ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় জারি করা এই নিষেধাজ্ঞাকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর শঙ্কা তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগ এই পদক্ষেপকে “অবৈধ” ও “অসাংবিধানিক” বলে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নিরপেক্ষ নির্বাচন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানানো হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এই নিষেধাজ্ঞাকে বাংলাদেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ এই সিদ্ধান্তকে “বিভেদ সৃষ্টিকারী” এবং “গণতান্ত্রিক নীতির উপর আঘাত” বলে অভিহিত করেছে, যা সমাজে বিভক্তি বাড়াচ্ছে এবং ভিন্নমত দমন করছে।
আল জাজিরা প্রতিবেদন করেছে, ‘হাজার হাজার’ বিক্ষোভকারী, যার মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকরা ছিল, নিষেধাজ্ঞার দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল, যা সরকারের এই পদক্ষেপকে ত্বরান্বিত করেছে।
দ্য গার্ডিয়ান উল্লেখ করেছে, এই নিষেধাজ্ঞা জাতীয় নিরাপত্তা ও জুলাইয়ের বৈছা কর্মীদের সুরক্ষার জন্য বলে সরকার দাবি করলেও, এটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করছে।
হিউস্টন ক্রনিকল লিখেছে, বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক সন্ধিক্ষণে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার কার্যালয়ের প্রতিবেদনে ‘এমন রাজনৈতিক দলের নিষেধাজ্ঞা থেকে বিরত থাকার’ সুপারিশ করা হয়েছে যা প্রকৃত বহুদলীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং বাংলাদেশী ভোটারদের একটি বৃহৎ অংশকে কার্যকরভাবে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করবে।
টাইমস অফ ইন্ডিয়া এবং বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড জানিয়েছে, নিষেধাজ্ঞা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগের বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বহাল থাকবে।
তবে, দ্য প্রিন্ট এবং লাইভমিন্ট সতর্ক করেছে যে, এই পদক্ষেপ ভোটারদের একটি বড় অংশকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে, যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
দ্য ট্রিবিউন জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ এই নিষেধাজ্ঞাকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, যা রাজনৈতিক উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ একটি প্রতিবেদনে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ না করার পরামর্শ দিয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা “প্রকৃত বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফিরে আসার পথে বাধা সৃষ্টি করবে” এবং বাংলাদেশের ভোটারদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে।
জাতিসংঘের এই সতর্কতা সত্ত্বেও, ইউনূস সরকার এগিয়ে গেছে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগকে আরও গভীর করেছে।
আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ গত অক্টোবরে “সন্ত্রাসী সংগঠন” হিসেবে নিষিদ্ধ হয়। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, নিষেধাজ্ঞা জাতীয় নিরাপত্তা, জুলাই আন্দোলনকারীদের সুরক্ষা এবং ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের নিরাপত্তার জন্য নেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের বিচারকে সমর্থন করলেও দল নিষিদ্ধকরণের বিরোধিতা করেছে বিএনপি। দলটি ডিসেম্বর ২০২৫-এ নির্বাচন চায়, কিন্তু সরকার জানিয়েছে, সংস্কারের অগ্রগতির উপর নির্ভর করে নির্বাচন জুন ২০২৬ পর্যন্ত পিছিয়ে যেতে পারে। এনসিপি এবং জামায়াতে ইসলামীর মতো দলগুলো নিষেধাজ্ঞার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে, যা রাজনৈতিক সমীকরণকে জটিল করছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন যে, আওয়ামী লীগের নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করতে পারে। লাইভমিন্ট এবং দ্য প্রিন্ট জানিয়েছে, এই পদক্ষেপ ভোটারদের একটি বড় অংশকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে বাদ দিতে পারে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে জাতিসংঘ এবং প্রভাবশালী দেশগুলোর উচিত এই পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা। বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তাদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধকরণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এই সিদ্ধান্তকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। আওয়ামী লীগ দাবি করেছে, এই নিষেধাজ্ঞা তাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে অবদানের প্রতি অবিচার। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ ছাড়া এই সংকট রাজনৈতিক অস্থিরতাকে আরও গভীর করতে পারে।
(সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, আল জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, দ্য ট্রিবিউন, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, দ্য প্রিন্ট, লাইভমিন্ট, জাতিসংঘ)