চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) প্রথম আট মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতির জন্য খোলা ঋণপত্রের (এলসি) পরিমাণ ৩০ শতাংশ কমে গেছে। একই সময়ে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিও ৬ দশমিক ৮২ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
দেশে নতুন বিনিয়োগ প্রায় স্থবির হয়ে আছেন। বিনিয়োগের অন্যতম উপাদান মূলধনী যন্ত্রপাতি। গত তিন অর্থবছর ধরে এর আমদানি কমছে। তাতে অনুমান করা যায়, এর ফলে নতুন শিল্প স্থাপন এবং কর্মসংস্থান কম হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) প্রথম আট মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতির জন্য খোলা ঋণপত্রের (এলসি) পরিমাণ ৩০ শতাংশ কমে গেছে। একই সময়ে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিও ৬ দশমিক ৮২ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
উদ্যোক্তাদের মতে, এ ধরনের অবস্থা দেশের অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক। শিল্প খাতের অগ্রগতির জন্য মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানির তথ্য গুরুত্বপূর্ণ সূচক। কিন্তু গত তিন বছর ধরে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমে যাওয়ার ফলে শিল্প স্থাপন ও সম্প্রসারণও ধীরে এগুচ্ছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসি খোলার পরিমাণ ছিল প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু চলতি অর্থবছরে তা কমে ১ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য খোলা এলসি ছিল মাত্র ১১৫ কোটি ৩৯ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১৬৫ কোটি ডলারের ওপরে।
এর মানে, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ গত এক বছরে ৩০ শতাংশ কমে গেছে।
কমছে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি- বিনিয়োগ কমায় দেশের বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে নিচে নেমে এসেছে। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেসরকারি খাতের খাণ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ, যা ২০০৪ সালের পর সবচেয়ে কম। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যেকোনো শিল্প স্থাপনের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি দরকার হয়। আর বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা এ ধরনের যন্ত্রপাতি আমদানি করেন। আমদানি কমে যাওয়ায় বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির হারও ৭ শতাংশের নিচে নেমে গেছে।
কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে- বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে দেশের শ্রমশক্তির ৪ শতাংশ চাকরি হারিয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মজুরি বৃদ্ধি না পেয়ে স্বল্প দক্ষশ্রমিকদের মজুরি ২ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে ভালো দক্ষ কর্মীদের মজুরি ০.৫ শতাংশ কমেছে। এর ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষ নতুন চাকরি পাচ্ছেন না এবং বর্তমান চাকরি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, গত দুই বছরে প্রতি পাঁচটি পরিবারের মধ্যে অন্তত তিনটি পরিবার সঞ্চয় ভেঙে জীবিকা নির্বাহ করেছে। এর মধ্যে রেমিট্যান্স আসা পরিবারগুলো কিছুটা সুরক্ষিত ছিল। তবে, সবচেয়ে ভাবনার বিষয় হলো, এ পরিস্থিতিতে ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে চরম দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে।
সংকটের কারণ- বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, দেশের ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার। অর্থাৎ ব্যাংক ঋণের সুদহার প্রায় ১৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা।
দ্বিতীয়ত, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা অস্থির, যার কারণে উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না।
তৃতীয়ত, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে ডলার সংকট এবং মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করেছে।
ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, এখনো দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল নয়। অনেক ব্যবসায়ী সুদহার বৃদ্ধির কারণে বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়েছেন। তবে জ্বালানির সংকটও বড় বাধা হয়ে আছে বিনিয়োগের জন্য।
অর্থনীতির এই সংকটের মধ্যেও কিছু ইতিবাচক খবরও আছে। বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে, যা ডলার সংকট কিছুটা কমেছে। সরকারের আমদানি নীতি কিছুটা উদার করা হয়েছে, এবং আশার কথা হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা কিছুটা কমেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনীতির সঠিক সংস্কার এবং সুষম বিনিয়োগের মাধ্যমে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব।
ইত্তেফাক/টিএইচ