দেশজুড়ে তীব্র গ্যাস সংকটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে দেশের শিল্পখাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক ও বস্ত্রশিল্প। চাহিদার তুলনায় গ্যাস সরবরাহ ৪০ শতাংশ কম। এতে কলকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, অনেক শ্রমিক কাজ না পেয়ে অলস সময় কাটাচ্ছেন। রাজধানী ঢাকাসহ গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া ও ভালুকার শিল্পাঞ্চলগুলোতে একই পরিস্থিতি।
দিনে গ্যাস না মেলায় কারখানা চালাতে হচ্ছে রাতের বেলায়, এতে বাড়ছে উৎপাদন ব্যয় ও শ্রমিক মজুরি। অনেক উদ্যোক্তা বিকল্প জ্বালানি হিসেবে সিএনজি, এলপিজি ও ডিজেল ব্যবহার করছেন, যার ফলে খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ। শুধু নারায়ণগঞ্জেই গত আট মাসে ১৯টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে, রপ্তানি আয়েও পড়েছে বড় ধাক্কা। এপ্রিল মাসে মার্চের তুলনায় আয় কমেছে প্রায় ১২৩ কোটি ডলার।
দেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট হলেও সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ২৭২ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে আসছে ১৮৮ কোটি ঘনফুট, যা এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। আমদানি করা এলএনজি দিয়ে ঘাটতি পূরণের চেষ্টা হলেও ডলার সংকট ও অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে সেটিও পর্যাপ্ত নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্যাস অনুসন্ধানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিয়ে সরকার এলএনজিনির্ভরতা বাড়িয়েছে। দিনে ১১০ কোটি ঘনফুটের বেশি এলএনজি সরবরাহ করাও সম্ভব নয়।
কারখানা বন্ধ, উৎপাদন অর্ধেকে, শ্রমিক বেকার
নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, আশুলিয়া, সাভারসহ বিভিন্ন অঞ্চলের শত শত কারখানায় উৎপাদন কমে অর্ধেকে নেমেছে। গ্যাস সংকটে ঝুঁকিতে পড়েছে ঈদের বেতন-বোনাস পরিশোধ, সৃষ্টি হচ্ছে শ্রমিক অসন্তোষের আশঙ্কা।
বড় শিল্পগোষ্ঠী যেমন নোমান গ্রুপ, লিটল গ্রুপ, সাদমা ফ্যাশন, রহমান নিট, চৈতি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান গ্যাস ঘাটতির কারণে উৎপাদন বন্ধ বা সীমিত করছে। গাজীপুরের এক হাজারের বেশি কারখানায় উৎপাদন অর্ধেক কমেছে। সাভার-আশুলিয়ার বহু কারখানায় ডিজেলে চললেও লাভ হচ্ছে না।
সিরামিক ও খাদ্য শিল্পখাতেও গ্যাস সংকটের প্রভাব পড়েছে। মুন্নু সিরামিক, প্রাণ-আরএফএলসহ বহু প্রতিষ্ঠান গ্যাসের অভাবে উৎপাদন টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। এতে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, হুমকিতে পড়ছে বাজার প্রতিযোগিতা।
গ্যাস সংকটের কারণে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সংযোগ প্রায় বন্ধ। পুরনো সংযোগেও লোড বাড়ানো হচ্ছে না। বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে, কর্মসংস্থান বাড়ছে না বরং বাড়ছে বেকারত্ব। তিতাসসহ অন্যান্য গ্যাস কোম্পানিতে জমা পড়েছে এক হাজারের বেশি নতুন সংযোগের আবেদন।
উদ্যোক্তাদের প্রস্তাব ও সরকারের অবস্থান
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানিয়েছেন, শিল্প মালিকরা নিজেদের অর্থে একটি এলএনজি জাহাজ আনতে প্রস্তুত, শুধু সরকারের অনুমোদন দরকার। তবে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, সংকট মোকাবেলায় শিল্প মালিকদের সঙ্গে আলোচনা হবে এবং পরিস্থিতির উন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। গ্যাস সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা কমানোর চেষ্টা চলছে।