ফ্রান্স-ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন “জাস্টিসমেকার্স বাংলাদেশ ইন ফ্রান্স” (জেএমবিএফ) ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক বাংলাদেশের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠন ও সমর্থকদের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানায়। জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত একটি বিপজ্জনক এবং অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ, যা বাংলাদেশের সংবিধানে দেওয়া মৌলিক অধিকারগুলোর স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিধির সাথে সঙ্গতিহীন বলে জেএমবিএফ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে তার ঐতিহাসিক নেতৃত্বের জন্য সুপরিচিত এবং বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়ের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। এই দল এবং এর বিশাল সমর্থক গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা শুধু অবিচারই নয়, এটি আধিপত্যবাদী শাসকদের দ্বারা রাজনৈতিক বিরোধিতাকারীদের দমন এবং গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা নির্মূল করার কৌশল বলে জেএমবিএফ মনে করে।
তাছাড়া, জেএমবিএফ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, বাংলাদেশের সংবিধান বাকস্বাধীনতা, রাজনৈতিক সংগঠন এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার রক্ষা করে—যা সংবিধানের ৩৭, ৩৮, এবং ৩৯ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মতো দেশের একটি প্রধান গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এবং তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর কার্যক্রমের উপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকারগুলোর পরিপন্থী এবং এটি নাগরিকদের চিন্তা, মতপ্রকাশ এবং রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতার প্রতি গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করে।
এছাড়াও, জেএমবিএফ মনে করে যে, এই বিস্তৃত দমনপীড়ন কেবল দেশীয় আইনই লঙ্ঘন করছে না, বরং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড—যেসব মানতে বাংলাদেশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যেমন আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চুক্তি (আইসিসিপিআর), সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র (ইউডিএইচআর) এবং মানবাধিকার রক্ষকদের উপর জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র—সরকার লঙ্ঘন করেছে। এ পর্যায়ে যখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কারের নামে আইনকে হাতিয়ার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে বিচারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে, তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চুপ থাকতে পারে না।
ফ্রান্সের মানবাধিকার কর্মী ও জেএমবিএফ-এর প্রধান উপদেষ্টা রবার্ট সিমন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠন ও সমর্থকদের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তে কঠোর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, “এটি একটি লজ্জাজনক এবং রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাজ, যা গণতন্ত্রের মূল চেতনার পরিপন্থী। এমন একটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা, যা বাংলাদেশের জন্মের জন্য লড়াই করেছে, তা শুধু অবৈধই নয়—এটি স্বাধীনতা ও আত্মনির্ধারণের নীতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুরোপুরি বিলীন হওয়ার আগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এবিষয়ে সোচ্চার হওয়া উচিত।”
মানবাধিকার আইনজীবী এবং জেএমবিএফ-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অ্যাডভোকেট শাহানুর ইসলাম সৈকত গভীর উদ্বেগের সাথে বলেন, “এই নিষেধাজ্ঞা এমন একটি রাজনৈতিক নিপীড়নের দৃষ্টান্ত, যা ইতিহাসের পাতায় নেতিবাচকভাবে লিখিত থাকবে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান ও মানবাধিকারকে সম্মান না করে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠীর ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের গণতন্ত্র এবং প্রতিটি নাগরিকের ভবিষ্যৎ বেছে নেওয়ার অধিকারই এখানে আক্রান্ত হয়েছে। আমরা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ এবং আইনি উপায়ে প্রতিরোধ করব।”
জেএমবিএফ অবিলম্বে এবং শর্তহীনভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছে এবং যেন দলের সদস্য ও সমর্থকেরা তাদের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার শান্তিপূর্ণভাবে ভোগ করতে পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছে। জেএমবিএফ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে সকল আইনি কার্যক্রম অবশ্যই আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতিতে যথাযথ প্রক্রিয়ায়, স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতার সাথে পরিচালনার আহ্বান জানাচ্ছে।
তাছাড়া, জেএমবিএফ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ এবং বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানায়, যেন তারা বাংলাদেশে আরও নিপীড়ন শুরুর আগেই এই বিষয়ে প্রতিবাদ জানায় এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বর্তমান পরিস্থিতি একটি সাংবিধানিক সঙ্কটকে মানবাধিকার সংকটে পরিণত করার ঝুঁকি তৈরি করছে।
জেএমবিএফ-এর এই উদ্যোগ কোনো দলের পক্ষাবলম্বন নয়—এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং মানবাধিকার সুরক্ষার সংগ্রাম। রাজনৈতিক বিরোধিতা কোনো অপরাধ নয়। মতভেদ সন্ত্রাসবাদ নয়। ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্র অবশ্যই বিজয়ী হবে।
সংক্ষিপ্ত তথ্য: (জেএমবিএফ-এর বিশ্বস্ত সূত্র এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী)
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। ১১ই মে, ২০২৫, শনিবার, সরকার জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যা দেশের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এই নিষেধাজ্ঞা এসেছে এমন সময়ে, যখন নতুন গঠিত ছাত্রনেতৃত্বাধীন জাতীয় নাগরিক পার্টি দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি চালাচ্ছে, যা অস্থায়ী প্রশাসনের সমর্থনে পরিচালিত হচ্ছে বলে ধারণা করা হয়। জামাত-ই-ইসলামী, হেফাজত-ই-ইসলাম, ইসলামী আন্দোলনসহ আরও কয়েকটি ইসলামী এবং ডানপন্থী গোষ্ঠীও এই বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করছে, যারা আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে।
সরকারের ঘোষণায় বলা হয়েছে, নিষেধাজ্ঞাটি বহাল থাকবে যতদিন না আওয়ামী লীগের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (ICT) সম্পন্ন হয়। দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালে শত শত বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর অভিযোগে মামলা চলমান।
আইন সংশোধনের মাধ্যমে সরকার ICT আইনের আওতা বাড়িয়ে রাজনৈতিক দল ও সংগঠনকেও বিচারের আওতাভুক্ত করেছে। এর ফলে আওয়ামী লীগকে একটি সম্মিলিত সংগঠন হিসেবে বিচার করার পথ উন্মুক্ত হয়েছে।
১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এর নেতৃত্ব ছিল অপরিসীম। তবে সমালোচকদের মতে, দলটির শাসনের শেষ কয়েক বছর ছিল ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী, বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবক্ষয়ে ভরা—যা বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে।