বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন বারবারই সময়ের প্রয়োজনে সমাজে পরিবর্তনের বার্তা বয়ে এনেছে। কিন্তু ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র (বৈছা) আন্দোলন’- এর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড যেন সেই ঐতিহাসিক ধারার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র তুলে ধরছে। আন্দোলনের পর শিক্ষার্থীরা এখন রাষ্ট্রকে গিলে খাচ্ছে দুর্নীতির মাধ্যমে। যার করালগ্রাস থেকে রেহাই মেলেনি ধুঁকতে থাকা রেলওয়েও।রেলওয়ের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈছা নেতা ও সমন্বয়কদের প্রভাব বিস্তার, অনৈতিক সুবিধা আদায় এবং দুর্নীতির নানা অভিযোগ উঠে এসেছে।
সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবীর মিলনের ফেসবুক পোস্টে একটি বিস্ফোরক তথ্য প্রকাশ্যে আসে। তার অভিযোগ— বৈছার তিন সদস্য ও রাজউক কলেজের এক শিক্ষার্থী মিলে রেলওয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এমনকি রেলের ইঞ্জিন ডিজাইন, সক্ষমতা ও নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও তাদের ‘পরামর্শ’ নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি যেমন অবিশ্বাস্য, তেমনি গভীর উদ্বেগজনক।
এই চারজনের অন্যতম মো. আশিকুর রহমান, নিজেকে বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে রেলের বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করে আসছেন। অথচ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ওই শিক্ষাবর্ষে তার নাম নেই মেধা তালিকায়, অপেক্ষমাণ তালিকায়ও না। পরে যোগাযোগ করা হলে আশিক এক পর্যায়ে স্বীকার করেন, তিনি বর্তমানে কোথাও পড়াশোনা করছেন না এবং মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির নাম ব্যবহার করে ‘সুবিধা’ নিয়েছেন।
সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্য হলো, এই ভুয়া পরিচয়ে আশিক ও তার সহযোগীরা রেল মন্ত্রণালয় থেকে দুই মাস মেয়াদি ফ্রি পাস সংগ্রহ করেন, যার মাধ্যমে এসি বার্থ ও স্নিগ্ধা ক্লাসে প্রায় ২ লাখ টাকার টিকিট ভোগ করেন। আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো, তাদের মধ্যে কেউ কেউ একই দিনে ভিন্ন ভিন্ন গন্তব্যের টিকিট সংগ্রহ করেছেন— যা বাস্তবসম্মত নয়। এ থেকে সন্দেহ জোরালো হচ্ছে যে, তারা টিকিট কালোবাজারিতে জড়িয়ে পড়েছেন।
রেলওয়ের বিভিন্ন সভা, পরিদর্শন এবং এমনকি জমি উদ্ধারের মতো গুরুতর বিষয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছেন এই ব্যক্তিরা।
আশিকের দাবি অনুযায়ী, এসব কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য তারা নিজেরা খরচ চালাতে না পারায় রেল উপদেষ্টার মাধ্যমে পাস নিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—একটি সাংগঠনিক পরিচয়ে, তা-ও একটি অবৈধ পরিচয়ের ভিত্তিতে কীভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তারা পেলেন?
তদন্তে আরও বেরিয়ে আসে, ‘জুলাই ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে তারা রেলস্টেশনে দোকান বরাদ্দ চেয়েছেন, এমনকি প্রাইভেট ট্রেন পরিচালনার অনুমতির জন্য প্রস্তাবও দিয়েছেন। এসব কর্মকাণ্ডের পেছনে কারা রয়েছেন, তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে কে, সে প্রশ্ন এখন উঠছে প্রশাসনের ভেতরেও।
সাম্প্রতিক সময়ে ফাঁস হওয়া একটি অডিও ক্লিপে রেলের বদলি বাণিজ্যের সঙ্গে বৈছা নেতাদের নামও জড়িয়েছে। এতে করে স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে গড়ে ওঠা এই গোষ্ঠী কোনোভাবে ছাত্রস্বার্থ বা বৈষম্য বিরোধিতা নয়, বরং প্রভাব ও সুবিধা আদায়ের এক বিকল্প ক্ষমতার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলেছে।
বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। তারা বলছেন, “এভাবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ভাঙিয়ে কেউ যদি সুবিধা নেয়, সেটা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি। চাকরি বাজারে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে।”
এই কেলেঙ্কারির পর প্রশ্ন উঠেছে— রেল মন্ত্রণালয় কীভাবে এমন একটি গোষ্ঠীকে পাস ইস্যু করলো, কী ছিল যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া? দায়ী কর্মকর্তারা কি অবহেলা করেছেন, নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে ছায়া-গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগসাজশে এমন সুবিধা দিয়েছেন?