২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ভয়াবহ মোড় নেওয়া দিন। বিদেশি শক্তি ও দেশীয় জেহাদি গোষ্ঠীর সহায়তায় একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে সরিয়ে মোহাম্মদ ইউনুসকে সামনে রেখে একটি এনজিওপন্থী, সুদনির্ভর প্রশাসন জোর করে গঠন করা হয়। তার পর থেকে দেশের অর্থনীতি একটি দুর্বল, ভঙ্গুর কাঠামোয় রূপ নিতে শুরু করে। সেই পতনের সবচেয়ে দৃশ্যমান লক্ষণগুলোই এখন দেশের সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ছাপা হচ্ছে।
যেমন একটি শিরোনাম বলছে, “সংকুচিত হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি।” এই সংকোচন কেবল অর্থনৈতিক চক্রের স্বাভাবিক ওঠানামা নয়, বরং এটি স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ফল। ক্ষমতা দখলের পর থেকে সরকার যে হারে ব্যয়বহুল ও ত্রুটিপূর্ণ মেগা প্রকল্প চালু করেছে এবং উৎপাদন ও কৃষি খাতকে অবহেলা করেছে, তাতে প্রবৃদ্ধির জায়গায় এখন স্থবিরতা এসে দাঁড়িয়েছে। দেশের রপ্তানি কমছে, আমদানি খরচ বেড়ে গেছে, আর মুদ্রাস্ফীতি লাগামছাড়া।
আরেকটি হেডলাইন—“শিল্পের গ্যাস যাচ্ছে বিদ্যুতে : কারখানায় উৎপাদনে ধ্বস।” শিল্প খাত, বিশেষত তৈরি পোশাক, চামড়া, সিরামিক ও ওষুধ শিল্প যেগুলো দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, সেগুলোর গ্যাস সংযোগ কেটে তা বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়তো সাময়িকভাবে বাড়ছে, কিন্তু সেই বিদ্যুৎ গ্রাহকদের কাছে পৌঁছচ্ছে না, আর শিল্প কারখানাগুলো কর্মঘণ্টা কমিয়ে দিচ্ছে, ছাঁটাই বাড়ছে। এটি কেবল অব্যবস্থাপনা নয়—অনেকেই মনে করছেন, এটি এক পরিকল্পিত নীতিগত হামলা, যাতে দেশের উৎপাদন বন্ধ হয়ে আমদানিনির্ভরতা তৈরি হয়।
অন্যদিকে “দক্ষিণ এশিয়ার খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন বাংলাদেশেই বেশী”—এই সংবাদ এক গভীর রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ। যেখানে ভারত, নেপাল, এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত পাকিস্তানেও খাদ্যদ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে চাল, ডাল, তেল, ডিম—সবকিছুই মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এর পেছনে কেবল আন্তর্জাতিক বাজার দায়ী নয়; বরং সরকারপন্থী সিন্ডিকেট, গুদামজাত মজুতদারদের প্রশ্রয় এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ ব্যর্থতা এই দুর্দশার মূল কারণ। অথচ এই সরকার “ডাটাভিত্তিক প্রশাসন” নাম দিয়ে দিন কাটাচ্ছে, বাস্তব বাজারে তারা একেবারেই অনুপস্থিত।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক হেডলাইনটি হলো—“গ্যাস সংকটে শিল্প উৎপাদনে ধ্বস।” এটি কেবল একটি খাতের ব্যর্থতা নয়, বরং দেশের ভবিষ্যতের ওপর সরাসরি আঘাত। শ্রমিকরা কাজ হারাচ্ছেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা দেউলিয়া হচ্ছেন, ব্যাংক খাতে ঋণ খেলাপির হার বাড়ছে। এই চিত্রের পেছনে রাজনৈতিক ব্যর্থতা অনস্বীকার্য, কারণ এক অগণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিতাহীন সরকার জনস্বার্থ নয়, বরং বিদেশি ঋণদাতা, এনজিও এবং করপোরেট স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্র চালাচ্ছে।
এই শিরোনামগুলোর মাঝে একটিই লাল সুতা—ব্যবস্থাপনার সর্বগ্রাসী ব্যর্থতা, যার শিকড় পোঁতা ৫ আগস্টের ক্যুতে। জনগণের হাতে নির্বাচনের অধিকার না থাকা, রাষ্ট্রের সম্পদ বিদেশি স্বার্থে বন্ধক রাখা, আর অভ্যন্তরীণ মৌলবাদী গোষ্ঠীর ছায়া সরকারে উপস্থিতি—এই সব মিলেই তৈরি করেছে এক বিধ্বস্ত বাংলাদেশ। সংবাদপত্রে প্রতিদিন যে খবর আসে, তা যেন দেশের বাস্তবতার কষ্টকর দলিল হয়ে উঠেছে। এবং প্রতিটি হেডলাইনই ধ্বনিত করছে—এই সরকার বাংলাদেশের নয়, এটি ক্ষমতা-আকুল, জনগণবিচ্ছিন্ন এক ‘অর্থনৈতিক দখলদারিত্বের প্রকল্প’।
এই শিরোনামগুলো কেবল সংবাদপত্রের এক দিনের ছবি নয়; এগুলো এক গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অপরাধের দলিল। এই সংবাদগুলো বাংলাদেশের জনমানসের কষ্ট, দেশের উৎপাদন কাঠামোর পতন, এবং রাষ্ট্রের গভীরতর দুর্বলতার প্রতিফলন। প্রতিটি শিরোনামের পেছনে লুকিয়ে আছে ৫ আগস্টের সেই কালরাত্রির ছায়া—যেদিন জনগণের ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিলো।
দেশের অর্থনীতিকে পরিকল্পিতভাবে সংকুচিত করা হয়েছে, শিল্পকে নিঃশেষ করা হয়েছে, এবং খাদ্যনিরাপত্তা ও বাজারব্যবস্থাকে তুলে দেওয়া হয়েছে সিন্ডিকেট আর আন্তর্জাতিক দাতাদের হাতে। রাষ্ট্রের সম্পদ যেমন গ্যাস ও বিদ্যুৎ এখন ‘পলিসি এক্সপেরিমেন্ট’ এর পরীক্ষাগারে আটকে আছে, যেখানে জনগণ গিনিপিগ মাত্র।
সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হলো, এই সরকার জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে অবস্থান করছে। নির্বাচনের কোনো মানে নেই, সংসদ কণ্ঠনিরোধে পরিণত, বিচারব্যবস্থা ব্যবস্থাপনার এক্সটেনশনে রূপান্তরিত, আর মিডিয়া ধীরে ধীরে এক আত্মরক্ষামূলক নীরবতা বেছে নিচ্ছে।
বাংলাদেশ আজ এক গভীর অস্তিত্ব সংকটে। আমরা কি এই সংকটকে চুপচাপ মেনে নেব? নাকি ইতিহাসের দায় কাঁধে তুলে, এই দখলদার ও জনবিচ্ছিন্ন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সত্য বলার সাহস করব?
কারণ ইতিহাসের আদালতে নিরব থাকাও এক ধরনের অপরাধ। আর জনগণের অধিকার কেড়ে নেওয়া শাসনের বৈধতা দিতে থাকলে, একদিন আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না—না গণতন্ত্র, না অর্থনীতি, না বাংলাদেশ।