।।অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত।।
বাংলাদেশ আজ একটি গভীর রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর শাহবাগে অনুষ্ঠিত এনসিপি’র ডাকা ব্লকেড কর্মসূচি নতুন করে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এই কর্মসূচিতে যেভাবে স্বাধীনতাবিরোধী এবং উগ্র ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো প্রকাশ্যে অংশগ্রহণ করেছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে—এটি কোনো বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক ঘটনা নয়, বরং একটি সুপরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ অপতৎপরতার ফল।
এই কর্মসূচির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, এটি কেবল জামাতে ইসলামীর মতো ঐতিহাসিকভাবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক সক্রিয়তা নয়, বরং এতে জড়িত রয়েছে ইসলামি ছাত্র শিবির, হেফাজতে ইসলাম, হিযবুত তাহরীর, আনসারউল্লাহ বাংলা টিম এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে পরিচিত লস্কর-ই-তৈয়বার বাংলাদেশ শাখাও। এরা একত্রে ঘোষণা দিয়েছে— আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করা হলে তারা ঢাকা শহর বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এরচেয়ে উদ্বেগজনক সত্য হলো, এই হুমকিমূলক সমাবেশগুলো অনুষ্ঠিত হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চোখের সামনেই, পুলিশের উপস্থিতিতে, প্রশাসনের কার্যত নীরবতার মধ্যে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই আন্দোলনের পিছনে রয়েছে বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য। বিশেষ করে, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে পরিচালিত এই অনির্বাচিত সরকারের উপর সন্দেহের তীর নির্দেশ করছে বিভিন্ন মহল। মনে করা হচ্ছে, তারা একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন এড়িয়ে, মৌলবাদী গোষ্ঠীর শক্তিকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকার বা আরও দীর্ঘ সময় দখলে রাখার কৌশল বাস্তবায়ন করছে।
শাহবাগে মৌলবাদীদের মুখে যেভাবে শোনা গেল—“গোলাম আযমের বাংলায় আওয়ামী লীগের স্থান নেই, নিজামীর বাংলায় আওয়ামী লীগের স্থান নেই”—তাতে ইতিহাস যেন পুনরায় ফিরে আসার ভয় দেখাচ্ছে। এটি নিছক একটি রাজনৈতিক স্লোগান নয়, বরং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতাকারী শক্তির নতুন মোড়কে প্রত্যাবর্তনের বার্তা। একাত্তরের ঘাতকের উত্তরসুরিরা যেন নতুন ছদ্মবেশে আবারও আত্মপ্রকাশ করছে, আর এবার তাদের সহযাত্রী হিসেবে রয়েছে একটি কথিত নিরপেক্ষ সরকার, যারা আসলে ক্ষমতায় থাকার বিকল্প পথ খুঁজছে।
এখানে প্রশ্ন উঠে, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের এই নীরবতা কি ব্যর্থতা, নাকি পরিকল্পিত সহানুভূতি? রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে এমন একটি উগ্র মৌলবাদী সমাবেশ কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই দিনের পর দিন চলতে পারে, শুধুমাত্র তখনই সম্ভব যখন উপর থেকে একটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়—“চলতে দাও”।
বিষয়টি এখানেই শেষ নয়। এই মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো ইতোমধ্যেই অতীতে ব্লগার হত্যা, বিদেশি নাগরিক হত্যা, লেখক নিধন ও বিভিন্ন জঙ্গি হামলার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল। এখন তাদের একত্রিত হওয়ার ঘটনা একটি বৃহৎ ষড়যন্ত্রেরই ইঙ্গিত দেয়—যেখানে বাংলাদেশের প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী শক্তিকে নির্মূল করে একটি নতুন, ভয়ঙ্কর, মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে।
বাংলাদেশের জনগণ বহু রক্ত, আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আজ সেই ইতিহাসকে মুছে দিয়ে যারা “গোলাম আযমের বাংলা” গড়তে চায়, তারা আসলে এই দেশের অস্তিত্বের শত্রু। তারা একদিকে ধর্মকে ব্যবহার করে জনমানসে বিভ্রান্তি ছড়ায়, অন্যদিকে ক্ষমতার অলিন্দে জায়গা করে নিতে চায় অনির্বাচিত ও অবৈধ পথে। দেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সামাজিক সম্প্রীতির স্বার্থে এই অপচেষ্টা প্রতিহত করা আজ সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি।
যদি এখনই প্রতিরোধ না আসে, তাহলে আমরা দেখতে পাবো—প্রগতিশীলতার নামোচ্চারণ করা অপরাধ হয়ে দাঁড়াবে, সংবিধানের পক্ষে কথা বলাকে রাষ্ট্রদ্রোহ বলা হবে এবং গণতন্ত্র একটি স্মৃতি হয়ে থাকবে কেবল ইতিহাসের পাতায়।
লেখক: বাংলাদেশি মানবাধিকার আইনজীবী এবং ২০২৩ সালে ফ্রান্স সরকারের ম্যারিয়ান ইনিশিয়েটিভ ফর হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার্স পুরস্কারপ্রাপ্ত। বর্তমানে জাস্টিসমেকার্স বাংলাদেশ ইন ফ্রান্স (জেএমবিএফ) এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।