।। সাইফুর রহমান।।
চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র। দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশই এই বন্দর দিয়ে পরিচালিত হয়। কিন্তু যদি এই বন্দর মার্কিন নৌবাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়—তাহলে তা শুধুমাত্র একটি বাণিজ্যিক ঘটনা থাকবে না। বরং এটা হবে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থানে একটি গভীর ও সুপরিকল্পিত হস্তক্ষেপ।
“মানবিক করিডোর” না “কৌশলগত করিডোর”?
বলা হচ্ছে, এই নিয়ন্ত্রণ মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে—যেখানে দুর্যোগ, সংকট বা উদ্বাস্তুর জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা সহজতর হবে। বাস্তবে, এটি মানবিকতার মোড়কে কৌশলগত উপস্থিতি স্থাপনের পথ মাত্র।
যেকোনো দেশ যখন নিজের প্রধান বন্দর বিদেশি সামরিক বা সহযোগী প্রতিষ্ঠানের হাতে দেয়, তখন সে কেবল তার বাণিজ্য নয়—তার সার্বভৌমত্ব, কূটনীতি এবং প্রতিরক্ষা নিরাপত্তাও আংশিকভাবে তুলে দেয়।
মার্কিন স্বার্থ কোথায় লুকিয়ে?
১. ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রবেশাধিকার: চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে ভারত, বিশেষ করে তাদের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা—যার মধ্যে রয়েছে সেনা সরবরাহ, নজরদারি ও প্রভাব বিস্তার।
২. মায়ানমার ও বঙ্গোপসাগর নিয়ন্ত্রণ: চীন ও রাশিয়ার প্রভাব প্রতিহত করতে যুক্তরাষ্ট্র চট্টগ্রাম বন্দরকে ব্যবহার করতে চায় একটি “পূর্বাভিযান বেজ” (forward operating base) হিসেবে।
৩. রোহিঙ্গা সংকটের সুযোগ: মানবিক করিডোরের নামে রোহিঙ্গা ইস্যুকে সামরিক ও কূটনৈতিক হস্তক্ষেপের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে।
আমাদের ক্ষতির দিকগুলো কী?
• অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হারানো: বন্দরের আয়, রপ্তানি-আমদানি নীতি ও ব্যবসায়িক তথ্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে গেলে তা জাতীয় অর্থনীতির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
• নিরাপত্তা ঝুঁকি বৃদ্ধি: মার্কিন সামরিক মিত্ররা বন্দরে উপস্থিত থাকলে দেশের গোপন তথ্য ফাঁস হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। বাংলাদেশের ওপর নজরদারির সুযোগ তৈরি হবে।
• কূটনৈতিক স্বাধীনতা খর্ব: পররাষ্ট্রনীতিতে নিরপেক্ষ অবস্থান রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী শক্তিগুলোর (যেমন: চীন বা রাশিয়া) সঙ্গে সম্পর্ক ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
চট্টগ্রাম বন্দর শুধু একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র নয়, এটি আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। “মানবিক করিডোর” যদি বিদেশি প্রভাব ও সামরিক উপস্থিতির দরজা খুলে দেয়, তাহলে আমাদের ভূখণ্ড এক সময় হয়ে উঠতে পারে পরাশক্তি দেশগুলোর প্রক্সি ওয়ারজোন। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।