংলাদেশের রিজার্ভ যা ছিল, এখনও তা-ই আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেখে নিতে পারেন কারো সন্দেহ হলে। বলা হচ্ছে, বিগত সরকারের রেখে যাওয়া ঋণ পরিশোধ করছে। বিদেশী কোন দাতা সংস্থা ও প্রাপ্য ঋণ যথাসময়ে পরিশোধ না করার রেকর্ড গত ১৫ বছরে নেই। তখন যদি সকল ঋণ যথাসময়ে পরিশোধ না করা হতো তবে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ দিতে সম্মত হতো না।
অথচ, মহাজন ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে ঋণের কিস্তি আটকে যাচ্ছে কেন? কেন বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশ সম্পর্কে ভয়ানক সব নেতিবাচক ভবিষ্যদ্বাণী করছে!
মহাজন কি এসব বুঝে না? এসব সমস্যা সমাধানের অপারগ? মোটেই না। দেশটার অর্থনীতি খুব দ্রুত খারাপ হচ্ছে, ঠিক যেমন মহাজন চাইছে। এতে করে মহাজন ও তার সঙ্গীদের কোন ক্ষতি নেই।
দক্ষিণ এশিয়া, এমনকি পুরো বিশ্বের দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাতারে ছিল বাংলাদেশ গত কয়েক বছর ধরে। কোভিডের পরে, এমনকি ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে পুরো বিশ্ব হিমশিম খাচ্ছিল যখন, বাংলাদেশ তখন ধাক্কা খেলেও সামলে নিয়েছিল। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ এর উপরে। এসব হিসেব নিয়ে কোন সরকার মনগড়া তথ্য দিতে পারে না।
মহাজন যদিও বলেছে, আগের সরকার নাকি এসব বানিয়ে বলতো। বানিয়ে বলে যদি বাংলাদেশের টাকার মান উপরে ধরে রাখা যায়, মহাজনের আমলে সেই মানের এত দ্রুত পতন হচ্ছে কেন!
পাকিস্তান-ভারত সীমান্তের টুকটাক ঝামেলা ব্যতীত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল। বাংলাদেশ কখনো কোনরকম বৈরিতায় জড়ায়নি। সকল জোটের সাথে এক ধরনের ভারসাম্য রক্ষা করে চলছিল, যেটা পছন্দ হয়নি পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের।
সামনের দিনগুলোতে সেটা আর সম্ভব হবে না। মিয়ানমার সীমান্তে যে যুদ্ধ চলছে- সেটাকে বিগত সরকার তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেছে। বর্তমানের মহাজন সরকার সেটা করছে না। আরাকানের জন্য করডোর দিয়ে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। এতে করে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত। এসব কেউ এড়িয়ে যেতে পারে জোর করে চোখ বন্ধ করে রাখলে। সত্যকে অস্বীকার করলেই তা মিথ্যা হয়ে যায় না।
সামনে ভয়াবহ দিন আসছে। এমন দিন যা দেশের বেশিরভাগ মানুষ কল্পনাও করতে পারছে না। একদিকে যুদ্ধ, অপরদিকে ভয়ানক অর্থনৈতিক সংকট। এসবই হচ্ছে পরিকল্পিতভাবেই। ভবিষ্যত কোনদিকে যাচ্ছে তা দেশের মানুষ না বুঝলেও, বিদেশী বিনিয়োগকারী ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো টের পাচ্ছে। সে কারণেই নতুন বিনিয়োগতো আসছেই না, বরং কমিয়ে নিচ্ছে বিনিয়োগ।
গত কিছুদিন যাবত শেয়ার মার্কেটের অবস্থা খুবই নাজুক। রমজানে দ্রব্যমূল্য সরকার ভর্তুকি দিয়ে ও জোর করে কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে কিনে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। যার ফলাফল কৃষকরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে বলেও জানা গেছে। শীতকালীন সবজির একটা সুবিধাও পেয়েছিল সরকার।
এখন আবার দাম বেড়ে চলেছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা নিজেই স্বীকার করেছে চালের দাম আরও বৃদ্ধি পাবে। লিটার প্রতি ভোজ্য তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, পিঁয়াজসহ সবকিছুর মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে।
যে ফাঁপা সফলতার গল্প প্রচার করা হচ্ছে, বাস্তবতার সাথে তার দূরত্ব অনেক। যে বা যারা নিয়মিত বাজার করে তাদের কাছ থেকে খবর নিলে জানা যায়, যে বাঙালি মাছ মাংশ খাওয়ার স্বাধীনতা খুঁজেছে বছরখানেক আগে, তারা এখন শুধুমাত্র চাল কিনতেই হিমশিম খায়।
বলছি না এই মুহূর্তে মহাজন ক্ষমতা ছেড়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তরুণ প্রজন্মকে যে সন্ত্রাসের স্বাদ দিয়েছে মহাজন, বাংলাদেশের কয়েকটি প্রজন্ম স্রেফ নষ্ট হয়ে গেছে। অন্য সবকিছু ধীরে ধীরে সংশোধন করা গেলেও, এই যে প্রজন্মের অন্ধকার যাত্রা- সেটাকে সংশোধন করা সম্ভব হবে না কয়েক দশকে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলার মেধাবী প্রজন্মকে হত্যা করা হয়েছিল কেন? একটা জাতিকে কয়েক দশক পিছিয়ে দেয়া যায় এভাবে। এবার মগজ হত্যা করা হলো কিশোর থেকে তরুণদের। এরা দেশের জন্য ভালো কিছু করতে পারবে না আর। এর দায় কি মহাজনের একার? না। মহাজনের প্রতি ভালোবাসায় হাবুডুবু খাওয়া প্রত্যেকেই এর জন্য দায়ী।
সেই জুলাই থেকে একটা কথাই বারবার বলেছি- ক্ষতিটা দেশের, ক্ষতিটা আমাদের জাতির। এ খেলায় কতিপয় ব্যক্তি লাভবান হচ্ছে কেবল। সামষ্টিকভাবে মূল্যায়ন করলে অনেক যুগ পিছিয়ে পড়ছে দেশটা প্রতিদিন অতি দ্রুত গতিতে।
ব্লগার ও প্রযুক্তিবিদ