স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার স্কুল শিক্ষক পিতা মো. বিল্লাল হোসেন ঠিকাদারি লাইসেন্স করেছেন। পুত্র যে মন্ত্রণালয়য়ের উপদেষ্টা সেই মন্ত্রণালয়ের অধীন একটা অধিদপ্তরের লাইসেন্স করেন পিতা। ঘটনার মাসাধিক কাল পর সেটা প্রকাশ হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি হলে পিতার অন্যায্য কাজকে অন্যের পরামর্শ অথবা প্ররোচনা ব্যাখ্যা দিয়ে সেই অপরাধকে কবুল করেছেন উপদেষ্টাপুত্র। এরপর তিনি ক্ষমা চেয়েছেন ফেসবুকে, এবং জানিয়েছেন এরইমধ্যে ঠিকাদারি লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।
আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায়। সেখানকার আকুবপুর ইয়াকুব আলী ভুঁইয়া পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তার বাবা মো. বিল্লাল হোসেন। তিনি গত ১৬ মার্চ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর কুমিল্লা থেকে ঠিকাদারির লাইসেন্স নেন। আলোচিত-সমালোচিত ইউটিউবার জুলকারনাইন সায়ের লাইসেন্সের ছবিসহ তথ্য ফেসবুকে দেওয়ার পর সেটা মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যাওয়ার পর এনিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না এলজিআরডি উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের।
মঙ্গলবার (২৪শে এপ্রিল) বেলা সাড়ে ১১টার পর আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া লাইসেন্সের তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘প্রথমেই আমার বাবার ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। গতকাল রাত ৯টার দিকে একজন সাংবাদিক কল দিয়ে আমার বাবার নামে ইস্যুকৃত ঠিকাদারি লাইসেন্সের বিষয়ে জানতে চাইলেন। বাবার সাথে কথা বলে নিশ্চিত হলাম তিনি জেলা পর্যায়ের (জেলা নির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার এর কার্যালয় থেকে ইস্যুকৃত) একটি লাইসেন্স করেছেন। বিষয়টি উক্ত সাংবাদিককে নিশ্চিত করলাম। তিনি পোস্ট করলেন, নিউজও হলো গণমাধ্যমে। নানা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে তাই ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজনবোধ করলাম।’
আসিফ মাহমুদ লেখেন, ‘আমার বাবা একজন স্কুল শিক্ষক। আকুবপুর ইয়াকুব আলী ভুঁইয়া পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। স্থানীয় একজন ঠিকাদার কাজ পাওয়ার সুবিধার্থে বাবার পরিচয় ব্যবহার করার জন্য বাবাকে লাইসেন্স করার পরামর্শ দেন। বাবাও তার কথায় জেলা নির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার থেকে একটি ঠিকাদারি লাইসেন্স করেন। রাষ্ট্রের যেকোনো ব্যক্তি ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে যেকোনো লাইসেন্স করতেই পারে। তবে আমি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বরত থাকা অবস্থায় বাবার ঠিকাদারি ব্যবসায় জড়ানো স্পষ্টভাবেই কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট। বিষয়টি বোঝানোর পর আজ বাবার আবেদনের প্রেক্ষিতে লাইসেন্সটি বাতিল করা হয়েছে। বাবা হয়তো কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের বিষয়টি বুঝতে পারেননি, সেজন্য বাবার পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। উল্লেখ্য, মধ্যবর্তী সময়ে উক্ত লাইসেন্স ব্যবহার করে কোন কাজের জন্য আবেদন করা হয়নি।’
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের এই স্বীকারোক্তি কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রথমত উপদেষ্টা লিখেছেন: ‘স্থানীয় একজন ঠিকাদার কাজ পাওয়ার সুবিধার্থে বাবার পরিচয় ব্যবহার করার জন্য বাবাকে লাইসেন্স করার পরামর্শ দেন। বাবাও তার কথায় জেলা নির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার থেকে একটি ঠিকাদারি লাইসেন্স করেন।’ অর্থাৎ তিনি স্বীকার করেছেন, তার বাবা অন্য একজনকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার সুবিধার্থে নাম ব্যবহার করেছেন। এটা স্পষ্টত ক্ষমতার অপব্যবহার।
এদিকে, একই বিষয়ে আসিফ মাহমুদ দাবি করেছেন, তার বাবা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বুঝেননি। পরে তাকে বুঝানোর পর তিনি লাইসেন্স বাতিলের আবেদন করেছেন। এবং লাইসেন্স বাতিল হয়েছে।
একটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বুঝেন না, এটা কি সত্যি বিশ্বাসযোগ্য?
একটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাজ পাওয়ার সুবিধার্থে অন্যের জন্যে লাইসেন্স করেছেন, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? আর অন্যের জন্যে লাইসেন্স করলে এখানে কি অর্থের লেনদেন জড়িত থাকবে না? অন্যকে কাজ পাইয়ে দেওয়া এখানে নিশ্চয় স্বেচ্ছাসেবা নয়। এখানে যে অর্থের লেনদেনের পথ উন্মুক্ত হলো, সেটা কি সঠিক পন্থা? সেটা কি দুর্নীতিচেষ্টা নয়?
আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া নিজেই স্বীকার করেছেন তিনি দায়িত্বে থাকা পর্যন্ত তার বাবা ব্যবসায় জড়ানো কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট। তিনি ক্ষমা চেয়েছেন। তবে ক্ষমা চাইতে গিয়ে অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এরআগে তার সহকারী একান্ত সচিব মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বিপুল দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার তথ্য আসে সামাজিক মাধ্যমে। এরপর তার অব্যাহতি নিয়ে নানা আলোচনা শুরু করলে এটা অপসারণ না পদত্যাগ ইস্যুতে তিনি সাবেক সহকারীর ফেসবুক পোস্টও সেয়ার করেন।
এই কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট কেবল আমরা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার ক্ষেত্রেই দেখছি এমন না; অন্যদের ক্ষেত্রেও দেখছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পর মামলা নিয়ে, কর মওকুফ নিয়ে, ইউনূস সেন্টারের কর্মরতদের সরকারি দায়িত্ব দেওয়া, গ্রামীণ ট্রাস্টের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়ে সরকার যা করছে, সেগুলোও কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের পর্যায়ে কি পড়ে না? এছাড়াও প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে বিভিন্ন উপদেষ্টার বিদেশ সফরে পারিবারের সদস্য থেকে শুরু করে নিজেদের লোকদের প্রতিষ্ঠানের লোকদের সফরসঙ্গী করা কি কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট নয়?
গত বছরের জুলাই-আগস্ট অস্থিরতায় ক্ষমতার যে পরিবর্তনে যে অন্তর্বর্তী সরকার বর্তমানে ক্রিয়াশীল তাদের একটা উল্লেখযোগ্য স্লোগান হচ্ছে–সংস্কার। কিন্তু সংস্কারের নামে যেভাবে রাষ্ট্রীয় নিয়ম-রীতিনীতির অবজ্ঞা ও অগ্রাহ্য করা হচ্ছে, তাতে উদ্বেগে দেশবাসী।
সরকার আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না, ঊর্ধ্বমুখী নিত্যপণ্যের বাজার, বন্ধ বিদেশি বিনিয়োগ, স্থবির অর্থনীতি; এমন অবস্থায় দুর্নীতিমুক্ত হয়ে যেখানে দেশ পরিচালনার চেষ্টা করা উচিত ছিল, সেখানে উপদেষ্টা থেকে তাদের পরিবারগুলো বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে। নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতার মধ্যে দেশের গণমাধ্যমগুলো থাকার কারণে সব খবর সামনে আসছে না, তবে সামাজিক মাধ্যমের সূত্রে যা আসছে সেটা ভয়াবহ ও সর্বনাশা ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবহ। এ-থেকে পরিত্রাণ জরুরি।২৪শে এপ্রিল ২০২৫